Published : 08 Jan 2014, 10:16 AM
দেশব্যাপী অব্যাহত সন্ত্রাস-সহিংসতা এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বিএনপিসহ কয়েকটি দল অংশগ্রহণ না করায় এবং ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় চলমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে এই নির্বাচন কতটুকু সহায়ক ভূমিকা পালন করবে তা নিয়ে এর মধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে।
কেউ কেউ বলছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে সংকট আরও ঘনীভূত করে তুলবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুভবুদ্ধির পরিচয় দিলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান সূত্র বের করা কঠিন হবে না।
তবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, খুব দ্রুতই রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর হওয়ার মতো পরিস্থিতি দেশে এখনও তৈরি হয়নি। নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনে সফল না হলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসবে এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। বরং হরতাল-অবরোধের মতো আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পরিকল্পনাই বিএনপি এবং তার সমমনা দলগুলো করছে বলে শোনা যাচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে যারা সরকার গঠন করবে তাদের 'অবৈধ' ও 'অসাংবিধানিক' আখ্যা দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন অব্যাহত রাখতে চাইবে ১৮ দলীয় জোট।
এই আন্দোলনে তারা সাফল্য পাবে কিনা সে প্রশ্ন অবশ্যই করা যায়। আন্দোলন করে দাবি আদায় করার কোনো রেকর্ড বিএনপি এবং তার মিত্ররা এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। বরং গত কয়েক বছরে একাধিকবার সরকার পতনের আন্দোলনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েও বিরোধী দল বাস্তবে কিছুই অর্জন করতে পারেনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলও বিএনপি স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। ওই নির্বাচনকেও বিএনপি পাতানো নির্বাচন বলেই অভিহিত করেছিল এবং সরকারকে তার মেয়াদ পূর্ণ করতে দেওয়া হবে না বলে বার বার হুঙ্কার দেওয়া হয়েছিল।
সেসব হুঙ্কারের পরিণতি সবারই জানা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরেও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একে প্রহসনের নির্বাচন বলে অভিহিত করে এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'এই অবৈধ সরকার দীর্ঘায়িত হবে না।' আশার কথা এটাই যে, এবার বেগম জিয়া কোনো নির্দিষ্ট তারিখ বেঁধে না দিয়ে বলেছেন, সরকার 'দীর্ঘায়িত' হবে না। এই 'দীর্ঘায়িত' বলতে তিনি আসলে কী বুঝিয়েছেন সেটা বোঝার জন্য দেশের মানুষকে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
তবে এটা ঠিক যে, বিএনপি যদি আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন না করে তাহলে বিজয় অর্জনের জন্য তাদেরও আরও দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। মানুষ হরতাল-অবরোধ পছন্দ করে না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর টানা হরতাল-অবরোধ দিয়ে মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে। এরপরও যদি হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হয় তাহলে মানুষ তা আরও পালন তো দূরের কথা, উল্টো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অগ্রাহ্য করবে। ইতোমধ্যেই যার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের পরের দিন থেকে যে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল দেওয়া হয়েছে তা কার্যত মানুষ অগ্রাহ্যই করেছে।
আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপির নেতাকর্মীরা রাস্তায় নামেন না। জামায়াত-শিবির এবং কিছু ভাড়াটে সন্ত্রাসী নাশকতা চালায়। ভয়ে-আতঙ্কে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল বিগ্নিত হয়, কিন্তু আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মবোধ করে না কেউই। বিএনপিকে মানুষের এই অনুভূতি বুঝতে হবে। মানুষের কষ্ট হয়, মানুষের দুর্দশা বাড়ে এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিহার না করলে বিএনপি একটি গণবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে পারে।
সেজন্যই আন্দোলন করতে হলে বিএনপিকে কৌশল ও কর্মসূচি বদলাতে হবে। মানুষকে কষ্ট না দিয়ে দলের নেতাকর্মীদের কষ্ট স্বীকার করতে হবে। দেশ ও দেশের মানুষের জন্যই যদি বিএনপির রাজনীতি হয়ে থাকে তাহলে মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ বাড়ানোর রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে দূরে সরে আসতে হবে। সরকারের বিরুদ্ধে ঢালাও দমন-পীড়নের অভিযোগ উত্থাপনের আগে বিএনপিকে ভাবতে হবে আন্দোলনের নামে তারা যে হারে হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে তাকে মানুষ কোন চোখে দেখছে। এবারের বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে দেশজুড়ে যেসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই হয়েছে আন্দোলনকারীদের হাতে। অতীতে কখনওই আন্দোলনকারীদের হাতে সাধারণ মানুষের নিহত হওয়ার কথা শোনা যায়নি।
এমনকি এবার পুলিশ-বিজিবি সদস্যরাও আন্দোলনকারীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। পুলিশের গুলিতে যে ক'জন আন্দোলনকারী হতাহত হয়েছেন তার জন্য যদি পুলিশের বাড়াবাড়ির নিন্দা করতে হয় তাহলে আন্দোলনকারীদের হাতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ আহত-নিহত হওয়ায় বিরোধী দলের নিন্দা-সমালোচনা করা হবে না কেন? পুলিশের দায়িত্ব শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কিন্তু আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতা সৃষ্টি করা হলে সেটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে অবিলম্বে প্রহসনের নির্বাচন বাতিল, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন-পরবর্তী 'অবৈধ সরকারের' সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। দলের শীর্ষ দুই নেতার এই দুই বক্তব্য কি পরস্পরবিরোধী নয়? বেগম জিয়া সমঝোতার আহ্বান জানালেন আর তার পুত্র তারেক রহমান সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করলেন!
বিএনপি নেতৃত্বকে এখন আসলে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অতীতের ভুলত্রুটি, সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন-পর্যালোচনা করতে হবে। অতীতে তারা অনেক বাগাড়ম্বর করেছেন। অনেক আলটিমেটাম দিয়েছেন। তারিখ নির্ধারণ করে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ওই তারিখের পর পালাবার পথ পাবে না। কিন্তু এইসব উসকানি ও প্ররোচনামূলক বক্তব্য রাজনৈতিক পরিবেশকে তিক্ত করা ছাড়া আর কিছুই করেনি।
সেজন্যই এখন বিএনপিকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, বক্তৃতা-বিবৃতিতে উগ্রতা পরিহার করতে হবে। একই সঙ্গে বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীদের সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। উসকানি-প্ররোচনা বন্ধ করতে হবে। যে তর্জন-গর্জনে বর্ষণ হয় না তা অব্যাহত রেখে কার লাভ হয় সেটা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।
বেগম জিয়া তার বিবৃতিতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার শাসন করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তার এই বক্তব্য যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে কি এই প্রশ্ন করা যায় না যে, বার বার আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে ব্যর্থ হয়ে বড় বড় কথা বলার নৈতিক অধিকার কি বেগম জিয়ার আছে?
বেগম জিয়া তার বিবৃতিতে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে বেআইনি কার্যকলাপ ও হত্যা-নির্যাতন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ''ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীসমূহসহ সকল নাগরিকের জীবন ও সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করুন।''
বেগম জিয়ার এই বক্তব্যও পরস্পরবিরোধী। ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীসহ নাগরিকদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা কারা বিঘ্নিত করছে? কারা দেশকে অস্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে গেছে? বিএনপির সমর্থনপুষ্ট হয়ে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারাই কি দেশের সর্বত্র নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা চালাচ্ছে না? যারা সংখ্যালঘুসহ সাধারণ নাগরিকদের ওপর আক্রমণ করছে, তাদের জীবন ও সম্পদহানির কারণ হচ্ছে তাদের নিবৃত্ত করার আহ্বান কেন বেগম জিয়া জানাচ্ছেন না?
এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী যদি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে বেগম জিয়া কি তাকে 'বেআইনি কার্যকলাপ ও হত্যা-নির্যাতন' বলে অভিহিত করলে সেটা কি ভালো হবে? এসব বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার না করে বেগম খালেদা জিয়া আন্দোলনের কথা যতই বলুন না কেন তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
আবার আওয়ামী লীগ এবং সরকারকেও অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিএনপিকে উপেক্ষা করার মনোভাব পরিহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিএনপির প্রতি দেশের একটি বিরাট সংখ্যক মানুষের সমর্থন রয়েছে। তারা যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতি করার সুযোগ না পায় তাহলে তারা হঠকারী পথ গ্রহণ করতে পারে, তাতে রাজনীতি থেকে অস্থিরতা দূর হবে না। সেজন্যই বিএনপিকে আস্থায় নেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ আওয়ামী লীগ এবং সরকারকে নিতে হবে।
৬ জানুয়ারি নির্বাচন-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও সহিংসতা পরিহার এবং যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিবাদী জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় আসার জন্য বিরোধী দলীয় নেত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানের ইতিবাচক সাড়া বেগম জিয়ার কাছ থেকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কারণ জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ৬ জানুয়ারিতেই বিবিসিকে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ''আমরা কার সঙ্গে কাজ করব, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) তা নির্ধারণ করে দেয়ার কেউ নন। তার সিদ্ধান্তে চলবে না। বিএনপি একটি স্বাধীন দল। বিএনপি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে।''
অর্থাৎ জামায়াতের সঙ্গত্যাগের বিষয়টি বেগম খালেদা জিয়া কার্যত নাকচ করে দিয়েছেন। তাহলে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হবে কীভাবে? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সমঝোতা হওয়ার সুযোগ নেই দেশের বর্তমান বাস্তবতায়। জামায়াতে ইসলামী যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। দেশে আন্দোলনের নামে বর্তমানে যে সন্ত্রাস ও সহিংসতা চলছে তার জন্যও প্রধানত দায়ী জামায়াতে ইসলামী।
অথচ এই জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে বিএনপি। জামায়াতের সঙ্গ যদি বিএনপি না ছাড়ে তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতা হওয়ার সুযোগ কম। যারা দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা কামনা করেন তাদের উচিত বিএনপিকে জামায়াতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে প্রভাবিত করা।
বিএনপিকে এটা বুঝতে হবে যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে জোড়াতালি দিয়ে চলার সময় শেষ হয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে যে জাগরণ তৈরি হয়েছে তাকে উপেক্ষা করে দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করা সহজ হবে না। মুক্তিযুদ্ধের তেতাল্লিশ বছর পরে এসেও পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন কাম্য নয় বলে যারা প্রচার করেন তারা বুঝতে পারেন না যে একাত্তরের পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাওয়া আর সম্ভব হবে না।
ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করেন তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করতে যতই চেষ্টা করুন না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা সফল হতে পারবেন না। কারণ অপপ্রচার চালিয়ে মানুষকে সময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা গেলেও সবসময়ের জন্য বিভ্রান্ত করা যায় না। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও ধর্ম নিয়ে উগ্র অবস্থানের বিরুদ্ধে। এটা অতীতে একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে।
জামায়াত যে উগ্রপন্থার অনুসারী দল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত যে রকম মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল এখনও তারা একই কাজ করে চলেছে। তাদের কোনো পরিবর্তন নেই। অতীত ভূমিকার জন্য যেমন অনুতাপ নেই, তেমনি বর্তমান ভূমিকা পরিবর্তনেও কোনো আগ্রহ নেই।
জামায়াত একটি গণবিচ্ছিন্ন মিলিট্যান্ট সংগঠন। তাদের ক্যাডার বাহিনী আছে। তারা সন্ত্রাস-সহিংসতায় পারদর্শী। কিন্তু কোনো সময়ই এরা জনগণের বিপুল সমর্থন পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেনি। কাজেই এই দলের উপর বিএনপির ক্রমাগত নির্ভরতা বিএনপিকেও দিন দিন গণবিচ্ছিন্নতার দিকেই ঠেলে দিতে পারে। বিএনপিকে এটা বুঝেই ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
সরকার এবং আওয়ামী লীগকেও এখন দেশের পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক করার জন্য অধিক মনোযোগী হতে হবে। কোনো ধরনের উসকানিমূলক কথাবার্তা না বলে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্রুতই এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে যা থেকে যা থেকে মানুষের মধ্যে দল ও সরকার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।
গত ৫ বছরে যেসব মন্ত্রী-এমপি-উপদেষ্টা বিতর্কিত হয়েছেন, যারা অবৈধ উপায়ে অর্থে-বিত্তে গত ৫ বছরে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন– তাদের এখন দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। যাদের অতিকথন গত ৫ বছরে সরকারকে অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে তাদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। কয়েকজন নেতা-মন্ত্রীর চেহারা টেলিভিশনে বার বার দেখে দেখে মানুষ বিরক্ত, ক্লান্ত এদের সরাতে হবে। নতুন মুখ আনতে হবে।
আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে নিশ্চয়ই কিছু শিক্ষা লাভ করেছে। এই শিক্ষার আলোকে দ্রুত দলকে গোছানোর উদ্যোগ নিতে হবে। গণবিচ্ছিন্ন যেসব নেতাকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছিল তাদের থেকে দলকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা এমন একটি মন্ত্রিসভা উপহার দিতে হবে যাদের সম্পর্কে দেশের মানুষের মধ্যে কোনো ধরনের নেতিবাচক ধারণা নেই। একটি দক্ষ ও ক্লিন ইমেজের মন্ত্রিসভা দেশের মানুষকে বর্তমান সময়ে অনেকটাই উজ্জীবিত করতে সক্ষম হবে।
দেশের মানুষকে এটা বোঝাতে হবে যে, শেখ হাসিনা এবার সত্যিকার অর্থেই দিনবদলের ধারায় চলতে চান। দুর্নীতিমুক্ত একটি দক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলে দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করাটাই তার প্রধান লক্ষ্য– এটা যদি দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয় তাহলে দেশবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন শেখ হাসিনা পাবেন।
সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলও তাদের অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ''আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করেই সমাধানে পৌঁছানো যাবে। সেজন্য সকলকে ধৈর্য ধরতে হবে, সহনশীল হতে হবে এবং সব ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পথ পরিহার করতে হবে।''
রাজনীতির প্রধান দুই পক্ষ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়ের জন্যই প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। দুই পক্ষকেই ধৈর্য ধরতে হবে, সহনশীল হতে হবে এবং সব ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পথ ত্যাগ করতে হবে। দেশের মানুষ গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করবে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া কয়েকটি অগ্রাধিকারমূলক কাজের বাস্তবায়ন দেখতে।
সেগুলো হলো– ক. যেকোনো মূল্যে জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষা করা; খ. নির্বাচনোত্তর যে কোনো সন্ত্রাস ও সহিংসতা কঠোরভাবে দমন করা; গ. নির্বাচনবিরোধী দুষ্কৃতকারীদের অগ্নিসংযোগে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো অতিসত্বর মেরামত করে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করা; ঘ. ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানার উৎপাদন এবং রপ্তানি বাণিজ্যকে সব রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাত থেকে রক্ষা করা; ঙ. নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবন সুনিশ্চিত করা।
এই কাজগুলো যদি সত্যি সত্যি দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে, রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে তা দূর হওয়ারও পথ প্রস্তত হবে।
বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক, কলাম লেখক।