Published : 12 Sep 2010, 03:45 PM
ঈদের আগে একটি ভাল খবর আমরা পেয়েছি। বলা যায় ঈদের উপহার। পরিবেশ নিয়ে যারা ভাবেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে যাদের উৎকন্ঠা রয়েছে, মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে যারা উদ্গ্রীব এবং বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাণবৈচিত্র রক্ষার প্রশ্ন যেখানে খুব গুরুত্বপুর্ণ – সব কিছু মিলিয়ে বান্দরবান জেলায় তামাক চাষের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারীর দায়রা জজ আদালতের আদেশ বহাল আছে দেখে সকলে স্বস্তি পেলেন। আমিও পেয়েছি, অনেকের সাথে।
আদালত গত ৪ সেপ্টেম্বর তারিখে বান্দরবন জেলায় তামাক চাষের ওপর জারী আদালতের পূর্ববর্তী নিষেধাজ্ঞা (১৮ আগস্ট, ২০১০ তারিখে জারী করা)বহাল রেখেছেন এবং আগামী ১৮ অক্টোবর পরবর্তী শুনানীর তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
দু'জন স্থানীয় সাংবাদিকের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৮ আগস্ট আদালতের এই যুগান্তকারী নিষেধাজ্ঞার ঘটনা তামাক চাষ হয় এমন সব অঞ্চলেই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। বান্দরবান জেলা আদালত তাঁর নিষেধাজ্ঞা যদিও শুধু বান্দরবান জেলার ক্ষেত্রে সীমিত রেখেছেন, কিন্তু এর কারণে অন্য সব এলাকায় যেখানে তামাক চাষের কারণে মানুষ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁরা সবাই খুশি হয়েছেন। এই নিষেধাজ্ঞার সাথে বান্দরবান জেলার ডিসি, পুলিশ সুপার, বন বিভাগের কর্মকর্তাসহ প্রায় ২২ জনকে তামাক চাষের জন্য ব্যবহার হয় এমন সকল স্থাপনা, যেমন চুল্লী, তামাক পাতার গুদাম কেন সরিয়ে ফেলা হবে না তার কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এর উত্তর গত ২৬ আগস্ট আদালতকে দেয়া হয়েছে। জানি না তাঁরা কি বক্তব্য দিয়েছেন, কিন্তু আদালত নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে জনগনের স্বপক্ষে এক বিরাট ভুমিকা রেখেছেন। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ জানাচ্ছি, সেই দু'জন সাংবাদিক – আলাউদ্দিন শাহরিয়ার এবং জাফর ইকবালকেও, যারা এই মামলার বাদী হয়েছেন। সে সাথে অন্যসব সাংবাদিকরা, যাঁরা ২০০৯-২০১০ সালের রবি মৌসুমে বিভিন্ন জেলায় তামাক চাষ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে খাদ্য ঘাটতির বিষয়টি নানাভাবে তুলে ধরেছিলেন। উত্তরবঙ্গের রংপুর, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট থেকে শুরু করে কুষ্টিয়ার নতুন নতুন এলাকা, যশোর,চুয়াডাঙ্গা, এদিকে টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, চলনবিলে গত নভেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে সরিষা, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আলুসহ নানা ধরণের শীতকালীন ফসল ও শাকসব্জির পরিবর্তে শুধুই তামাক দেখা গেছে। এই দৃশ্য ছিল ভয়াবহ। আমি অবাক হয়েছি, সরকার কি করে এই দৃশ্য দেখে নিশ্চুপ বসে ছিলেন। রিট আবেদনকারী সাংবাদিক দুইজন দেখেছেন বান্দরবান জেলাতেই ১০,২১২ একর জমিতে খাদ্য উৎপাদন না করে তামাক চাষ করা হয়েছে। এর ফলে অন্যান্য ফসলের উৎপাদনে ঘাটতি হয়েছে। তাঁদের বিবেকের তাড়নায় তাঁরা মামলা করেছেন। ধন্যবাদ।
ধুমপান বিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশে চলছে অনেকদিন থেকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণায় ধুমপানের ফলে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বছরে শুধু ধুমপানের কারনে মৃত্যুর সংখ্যা ৫৭,০০০, তাছাড়া নানা ধরণের জটিল রোগ তো আছেই। রিট আবেদনকারী সাংবাদিকদের প্রশ্নও ছিল এটাই। ধুমপান নিয়ন্ত্রনের জন্য সরকারের আইন রয়েছে, অথচ তামাক চাষের ওপর সরকারের কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণ নেই কেন? এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে, পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। বন বিভাগ কি দেখছে না, তামাক পাতা পোড়াবার জন্য গাছ কেটে উজার করা হচ্ছে। কৃষি জমিতে খাদ্য বা প্রয়োজনীয় ফসল না করে তামাক চাষ করা হচ্ছে, যা মাটিকে ক্রমশঃ অনুর্বর করে দিচ্ছে, কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ নীরব। দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের দেশে কৃষি জমি ব্যবহারের জন্য কোন নীতিমালা নেই। আমাদের বিশাল খাদ্য ঘাটতি আছে জানি, তবুও কৃ্ষি জমিতে খাদ্য ফসল উৎপাদন না করলে সরকারের দিক থেকে কোন বাধা নেই। এই এক অদ্ভুত ব্যাপার।
তামাক কোন খাদ্য নয়, এমনকি সচরাচর অর্থে কৃষকের ফসলও নয়। কৃষক তার নিজের কারণে এই ফসল উৎপাদন করে না। কিন্তু কৃষি জমিতেই তামাকের আগ্রাসন। এর উদ্যোক্তা কোম্পানী, তাদের কৃষক দরকার,আর দরকার উর্বর জমির। কৃষকের ঘাড়ে ফসলের যত রকম অনিশ্চয়তা চাপিয়ে দেয়া যায়, আর কোম্পানী মুনাফা ভোগ করতে পারে অনায়াসে। জমি অনুর্বর হয়ে গেলে তামাক কোম্পানী অন্য এলাকায় চলে যায়, জমি তো তার নয়, সে যেখানে খুশি যেতে পারে। কিন্তু পড়ে থাকে কৃষক। কৃষক নগদ টাকার লাভের আশায় তামাক চাষ শুরু করলে কোম্পানীর পাতানো লাভ ও লোভের ফাঁদে আটকে পড়ে থাকে। যখন ক্ষতি বুঝতে পারে তখন বের হবার পথ থাকে না।
বান্দরবান জেলা আদালতের এই রায়ের পর উবিনীগের পক্ষ থেকে রফিকুল হক টিটু জনমত যাচাই করেছিলেন। এই মতামত জরিপে সাধারণ কৃষকের স্বস্তি প্রকাশ পেয়েছে। আলী কদম উপজেলার একজন স্কুল শিক্ষকের মতে এই রায় সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের জন্য 'মায়ের দুধের মতো উপকারী'। যদিও এই রায়টি একটি নির্দিষ্ট এলাকার জন্য দেয়া হয়েছে,তবুও তাঁরা এর উপকার সমগ্র বাংলাদেশের জন্য হবে এটাই তাঁরা আশা করছেন। কেউ বলছেন এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদ। কেউ এই রায়কে তামাক চাষ থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে পথ নির্দেশক হবে মনে করছেন।
এলাকার ভুক্তভোগী মানুষ তামাক চাষকে গজব মনে করছেন, কারণ এর ক্ষতিকর প্রভাবের কোন শেষ নাই। লামার একজন কৃষক বলেন, তামাক চাষ কাউকে ফকির বানায় আর কাউকে বাদশা বানায়। এটা নিশ্চিত যে কোন কৃষক বাদশা হতে পারেন নি, তাঁরা ফকির হয়েছেন, আর বাদশা হয়েছে কোম্পানী।
মাতামুহুরী নদীর পারের উর্বর জমিতে আগে সারা বছর মৌসুমী ফসল দেখা যেতো। তামাক চাষের কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু নদীর পারের ক্ষতি হয়েছে তা নয়, নদীর পানিও তামাক চাষে কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহারের কারণে দুষিত হয়ে পড়েছে। এখন মানুষ আবার আশা করছেন, মাতামুহুরী নদীর দুই কুল শাক সব্জিতে ভরে যাবে। কৃষক পরিবার গরু ছাগল হাঁস মুরগী পালতে পারবে।
তামাক চাষ বন্ধের জন্য আদালত যতটুকু করেছেন তা শিরোধার্য। এরপরের কাজ আদালতের নয়,সরকারের এবং জনগণের। তামাক কোম্পানী তামাক চাষের চেষ্টা চালিয়ে যাবে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু আমাদের নিজেদের কাজ আমাদের করতেই হবে। এখন কার্তিক মাস,আর কিছুদিন পরেই তামাক চাষের প্রস্তুতি নেয়ার কথা। সেই সময় তামাক চাষ না করে খাদ্য ফসল উৎপাদনের জন্য বীজ ও প্রয়োজনীয় উপকরণ কৃষককে সরবরাহ করার দায়িত্ব কৃষি বিভাগের, বিশেষ করে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের রয়েছে। তামাক চাষের ক্ষেত্রে এই সকল উপকরণ সরবরাহ কোম্পানী কৃষককে ঠকিয়ে করা স্বত্বেও কৃষক তাতে আস্বস্ত হয়ে তামাক চাষ করেছে। প্রচার মাধ্যমে বান্দরবান জেলা প্রশাসক এবং কৃষি বিভাগ কৃষকদের প্রয়োজনীয় সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা আশা করি সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভুমিকা নিয়ে কৃষকদের অসহায়্ত্ব দূর করবেন। না হলে আবার তামাক কোম্পানী সুযোগ নেবে।
বান্দরবান আদালতের এই নিষেধাজ্ঞাকে একটি দিকনির্দেশনা হিসাবে গ্রহণ করে সরকার কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার তামাক চাষ বন্ধের জন্য, কিংবা নিয়ন্ত্রণের জন্য উদ্যোগ নিতে পারেন। বিশেষ করে মাতামুহুরী নদীর দুই পারে যেন তামাক চাষ না করা হ্য় তার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে এই মৌসুমেই।
কুষ্টিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলে তামাক চাষের ক্ষতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এখানে কেউ আদালতের শরনাপন্ন হননি বলেই বিষয়টি সম্পর্কে মানুষ জানতে পারছেন না। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় নিজ উদ্যোগে ২০০৯ সালে তথ্য সংগ্রহ করে কৃষি জমিতে তামাক চাষের ক্ষতি সম্পর্কে জেনেছেন এবং তামাক চাষের জন্য সারের ভর্তুকি না দেয়ার সিদ্ধ্বান্ত ঘোষণা করেছেন। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকও তামাক চাষের জন্য ঋণ সুবিধা না দেয়ার জন্য সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে তামাক চাষ বন্ধের বিষয়টি বান্দরবানে হঠাৎ করে হয় নি, সারা বাংলাদেশেই এর বিরুদ্ধ্বে জনমত তৈরী হয়ে আছে। এমনকি সরকারও এ ব্যাপারে ভালভাবেই ওয়াকিবহাল আছেন। এইবার ২০১০ – ২০১১ সালের বাজেটে তামাক পাতা রপ্তানীর ওপর শুল্ক ধার্য করা হয়েছে। উদ্দেশ্য তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করা। তাই বান্দরবান জেলা আদালতের এই রায় সব মহলেই সমাদৃত হয়েছে। আগস্ট মাসে প্রথম নিষেধাজ্ঞার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এর স্বপক্ষে মানবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে, দেশের উত্তর প্রান্ত থেকে শুরু করে দক্ষিণের জেলাগুলোতে। ঢাকা শহরেও কয়েকটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট,পরিবেশ আন্দোলন ও তামাক বিরোধী নারী জোটের উদ্যোগে।
তামাক চাষের ক্ষতি সম্পর্কে বোঝাই যথেষ্ট নয়,এর থেকে বের হয়ে আসার জন্য কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। আশা করি সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন ও উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন।