Published : 03 Oct 2013, 01:51 PM
১ অক্টোবর রাতে ঘুম হল মাত্র দুই ঘন্টা। ভোর ঠিক পাঁচটায় সেই যে ঘুম ভেঙেছে, দুচোখ আর এক করতে পারিনি। ঢাকায় ফোন করলাম এক সাংবাদিক বন্ধুকে। উত্তর এল ট্রাইব্যুনালের প্রবেশপথ থেকে। ট্রাইব্যুনাল আজ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায় দেবে। ফোনে অনেক মানুষের হট্টগোল শুনতে পেলাম। বন্ধুটির হ্যালো শুনেই তার গলায় এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করলাম।
গলার স্বর একটু উঁচুতে তুলেই কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই বন্ধুটি বলতে শুরু করল, ''আজ সাকার মামলার রায়। এর আগেও ছয় ছয়টি মামলার রায়ের রিপোর্ট করেছি; কিন্তু আজকের অনুভূতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। তোমাকে বোঝাতে পারব না।''
বন্ধুটির পেশাগত কাজের নির্বিঘ্নতা দিতে, পরে ফোন করার কথা বলে রেখে দিলাম। কী এক অমোঘ প্রতিক্রিয়ায় ঢাকার সেই উত্তেজনা যেন সেকেন্ডেই আমার শরীরেও অনুভব করলাম।
হাতমুখ ধুয়ে ঢাউস এক কাপ কফি নিয়ে কম্পিউটরের সামনে বসলাম। বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়াতে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলাম প্রথমেই। সবখানে একই উত্তেজনা। অনলাইনে সম্প্রচারিত একটি টিভি চ্যালেন চালিয়ে দিয়ে লাইভ রিপোর্টে কান রাখলাম। একই সঙ্গে ফেসবুকে প্রবেশ করা মাত্রই ঢাকার বন্ধুটির ফোনে হট্টগোল শুনে নিজের ভিতরে যে অনুভূতি হয়েছিল, এবার যেন তার চেয়ে শতগুণ বেশি হল।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাঙালিরা সাকা চৌধুরীর রায়ের অপেক্ষায় একের পর তাদের অনুভূতির কথা লিখে যাচ্ছিলেন। এক একটা পোস্টের নিচে অনেকে আবার তাদের অনুভূতির কথাও জানিয়ে যাচ্ছিলেন সমান তালে। ফেসবুকের নিউজ ফিডে অস্থির চোখ যেন গোগ্রাসে গিলছিল সব উত্তপ্ত, উদ্দীপনাময়, বিপ্লবী, আপোষহীন বক্তব্যগুলো।
ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য ফোন করলাম একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল এবং নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবিরকে। ইতোপূর্বের ছয়বার রায় ঘোষণার সময়ের মতো হরতাল ডাকা বা বোমাবাজি হয়নি এবার। ওদের কণ্ঠস্বরে এক ধরনের অস্বস্তিকর উত্তেজনা টের পেলাম।
ভাবলাম, দেশের মানুষ হরতাল আর বোমাবাজিতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, এর ব্যত্যয় ঘটলেই আরও ভয়ংকর কিছুর জন্য অপেক্ষা করাটাই যেন স্বাভাবিক! অন্তত এই দুইজনের কণ্ঠে তারই কিছুটা আভাস পেলাম।
ঘড়ির কাঁটা ধরে সময় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার দৃশ্যপটেরও পরিবর্তন হচ্ছিল ট্রাইব্যুনালে। হাজার হাজার মাইল দূরে সুইডেনে বসেও স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম তা। টাইব্যুনালের প্রতি সেকেন্ডের খবর পেয়ে যাচ্ছিলাম কিছু সময় পর পরই। খবর পেলাম, সাকাকে বহন করা প্রিজন ভ্যানটি ট্রাইব্যুনালে ঢুকল। গাড়ি থেকে নেমেই সাকার সিগারেট ধরানোর খবরও পেলাম। সেই সঙ্গে জানলাম, সাকা একেবারেই তার স্বভাবসুলভ ভাবলেশহীন উচ্ছ্বল মুডে ছিলেন!
ট্রাইব্যুনালে বিচারপতিগণ এসে আসন গ্রহণের পর আস্তে আস্তে ১৭২ পৃষ্ঠার রায় যখন পড়া শুরু হল, তখনও নাকি সাকা চৌধুরী হাসছিলেন এবং বিভিন্ন কটু মন্তব্য করছিলেন। এক সময় রায়টি সম্পূর্ণ পড়া শেষ হল এবং অধীর আগ্রহের সেই আদেশ জারি হল। ঘোষিত রায়ে প্রমাণিত নয়টি অভিযোগের মধ্যে চারটিতে ফাঁসি, তিনটিতে বিশ বছর করে এবং বাকি দুটিতে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে সাকা চৌধুরীকে।
ফেসবুক এবং টিভির পর্দায় দেখা জনসাধারণের উত্তেজনা এবং চিৎকার আমি সম্বোহনের মতো দেখছিলাম। যেন হঠাৎ আমার পৃথিবীটা থমকে দাঁড়িয়েছিল। স্মৃতির পাতাগুলো এক এক করে চোখের সামনে উল্টে যাচ্ছিল। দেখতে পাচ্ছিলাম প্রতিদিনের নতুন নতুন রূপে জন্ম দেওয়া এক একটি ঘটনা।
কোনোদিন মনে হয়নি সেই দিনটি আসবে, যেদিন দুর্দান্ত প্রতাপশালী ছয়বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সম্পূর্ণ অসহায়ের মতো আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের ফাঁসির রায় শুনবেন। তাচ্ছিল্যের হাসি তার সারামুখ জুড়ে থাকলেও, আইনের আদালতে একাত্তরে তার বীভৎস সব অপকর্মের বিরুদ্ধে রায় হয়েছে। তাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধগুলোর জন্য ফাঁসির আদেশ শুনতে হয়েছে।
আমরা যারা সেই ১৯৯২ সাল থেকে, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বের সময় থেকে অদ্যাবধি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে এসেছি, আমরা কি সন্দেহাতীতভাবে এই মূহূর্তটির কথা বিশ্বাস করেছিলাম কোনোদিন? নিজেকেই প্রশ্ন করেছি বার বার। অথচ সেই ক্ষণটি আজ দেখছি একেবারেই চোখের সামনে। এর আগেও ছয়বার দেখা হয়েছে। অপেক্ষায় আছি আরও দেখার, শেষটুকু দেখার।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ এই ট্রাইব্যুনালে প্রথম কোনো বিএনপি নেতার শাস্তির আদেশ। এর আগের ছয়টি রায় ছিল বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াত নেতাদের। বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের কাছে এই রায়ের মাধ্যমে স্পষ্ট হল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে জামায়াত-বিএনপির পরষ্পর প্রবিষ্ট সম্পর্কের কারণ।
যারা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির ব্যাগে ভোট দিয়েছিল, তারা হয়তো জানতই না যে, বিএনপির নেতাদের অনেকেই একাত্তরের গণহত্যায় হাত রাঙিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধার তকমা-আঁটা জেনারেল জিয়ার বিএনপি তার অনুশীলিত নিরবতার মাঝে তরুণ ভোটারদের কাছে তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অবস্থান লুকানোর চেষ্টা করলেও, বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় সম্ভবত গলায় ফাঁস চড়িয়েছে বিএনপিরও।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মোট তেইশটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। নয়টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি হত্যা-গণহত্যার এবং দুটি অপহরণ-নির্যাতনের। এছাড়া আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছয়টি অভিযোগের বিষয়ে সাক্ষী হাজির না করায় সেগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। প্রমাণিত সাতটি হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ এবং ৮ নম্বর অভিযোগে।
এগুলো হচ্ছে মধ্য গহিরায় গণহত্যা (২ নং অভিযোগ), গহিরা শ্রী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা-মালিক অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যা (৩ নং অভিযোগ), চট্টগ্রামের জগৎমল্লপাড়া গ্রামে হামলা চালিয়ে বত্রিশ হিন্দু নারী-পুরুষকে গণহারে হত্যা (৪ নং অভিযোগ), সুলতানপুরে নেপাল চন্দ্র ও অপর তিনজনকে হত্যা (৫ নং অভিযোগ), ঊনসত্তরপাড়ায় প্রায় ঊনসত্তর-সত্তর জনকে হত্যা (৬ নং অভিযোগ), রাউজান পৌরসভা এলাকার সতীশ চন্দ্র পালিতকে হত্যা (৭ নং অভিযোগ) এবং চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার পুত্র শেখ আলমগীরকে হত্যার (৮ নং অভিযোগ) অভিযোগ।
সাকার নয়টি প্রমাণিত অপরাধের মধ্যে সাতটিই হত্যা এবং গণহত্যার। যে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, সেগুলোর সিংহভাগই হত্যা-গণহত্যার অভিযোগ ছিল। সাকা এতটাই ভয়ংকর এবং প্রতাপশালী যে, এই অপ্রমাণিত অভিযোগগুলোর সাক্ষীদের অনেকেই আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেছিল এবং সরকারপক্ষও তাদের আদালতে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
সরকারের সাক্ষী নিরাপত্তা আইনটি করলে হয়তো সমস্যাটি হত না। যদি সবগুলো অভিযোগে সাক্ষীরা নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে পারতেন, তাহলে হত্যা-গণহত্যার সংখ্যা সন্দেহাতীতভাবে আরও বেড়ে যেত। তারপরেও যে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন হত্যা এবং গণহত্যার প্রমাণ হয়েছে, তাতেও বিশ্বের কোনো যুদ্ধাপরাধী এককভাবে এতগুলো হত্যাযজ্ঞের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন বলে শোনা যায়নি। সে ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সাকাচৌ বিশ্বের তাবৎ যুদ্ধাপরাধীদের তালিকার শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছেন।
এই রায় হওয়ার পূর্বে সাকা চৌধুরীর পরিচয় যতটা না যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ছিল, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ছিল তার বিশেষ ধরনের নোংরা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যে। বাংলাদেশের একজন নিয়মিত রাজনীতিবিদ হিসেবে এই সাকাচৌ যত ঘটনা ঘটিয়েছেন এবং সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন, তা বিশ্বের বুকে বিরল।
তার নোংরামির তুলনা তিনি নিজেই। যিনি সংসদ, পরিবার-পরিজন, সভা-সমিতি, আদালত এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে অসভ্য আচরণ করেননি। বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সর্বোচ্চ আইনসভা জাতীয় সংসদের মতো জায়গাও তার অতিকুৎসিত কথাবার্তায় কলুষিত হয়েছে শতবার।
তিনি নিজেকে ছাড়া পৃথিবীর অন্য কাউকে কোনোদিন মনুষ্যকূল হিসেবে বিবেচনা করেছেন বলে শোনা যায়নি। কেউ তাকে সম্মান করে বলে শুনিনি; এমনকি নিজ দলের মধ্যেও তিনি ঘৃণ্য। কিন্তু সেটা শুধুই ভিতরে ভিতরে। তাকে ভয় পায় সবাই; সমীহ যতটুকু করে, তা ভয় থেকেই করে
তার নোংরামির হাত থেকে স্বদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রক্ষা পাননি। অর্থাৎ এক কথায় তিনি একজন ভয়ংকর সাইকোপ্যাথ ধরনের লোক এবং ঠাণ্ডা মাথার খুনী। আদালতের রায়ের আলোকে সে কথাই এখন সর্বোচ্চারণ করার সুযোগ করে দিয়েছে। এই ধরনের ব্যক্তিরা যখন বাংলাদেশের আইনপ্রণেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন যুগের পর যুগ, বাংলাদেশ শুধুই রক্তাক্ত হয়েছে।
সাকার ট্রাইব্যুনালের প্রতিটা দিনই ছিল চমকপ্রদ। তিনি ট্রাইব্যুনালকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যা দেখলে এটাকে হাসির রঙ্গমঞ্চ ছাড়া অন্যকিছুই ভাবা সম্ভব হত না কারও কাছে। অনেক সাংবাদিক বন্ধুর বর্ণনায় শুনেছি, সাকাচৌ মৃত্যুদণ্ড পরোয়া করতেন না বলে অনেকবার আদালতকে বলেছেন।
আদালত চলাকালে স্বভাবসুলভ গোয়ার্তুমি ছাড়াও বিচারকাজ ব্যাহত করতে হেন কাজ নেই যা তিনি প্রতিদিন করতেন না। তিনি হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো অহেতুক আদালতকক্ষে চিৎকার-চেঁচামেচি করতেন। কখনও বিকট অট্টহাসিতে কাঁপিয়ে তুলতেন আদালত কক্ষ। খোদ মাননীয় বিচারপতিদের ধমক দেওয়া থেকে শুরু করে প্রসিকিউটরদের অশ্লীল ভাষায় কথা বলা ছিল তার দৈনন্দিন ব্যাপার। প্রসিকিউটরদের তিনি বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দিতেন অনবরত।
শুধুমাত্র তার অশালীন কথাবার্তাই জাতীয় দৈনিকগুলোর শিরোনাম হয়েছে অনেকবার। এমনকি যে আইনে তার বিচার হচ্ছে, সেই ১৯৭৩ সালের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের রচয়িতা হিসেবেও তিনি নিজেকে দাবি করেছেন আদালতে।
সাকাচৌ হাজারটা মিথ্যের আশ্রয় নিয়েও তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো থেকে রেহাই পাননি। ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ এবং নির্ভীক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজসহ অন্যান্য প্রসিকিউটরদের অনবদ্য প্রচেষ্টা এবং দক্ষতার কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন অপরাজেয় সাকাচৌ।
গত চল্লিশ বছর ধরে একাত্তরের ভুক্তভোগীরা, মুক্তিযুদ্ধের নিরলস গবেষকরা যা জানতেন এবং এতগুলো বছর যা লেখালেখি করেছেন, ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সাকাচৌ নিজেকে পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে নিজেকে সকল আইনের উর্ধ্বে মনে করতেন প্রচণ্ড দাম্ভিকতা ভরে।
ট্রাইব্যুনালে প্রথম দিন থেকে তিনি যেভাবে উচ্চ আদালতকে উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছেন, যেভাবে তিনি সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন, তাতে শুধু তিনি নিজেকে একজন নিকৃষ্টমানের অপরাধী হিসেবেই প্রমাণিত করেছেন। যে ব্যক্তির অপরাধ সম্পর্কে ন্যূনতম বোধই নেই, সে যে কোনো ভয়ংকর অপরাধই করতে পারে; একাত্তরে তিনি তাই করেছেন, যা আদালতের রায়েই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
রায় পাঠের সময় সাকা চৌধুরী হাসছিলেন। সাকাচৌর ছেলে হুম্মান কাদের চৌধুরীসহ আদালতে উপস্থিত যুদ্ধাপরাধী পরিবারটি ফাঁসির রায় পাঠকালে হাসছিল, এটি বিস্ময়কর! এই হাসির উৎসস্থল খালেদা জিয়ার বিএনপি। অনেকের মতো সাকাচৌও ভাবছেন যে, বিএনপির ক্ষমতায় আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই ভাবনাটি সাকা ও পুত্র হুকা চৌধুরীকে হাসাচ্ছে।
গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোতে বিএনপির ভূমিধস বিজয়ে জামায়াত ও বিএনপির সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মনে এই বিশ্বাসটি এনে দিয়েছে। তাদের নির্লজ্জ হাসি, দল ক্ষমতায় গেলে ছাড়া পাবার ব্যাপারে প্রত্যয়ের কথারই সাক্ষ্য দেয়।
বিএনপিকে রায়ের দিন একেবারেই চুপ থাকতে দেখা গেলেও, রায়ের পরের দিন দলটির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয় যে, সাকাচৌ 'সুবিচার পাননি।' বিএনপির এই অবস্থান খুবই স্বাভাবিক। তবে এতদিন জঙ্গী-সঙ্গী জামায়াত ইসলামের জন্য যেভাবে উদ্ধত সংলাপ এবং বক্তব্য দিতে দেখা গিয়েছে, সাকার ব্যাপারে বিএনপি ছিল বেশ চুপচাপ।
এতে একটা বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট যে, এতদিন শুধু জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল বলা হলেও, সেই একই অভিযোগে খোদ বিএনপিকেও দায়ী করা যায়– তা হয়তো দলটির হিসেবের ভিতরে ছিল না। বিশেষ করে নির্বাচনের ঠিক পূর্বমূহূর্তে। আর এই অভিযোগটি দলটিকে যে বেশ ভোগাবে, তা না বোঝার কোনো কারণও নাই।
এ ক্ষেত্রেও সরলীকরণটা এভাবে হতে পারে যে, বিএনপি শুধু একটি যুদ্ধাপরাধী দলকে সমর্থনই করছে না, সেই সঙ্গে নিজ দলেও যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে দুধ-কলায় লালন-পালন করছে। সে ক্ষেত্রে যদি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপিকেও নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়, তাহলে কি তা অযৌক্তিক হবে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপ তথা সারাবিশ্বে এভাবেই নাৎসিদের এবং নাৎসিবেষ্টিত দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, যা বর্তমানেও চলমান।
সাকা চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ মানুষ আনন্দ মিছিল করেছে। তারা ভাবতেই পারেনি চট্টগ্রামের যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী পরিবারের কারও ফাঁসির রায় হতে পারে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে বিয়াল্লিশ বছর লেগে যাওয়ায় বাংলাদেশে 'বিচারহীনতার সংস্কৃতি'-র যে প্রতিষ্ঠা লাভ হয়েছিল, সে ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে স্বজন-হারানো মানুষের পক্ষে এখন বিশ্বাস করা খুবই কঠিন যে, এই রায় কার্যকর হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই রায় অতি দ্রুত কার্যকর করা জরুরি।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের রায় দ্রুত কার্যকর করা ছাড়াও সরকারকে এখনই সাকাচৌর মামলার সাক্ষীসহ অন্যান্য মামলার সাক্ষীদেরও সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং সংবিধানের ৪৯ ধারার সংশোধন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দণ্ডের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমালাভের সুযোগ বাতিল করতে হবে।
এছাড়াও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত ইসলামীসহ এর দোসর দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, সাংবিধানিকভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেও নিষিদ্ধ করতে হবে।
আজকের সামগ্রিক সামাজিক ব্যবস্থায় বিচারহীনতার যে অপসংস্কৃতি প্রবাহমান, সেই বিষবৃক্ষের শেকড় প্রোথিত হয়েছিল জেনারেল জিয়া ও এরশাদের হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধে স্বজন-হারানো পরিবারগুলো দেখেছে 'হত্যা করে, ধর্ষণ করে' অপরাধীরা পুরষ্কৃত হয়েছে। অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হয়, এই চিরন্তন সত্যটি আমরা সমাজের মননে প্রোথিত করতে ব্যর্থ হয়েছি।
চট্টগ্রামে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গুলিতে নিহতদের স্বজনরা এতদিন জেনে এসেছেন, 'সত্যের চেয়ে সাকার ক্ষমতা বেশি।' কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত অসাধারণ বিজ্ঞতা এবং সাহসিকতার সঙ্গে শুধু অপরাধগুলোই নয়; সেই সঙ্গে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন, 'সত্যের চেয়ে সাকার ক্ষমতা বেশি নয়।'