Published : 11 May 2017, 07:02 PM
চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত বেশ টেনশনেই ছিল শাহবাগ এবং খানিকটা বিভ্রান্তিতে ভুগছিল গোটা বাংলাদেশ। কারণ মানুষটার নাম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, এই বাংলাদেশের সবচেয়ে উদ্ধত (বেয়াদব কথাটা যদিও জুতসই) রাজনীতিবিদ এবং যুদ্ধাপরাধী।
তার আত্মবিশ্বাসের মাত্রা এতই যে ট্রাইব্যুনালে বসেই সে চুটকি কাটে। গাড়িতে ওঠার আগে ঘড়ি দেখিয়ে পোজ দেয়, বার্তাটা হচ্ছে সময় বেশি নেই, এই সরকারের মেয়াদ ফুরোলেই সব যুদ্ধাপরাধীরা মুক্তি পেয়ে যাবে, তারপর সে দেখে নেবে। বিভ্রান্তি এবং টেনশনের কারণ শুধু ব্যক্তি সাকাই নয়, তার পক্ষে কিছু কৌশলজনিত অপপ্রচারও।
৩০ সেপ্টেম্বর সকালে হঠাৎই অনলাইনে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে একটি ডকুমেন্ট ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং দাবি করা হয় সাকা চৌধুরীর রায় আগেই নাকি লিখে দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়, আর সেটাই পাঠ করা হয়েছে। আশ্চর্যজনক হচ্ছে, সাকা নিজেই ট্রাইব্যুনালে এর উদ্ধৃতি দিয়েছে। একই কথা বলেছে তার ছেলেও, ঢাকার কথ্য উচ্চারণে বলেছে: ''মজা দেখতে আইছি, রায় আগেই জানি, অনলাইনে দেইখা আসছি।''
বুধবার চট্টগ্রামে হরতাল ডাকার পক্ষে এই অজুহাতই দিয়েছে সেখানকার বিএনপি।
রায় আগেই লেখা হয়ে গেছে আর সেটা পাঠ করা হয়েছে এ রকম একটা চক্রান্তমূলক প্রচারণার নেপথ্যে যে দলিল সেটা প্রকাশ করেছে 'জাস্টিস কনসার্ন ডট অর্গ' নামের একটা ব্লগ সাইটে (justiceconcern.org) আর দলিলটির লিংক:
দাবি করা হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের এক টাইপিস্টের কম্পিউটারে রাখা ফোল্ডার থেকে এই ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে।
সম্পুরক প্রশ্ন উঠতেই পারে আলম কিংবা তার কম্পিউটারে একসেস পাওয়ার তরিকা নিয়ে। কারণ এটি আইন মন্ত্রণালয়! সেখানে রাত-বিরেতে ঢুকে যে কারও কম্পিউটার থেকে ফাইল ফোল্ডার হাপিশ করে দেওয়া সম্ভব– সেটা এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিশ্চিতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
কিন্তু মানুষকে গেলাতে এবং যারা গিলবে তাদের জন্য সেটা কোনো ভাবনার বিষয়ই নয়। কারণ যে দেশে সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে দাবি করে রায়ট লাগিয়ে দেওয়া যায়, সেদেশে সবই সম্ভব।
তবে খানিকটা কমন সেন্স ব্যবহার করেই এই দু' নাম্বারিটির উম্মোচন সম্ভব। যেমনটি করেছে অয়ন মুক্তাদির নামে এক ফেসবুক ইউজার। তার দেখানো পদ্ধতিতে ফাইলটা ডাউনলোড করলাম, প্রপারটিজে ঢুকলাম। উন্মোচিত হল নিচের তথ্যগুলো–
১.
ফাইলটা তৈরি হয়েছে ২৩ মে ২০১৩, রাত ১২টা ১ মিনিটে! অ্রর্থাৎ চারমাস আগে শুরু হয়েছে এই ফাইলে তথ্য ঢোকানোর কাজ। আর যেই সময় দেখানো হয়েছে তেমন গভীর রাতে কোনো মন্ত্রণালয়ে কাজ হওয়ার কথা নয়, সরকারি অফিস বলে কথা। তারপরও কথিত আলম যদি স্পেশাল ডিউটি করে থাকে সেটা রোস্টার দেখলেই বের হয়ে আসবে।
২.
মোট ২৫৮৮ মিনিট ধরে এই ফাইল এডিট করা হয়েছে, অর্থাৎ এই সময়কাল ধরে এতে বিভিন্ন তথ্য ঢোকানো হয়েছে। পড়লে মনে হয় এর আগে ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন রায়ের সম্পূরক অংশ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে শুনানির সময়কার তথ্যাদি অনুযায়ী।
৩.
ফাইলটা সর্বশেষ সেভ করেছে যে ইউজার তার নাম ''ম্যাকবুক প্রো ১৩" (অনেক ক্ষেত্রে আসল ইউজারের বদলে পিসির জেনেরিক নাম ইউজ করা হয় এই দেশে)। প্রশ্ন জাগতেই পারে, সরকারি অফিসগুলোতে টাইপিস্টদের জন্য কবে থেকে ম্যাকবুক প্রো বরাদ্দ করা হয়েছে!
৪.
এছাড়াও দেখা যাচ্ছে যে ফাইলের অথর বা লেখকের (যার কম্পিউটার থেকে ফাইলটি তৈরি হয়েছে) নাম 'আদি'– 'আলম' নয়– যেমনটি বলা হয়েছে খবরসূত্রে। আর তার অরগানাইজেশন বা কোম্পানির নাম হচ্ছে 'অ্যারাবিয়ান হর্স'!
আইন মন্ত্রণালায় কবে থেকে 'অ্যারাবিয়ান হর্স' হয়ে গেল এটাও একটা লাখ টাকার প্রশ্ন বটেঁ!
ঘাঁটাঘাঁটি করে বের হয়েছে আরও কিছু তথ্য। যেমন জাস্টিস কনসার্নের ডোমেইনটি রেজিস্টার করা হয়েছে, সেটার তথ্য মিলেছে এই লিংকে: ভুয়া নামে ডোমেইন (ওয়েবসাইটের নাম) রেজিস্ট্রেশন করা।
বিস্তারিত এখানে :
নিবন্ধনকারী যে ফোন নাম্বারটি ব্যবহার করেছেন সেটি যুক্তরাজ্যের, নাম্বার: +44.7872183426
দেখা যাচ্ছে অন্য একটা ডোমেইনের ক্ষেত্রে এই নাম্বারটি ব্যবহার করা হয়েছে, আর সেটি বাংলাদেশের আইনজীবীদের একটি সংস্থা। এর নাম বাংলাদেশ সোসাইটি ফর লইয়ারস, ওয়েবসাইটের ঠিকানা:
তো এইভাবেই প্রতারণামূলকভাবে এই ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। যারা অনলাইনে নিয়মিত, তারা 'বাঁশের কেল্লা' নামের একটা ফেসবুক পেইজের কথা জানেন যেখান থেকে প্রতিদিনই বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের কল্পিত হত্যাকাণ্ডের গল্প এদেরই তৈরি। কাবা শরীফের গিলাফ নিয়েও তারা গল্প বানিয়েছিল যা ছাপা হয়েছিল তাদের অফলাইন সহযোগী 'আমার দেশ' পত্রিকায়।
আশার কথা তরুণ প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরীদের মতো সহজেই বিভ্রান্ত হওয়ার নয়। তারা মগজ খাটিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ঝামেলাটা কোথায়।
যাহোক, প্রত্যাশিত রায়ই মিলেছে। গণজাগরণ মঞ্চের আহবায়ক ইমরান এইচ সরকারকে নিজের ফাঁসির দাবি করতে হয়নি সরকারের কাছে। যথারীতি আনন্দে উদ্বেল শাহবাগ।
তবে খেলাটা শেষ হয়নি এখনও। জামায়াত যেখানে আগের ছয়টি রায়েই সারাদেশে সহিংস হরতাল ডেকেছে, সেখানে বিএনপি তারেক জিয়ার পর তাদের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে ফাঁসির রায় বিনা ওজরে ছেড়ে দেবে সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। আর সেজন্য তারা ব্যবহার করতে চাইছে এই দলিলটিই।
সাকা চৌধুরী কেমন মানুষ তা আমার সামনাসামনি দেখার অভিজ্ঞতা আছে। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পূর্বদিকের গেটে লিটন নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় সাকা চৌধুরী তার পাজেরো থেকে শটগান বের করে দেন তার এক ক্যাডারকে যে গুলিটি করে।
মাত্র ২০ হাত পেছন থেকে দৃশ্যটা দেখেছি আমি। দেখেছি নিটোলের গুলি খাওয়া লাশ যে ছিল তারই অনুগত ক্যাডার। সাকার সঙ্গে বেয়াদবি করেছে এই অপরাধে আরেক ক্যাডার বিধান বড়ুয়া তাকে গুলি করে মারে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সাকা গুলিবিদ্ধ নিটোলকে অনেকক্ষণ লাথি মারে।
চকবাজারে পাহাড়ের ওপর তার 'গুডহিল হাউজ' রীতিমতো এক আতঙ্কের নাম সেই নব্বই দশকে। সিনেমার মতো সেখানে হাত-পা বেঁধে অত্যাচারের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড টরচার সেল রয়েছে। নব্বইয়ের এই সাকা একাত্তরে কী ছিল ভাবলেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়।
সাকা এবং তার পরিবার দাবি করেছে রায় আগে লেখা হয়েছে। দাবি করেছে বিএনপি। হ্যাঁ, আসলেই রায় আগে লেখা হয়েছিল। সেই ১৯৭২ সালেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার সময়ই লেখা হয়েছিল তার রায়।
আজ স্রেফ ঘোষিত হল মাত্র।
অমি রহমান পিয়াল : ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট।