Published : 20 Sep 2013, 04:06 PM
সম্প্রতি পাকিস্তানের লাহোর শহরের অদূরে এক পিতা তার দ্বিতীয় কন্যার জন্মের পর প্রথম কন্যাটিকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। শিশুটির অপরাধ সে কন্যাশিশু। এই পিতার নাম উমর জাইব, পেশায় রিক্সাচালক। আর তার স্ত্রীর নাম সুমেরা। স্বামীর এমন অকাণ্ড দেখে চিৎকার করে সুমেরা তার কন্যাকে রক্ষা করতে গেলে নিষ্ঠুর উমর তাকে বলপ্রয়োগে বাধা দেয়। অসহায় মা সুমেরা নদীর জলে প্রিয় সন্তান জয়নাবের ডুবে যাওয়ার দৃশ্য সচক্ষে দেখে প্রায় পাগল হয়ে যান।
খবরটি বিবিসি'র কল্যাণে ব্যাপক প্রচারের ফলে বিশ্ববিবেক দারুণভাবে আহত হয়েছে। এমন হৃদয়বিদারক ও নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড আধুনিক সভ্যতার যুগেও অনুষ্ঠিত হতে পারে ভাবতে বিস্ময় বোধ হয়। নিজেদের মনকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা হয়, তাহলে কি সত্যিই মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনের লক্ষ্যে সুশীল সমাজের মানুষেরা কোনো অবদান রাখতে পারেননি?
পাকিস্তানের উমর জাইবের মানসিকতা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। চীন এবং ভারতে এ রকম ঘটনার সংখ্যা অগণিত। জাতিসংঘের এক হিসেবে দেখা যায়, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ২০ কোটি কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলা হচ্ছে আঁতুড়ঘরে। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে অনেকেই জানতে পারেন গর্ভে অবস্থানকারী সন্তানটি পুত্র না কন্যা। বাংলাদেশে ও ভারতে আজকাল চিকিৎসকরা নৈতিকতার কারণে এবং কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলা হতে পারে– এই ভয়ে তথ্যটি জানাতে চান না।
এছাড়াও ইউনিসেফসহ দাতা সংস্থাগুলো লিঙ্গ নির্ধারণকে সর্বত্র নিরুৎসাহিত করে। কিন্তু মানুষ এক্স ও ওয়াই হিসেব করে জেনে নেয় গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ এবং শুরু হয় তাদের ভাবনা। যতই দিন যাচ্ছে বিষয়টি অধিক জটিল হচ্ছে নিঃসন্দেহে।
কেন এমনটি হচ্ছে? কন্যাসন্তানের প্রতি এত অবজ্ঞা, অবহেলা এবং নির্মম আচরণ দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে? কী করলে এর প্রতিকার হবে বোঝাই কঠিন হয়ে উঠেছে। গবেষণা চলছে, তবে দেশ-কাল-পাত্রভেদে এবং অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে প্রচুর ব্যবধান হচ্ছে ভাবনায়, চিন্তায় ও চেতনায়।
নারীদের চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সংরক্ষিত কোটা রয়েছে। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। পূর্ণ বেতনে মাতৃত্বকালীন ৬ মাস ছুটি সরকার অনুমোদন করেছে। প্রায় সকল ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহানুভুতির সঙ্গে নারীদের কর্মে নিয়োগ এবং কর্মস্থলকে পরিবেশবান্ধব রাখার লক্ষ্যে নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করেছে সরকার। কিন্তু তারপরও একটি জরিপে দেখা যায়, প্রতিবছর প্রায় ৩০ লাখ কন্যাশিশু অবজ্ঞা ও নির্মমতার শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
বাংলাদেশে ১৪২০ বাংলা সনের বৈশাখের প্রথম দিনে মানবাধিকার কর্মীদের একটি সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি মিছিল বের করে কন্যাশিশুদের রক্ষা এবং যৌতুকবিরোধী আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য দাবি জানায়। তাদের অভিযোগ, ১৯৮০ সালের ২০ মে মাসে প্রণীত 'যৌতুক প্রতিরোধ আইন' এবং ১৯৮২ ও ১৯৮৬ সালে এর সংশোধনী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না সঠিকভাবে।
পক্ষান্তরে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি-অক্টোবর সময়কালে বাংলাদেশে ৩৪১৩ টি যৌতুকের কারণে নির্যাতনের মামলা হয়েছে। একটিরও সুবিচার পাননি অভিযোগকারীরা। মামলা দেবার কারণে এসিড নিক্ষেপ, রাস্তাঘাটে উপদ্রব, গালাগালি এবং মারধরের ঘটনা ঘটেছে প্রচুর। আইন প্রযোগকারী সংস্থা অথবা সমাজের বিশিষ্টজন বা রাজনৈতিক কর্মীরা সত্য ও ন্যায়ের খাতিরে এবং নিগৃহীতদের সুরক্ষার প্রয়োজনে পাশে যাননি, তাদের সমর্থন দেননি, কারণ নির্যাতনকারী সাধারণত অনেক ক্ষমতাবান বা দলীয় নেতা।
কন্যাশিশুদের প্রতি অবহেলার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিবাহকালে যৌতুকদানের দাবি, আর্থিকভাবে কন্যাসন্তানের উপার্জনহীনতা, উঠতি বয়সের প্রাক্কালে যুবকদের কটাক্ষ, সামাজিক উপদ্রব ইত্যাদি।
অনেক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে তাই কন্যাসন্তান অনভিপ্রেত। বাংলাদেশে হিন্দুদের বাড়িতে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলে অনেক অনিচ্ছাসত্বেও মাত্র তিনবার উলুধ্বনি দেয়। পক্ষান্তরে, পুত্রসন্তান হলে বাড়ির সব মেয়ে একত্রিত হয়ে উচ্চস্বরে পাঁচবার উলুধ্বনি দেয় মহানন্দে। এভাবে জন্ম থেকেই কন্যাসন্তানেরা বঞ্চনার শিকার।
সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনে কন্যাসন্তানদের অধিকার নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেন। বিশেষ করে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে কন্যাসন্তানেরা বঞ্চিত হচ্ছে পদে পদে। ভারতে তাই পৌত্রিক সম্পত্তিতে কন্যা ও পুত্রসন্তানের সমঅধিকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু আইনের পরিবর্তন কন্যাসন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি, বরং বিহার বা উত্তর প্রদেশে কন্যাকে আঁতুড়ঘরে মেরে ফেলা হচ্ছে প্রায় প্রতিনিয়ত। এ সংখ্যা শুধু বাড়ছে, কমছে না।
অবুঝ কন্যা জয়নাবকে তার পিতা উমর কর্তৃক নদীতে ছুঁড়ে ফেলা শুধু পাকিস্তানের একটি বিরল ঘটনা নয়। এ উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র এমনটা ঘটছে অহরহ। কোনো প্রতিবিধান নেই। প্রতিকারের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ শুধু কথার কথা, মঞ্চকাপাঁনো বুলি বা নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার সোপান।
কন্যাশিশুদের অধিকার বা সমাজে তাদের মর্যাদা সংরক্ষণের লক্ষ্যে আরও অনেক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে, প্রচুর সামাজিক ও আর্থিক পদক্ষেপ নিতে হবে। কন্যাসন্তানদের সমঅধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ঘরে ঘরে, সমাজের প্রতিটি স্তরে। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন, পাঠ্যপুস্তকে সঠিকভাবে বক্তব্য তুলে ধরে জনগণের মানসিকতার আমূল পরির্বতন সাধন। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কন্যাসন্তানদের ভূমিকা, প্রশাসনে তাদের দক্ষতা, সমাজজীবনে নারীদের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে হবে অধিকতর প্রত্যয়ের সঙ্গে।
দুএকটি বিছিন্ন উদাহরণ নয়, পরিবর্তন করতে হবে গণমানুষের চিন্তায় ও চেতনায় সর্বত্র সমানভাবে। যে কোনো মূল্যে কন্যাকে অবজ্ঞা বা তাদের প্রতি নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। আইনের প্রয়োগে কঠোর করতে হবে সরকারকে এবং প্রতিরোধে সোচ্চার হতে হবে সমাজের সকল স্তরের জনগণকে।
অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে সরকার এবং জনগণকে এ ব্যাপারে ঐক্যমতের ভিত্তিতে অগ্রগামী হতে হবে এবং সরকারকে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে সময়সীমা নির্ধারণ করে জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে, কখন কীভাবে এ সামাজিক ব্যাধি বিতাড়ন করবে দেশ থেকে তা নিয়ে।
পাশাপাশি বলব, আগামী নির্বাচনে প্রত্যেক দলকে তাদের মেনিফেস্টোতে ভোটারদের কাছে এ ব্যাপারে সুনিদিষ্ট ঘোষণা দিতে হবে যে, কন্যাসন্তানের প্রতি অবজ্ঞা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে দলগুলো এর বাস্তবায়ন সুনিশ্চিত করবে– এ জাতীয় অঙ্গীকার দেশবাসী প্রত্যাশা করে এখনই।
ধীরাজ কুমার নাথ : প্রাক্তন সচিব ্ও তত্ত্বাবধয় সরকারের সাবেক উপদেষ্টা