Published : 12 Sep 2013, 01:47 PM
'অস্তিত্ব সংকটে দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলো'– দিনে দিনে কথাটির গায়ে ধুলো জমতে শুরু করলেও এ ব্যাপারে বাম দলগুলোর খুব যে একটা মাথাব্যথা আছে, তা ঠিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
সাম্প্রতিককালে বাম দলগুলোর অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং স্ববিরোধী-হঠকারী কার্যকলাপ দেখলে কথাটির সত্যতা আরও দৃঢ এবং স্পষ্ট হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, বাংলাদেশের একসময়কার সেই তুখোড় বাম দলগুলোর আজ এ বেহাল দশা কেন? কেন তারা বিভিন্ন হঠকারী সিদ্ধান্তের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না? দুর্বল বামদের এ অসহায়ত্বে কারা লাভবান হচ্ছে এবং জাতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব কীভাবে পড়ছে? এ দায়ভার তারা কীভাবে নেবেন?
বামধারার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনসমর্থন দিন দিনই কমছে। দলগুলোর নিজস্ব যে আদর্শ বা লক্ষ্য, তা পূরণেও রয়েছে সীমাহীন ব্যর্থতা। দেশে প্রায় বিশটির মতো বাম রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকলেও, এর তিনভাগের একভাগ হয়তো কিছুটা সক্রিয়। বাকিরা প্রায় নামসর্বস্ব। দেশের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনী সমীক্ষণ থেকে দেখা যায় যে, ১৫ বাম দলের সর্বমোট ২৭৪ আসনের বিপরীতে জয় পেয়েছিল মাত্র পাঁচটিতে এবং এই পাঁচজনই ছিলেন আওয়ামী জোটভুক্ত।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাসদ (খলীকুজ্জমান) ৫৭, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ৩৯, ন্যাপ ১৪, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন ১১, জাসদ (ইনু) ৬, গণতন্ত্রী পার্টি ৫, ওয়ার্কার্স পার্টি ৫, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ৫, সাম্যবাদী দল (এমএল) ১, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল ২১, গণফোরাম ৪৫, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ৪৪, গণফ্রন্ট ১৪, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ ৫ এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি ২ আসনে নির্বাচনে অংশ নেয়।
নির্বাচনে ১৫ বাম রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও মহাজোটের হয়ে আসন পেয়েছিল মাত্র দুটি রাজনৈতিক দল। এদের মধ্যে জাসদ ৩ ও ওয়ার্কার্স পার্টি মিলে প্রাপ্ত মোট আসন সংখ্যা ৫। দেশের বৃহৎ বাম দল কম্যুনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি) এবং বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) মিলে মোট প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ (০.৬%), যা ষোল কোটি মানুষের দেশে ভোটের হিসেবে একেবারেই নগণ্য।
২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফল ছিল আরও শোচনীয়। অংশগ্রহণকারী বাম দলগুলোর প্রার্থীসংখ্যা ছিল ২৩৭ এবং তারা সবাই-ই হেরেছিলেন। সে সঙ্গে প্রায় সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। জামানত টিকিয়ে রাখতে প্রার্থীদের স্ব-স্ব আসনে ন্যূনতম যে আট শতাংশ ভোট পেতে হয়, সে লক্ষ্য অর্জনেও দলগুলো তখন ব্যর্থ হয়েছিল।
কেন এ বিপর্যয়? বোদ্ধাদের আলোচনার টেবিলে বেশিরভাগ সময়ই বলতে শোনা যায় যে, "ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা হচ্ছে, বামরা ইতিহাস থেকে কখনও-ই শিক্ষা নেননি।'' কী সেই শিক্ষা যা বামরা শেখেননি?
বাংলাদেশের বাম দলগুলো এবং এদের নবীন শিক্ষানবীশদের প্রায়শই দেখা যায় তারা মাও, মার্কস বা লেনিনীয় তত্ব থেকে একজনকে এমনভাবে বুঝিয়ে দেবেন যে তার মনে হবে শোষকের হাত থেকে শোষিতের রক্ষা পাওয়ার এর চেয়ে উত্তম পন্থা আর নেই এবং এ রক্ষার একচ্ছত্র অধিকর্তা শুধু তারাই।
কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে বামরা শোষিতের পক্ষে এমন কোনো আন্দোলনের অগ্রভাগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কি যা উল্লেখযোগ্য হিসেবে বর্ণিত হতে পারে? বরং কোনো কোনো আন্দোলনের শুরুতে না থেকেও শেষের দিকে জয়লাভের চুলচেরা হিসেব কষে শুধুই লভ্যাংশ আদায়ের হুড়োহুড়িতে বামদের দেখা গিয়েছে অনেকবার। এভাবেই ক্ষণিকের আন্দোলনের হিসেব-নিকেশ হয়েছে, কিন্তু ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি বামদের দ্বারা। ফলশ্রুতিতে শুধুই জনবিচ্ছিন্ন হয়েছেন তারা।
এছাড়াও দলগুলোর নিজেদের মধ্যেকার মতের অমিল, দলীয় এবং ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্ব, আদর্শের বাইরে গিয়ে চূড়ান্ত হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলোও এসব দলের শক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর করতে সহায়ক হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের সাবেক বামফ্রন্ট সরকারের শরিক দল রেভ্যুলুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি (আরএসপি) ভারতভাগের বেশ আগে থেকেই সর্বভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির বিরোধিতা করে এসেছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ভারতের বামপন্থীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং রেষারেষি সর্বভারতীয় বাম আন্দোলনকে অনেকাংশে দুর্বল করেছিল।
এ দ্বন্দ্বের জের ধরেই ভারতভাগের পর শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই) ভেঙে একটি অংশ কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্কসবাদী (সিপিআইএম) নামে জন্মলাভ করে। তখন শুধুমাত্র সিপিআইকে বিরোধিতা করার জন্য আরএসপি এ নবজন্মা সিপিআইএম-এর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বাম দলগুলোর ভিতরেও দেখা গিয়েছে এ ধরনের ভাঙাগড়ার প্রবণতা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ভাঙাগড়ার কেন্দ্রবিন্দু যতটা না ছিল শোষিতের পক্ষে আদর্শিক দ্বন্দ্ব, তার চেয়ে বহুলাংশে ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্ব।
গত নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের মহাজোট করার ব্যাপারে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সাম্যবাদী দল, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণতন্ত্রী পার্টিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের জোর আপত্তি ছিল। নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বাসদ, কৃষক শ্রমিক মজদুর পার্টি, গণফোরাম, সিপিবিসহ আরও ৪ রাজনৈতিক দল।
দলের অভ্যন্তরীণ মতভেদের কারণে রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি কয়েক দফা ভাঙনের মুখেও পড়েছিল। হায়দার আকবর খান রনোর নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি ভেঙে আলাদা দল গঠন করলেও এর ধারাবাহিকতা রক্ষা সম্ভব হয়নি বলে পরবর্তীতে তিনিসহ আরও দু'নেতা সিপিবিতে যোগ দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রেও সংখ্যার দিক বিবেচনা করলে মাত্র তিনজনের দলবদল ব্যক্তিদ্বন্দ্বের বিষয়টিতেই ইঙ্গিত করে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ইনু-রব নামে দু'ধারায় বিভক্ত। মুমূর্ষুপ্রায় একসময়ের ডাকসাইটে নেতা মোজাফফর আহমেদের ন্যাপ। সাম্যবাদী দলের নামমাত্র নেতা দিলীপ বড়ুয়া এখন মন্ত্রী হলেও, দলীয় অস্তিত্ব শুধুই কাগুজে। শোনা যায়, দিলীপ বড়ুয়ার পার্টির ভিতরেও পাওয়া না-পাওয়ার অসন্তোষ চলছে দীর্ঘদিন ধরেই।
গণতন্ত্রী পার্টি নামে মোহাম্মদ আফজালের নেতৃত্বে নাম-কা-ওয়াস্তে চলছে আরেক বাম দল।
প্রতিটা বাম দলের অভ্যন্তরে আলোচনার মূল এজেন্ডাই সম্ভবত শুধু কীভাবে টিকে থাকা যায় সেটি। অর্থাৎ উল্লেখযোগ্য বাম দলগুলোর আর্থিক সংকট, জনসমর্থন এবং অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদ্বন্দ্বগুলো এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, দলগুলোকে সঞ্চালনের সঠিক পন্থাই হয়তো আজ সবার আলোচ্য বিষয়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য বাম দলগুলো যারা আছে, তারা আজ বেশিরভাগই 'সংবাদ বিজ্ঞপ্তি'-সর্বস্ব দলেই পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে সংবাদপত্রে দেওয়া দায়সারা গোছের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মধ্যেই তাদের কার্যক্রম যেন সীমাবদ্ধ! যতটা না তাদের রাজপথে থাকার কথা, তার চেয়ে হলভর্তি কিছু দর্শকের সুধী সমাবেশে কথা বলতেই যেন তারা বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেন। ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর মতো কথা বলার পরিসরও যেন তাদের দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। যদি বলা হয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের বিচরণ এখন শুধু সুধী-সমাজেই সীমাবদ্ধ; তাহলে কি খুব অত্যুক্তি করা হবে?
গত জোট সরকারের আমলে বাম দলগুলোর ঘরে বসে 'দেখি কী হয়' নীতির কথা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। সে সময় এমনও হয়েছে যে, বাম নেতারা নামেমাত্র হরতালের ডাক দিয়ে যার যার ঘরে বসে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা উপভোগ করেছেন! সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে বামদের তখন জোট সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার কথাও রাজনৈতিক চায়ের আড্ডায় শোনা গিয়েছে বহুবার।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যেখানে দরিদ্র এবং খেটে খাওয়া মজুর– গার্মেন্টসগুলোতে যেখানে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করে বিভিন্ন অসম শর্তের বেড়াজালে– সে দেশে বামদের রাজনীতি করবার কোনো সুযোগ নেই এটা কী করে হয়? বাম নেতাদের আদর্শগত শক্তি-সামর্থ্যের কথা অনেকটা রূপকথার গল্পের মতোই সর্বজনবিদিত। অথচ এ নেতারা বরাবরই দলবদলের খেলায় অন্য দলগুলোকে টপকে এগিয়ে আছেন! তাহলে এটাই কি প্রতীয়মান হয় যে, রূপকথা রূপকথাই, এর সার বলতে কিছু নেই?
সবকিছু ঠিক থাকলে কয়েক মাসের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন শুরু হবে। জয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় আসা বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের জন্য একটা বিশাল চ্যালেঞ্জের মতোই।
সরকার সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে তা হল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করে এ কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া। বিচারপ্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে সরকারকে শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, আন্তর্জাতিক অনেক চাপ এবং চক্রান্ত মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং হচ্ছে।
স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের একের পর এক চক্রান্ত এবং দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট অরাজকতার দৃষ্টান্ত এককথায় সীমাহীন। সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আদালতের সীমাহীন ভুলভ্রান্তি, অপ্রতুল লজিস্টিক সরবরাহ এবং অনভিজ্ঞতা সত্বেও, আমরা সবাই একে সাধুবাদ জানিয়েছি এবং ট্রাইব্যুনালের বাইরে থেকে এর সচলতার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে এর ক্ষমতাবৃদ্ধিতে চাপ প্রয়োগ করেছি।
জামায়াত-বিএনপির আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চক্রান্ত প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি, তাদের অপপ্রচারের জবাব দিয়েছি। এই বিচারকার্য নস্যাৎ করার জন্য বিএনপি-জামায়াত চক্র হেন কাজ নেই যা করেনি এবং তা এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু এ বিচারিক প্রক্রিয়া চলমান রাখতে এবং এটি নসাতের যে কোনো চক্রান্ত মোকাবেলা করতে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিগুলো বদ্ধপরিকর।
বাংলাদেশের বাম দলগুলোও এ বিচারপ্রক্রিয়ার শেষ দেখতে চায় এবং ঐতিহাসিকভাবে এ দাবির আন্দোলনে তাদের সম্পৃক্ততাও অনস্বীকার্য। অথচ শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতেও কোনো বাম দলকে বর্তমান সরকারের পাশে এসে সরবভাবে দাঁড়াতে দেখা যায়নি।
পক্ষান্তরে, যেটা দেখা গিয়েছে এবং এখনও যাচ্ছে তার মাজেজা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বললে অত্যুক্তি করা হবে না। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কেন এ হীনমন্যতা? সুস্থ্ রাজনীতিচর্চায় শুধু বাম দলগুলো নয়, যে কেউই সরকারের বিরোধিতা বা সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু সে বিরোধিতা এমনভাবে হওয়া উচিত নয় যা জঙ্গি মৌলবাদকে উৎসাহিত করবে বা তাদের আবার ক্ষমতায় আরোহণে সহায়তা করবে।
প্রতিবেশি দেশ ভারতের মৌলবাদী দল বিজেপি শক্তিশালী হয়ে ক্ষমতা দখল করতে পেরেছিল শুধুমাত্র কিছু স্বার্থন্বেষী বাম দল এবং বামপন্থী নেতাদের ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে আসতে না পারার কারণে।
সে সময় ভারতের সেক্যুলার ডেমোক্রেসি রক্ষার্থে এবং মৌলবাদী বিজেপিকে প্রতিহত করতে পশ্চিমবঙ্গের সর্বভারতীয় বাম নেতা জ্যোতি বসুর উদ্যোগে কংগ্রেসসহ অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর যে মোর্চা গঠনের উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন, সেখানেও রেভ্যুলুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টিসহ কিছু বাম দল প্রকাশ্যে আপত্তি জানিয়েছিল এবং 'ধনিক শ্রেণির দল কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো মোর্চা নয়' অজুহাতে তা পণ্ড করেছিল।
ফলশ্রুতিতে বিজেপিকে ক্ষমতায় আসা থেকে কেউ ঠেকাতে পারেনি এবং অসাম্প্রদায়িক ভারতের যবনিকাপাত ঠিক তখন থেকেই শুরু হয়েছিল।
২০০১ সালের নির্বাচনের পূর্বে এবং পরে জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের বামদের অনেকটা গা-ছাড়া ভাব বা নির্লিপ্ততা পার্শ্ববর্তী ভারতের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সমীকরণটা ঠিক এমনভাবেই হয়েছে যে, বাম দলগুলো যত বেশি দুর্বল হয়েছে, মৌলবাদীরা তত বেশি শক্তিশালী হয়েছে এবং দৃশ্যত এর ধারাবাহিকতা বর্তমানেও চলমান। বুর্জোয়া প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাট্টা হয়ে মৌলবাদের বিরোধিতা করা থেকে তারা সজ্ঞানে দূরে থেকে অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে মৌলবাদীদের সঙ্গে আপোষ করতে উৎসাহিত করেছে।
সাম্প্রতিককালে বামদের বিভিন্ন কার্যকলাপেই দেখা যাচ্ছে যে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসা থেকে দূরে রাখতে তারা হেন কাজ নেই যা করছে না। অথচ তারা যদি দাবি করে যে, 'আওয়ামী মহাজোটকে ক্ষমতাচ্যূত করা মানে বিএনপি-জামায়াতের মতো স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদকে ক্ষমতায় আনা'– এটা তারা বোঝেন না বা মনে করেন না– তাহলে তা হবে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে জঘন্য হঠকারিতা ও মিথ্যাচার।
সম্প্রতি ঢাকা জাতীয় প্রেস ক্লাবে 'সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের' ব্যানারে এক সেমিনারে সিপিবি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম নতুন রাষ্ট্র বানানোর হুমকি দিয়েছেন। কামাল লোহানী প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাকারী বলে বক্তব্য দিয়েছেন। মাহমুদুর রহমান মান্না আগামী নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধীদের জয়লাভের ইঙ্গিত দিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করেছেন। নাট্যকার মামুনুর রশিদ দেশের কোনো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
অর্থাৎ এখানে স্পষ্টতই আমরা যেটা দেখতে পাই যে, এ গুণীজন ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের প্রায় সবাই-ই বামধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। উনাদের সবার বক্তব্যে একটা ব্যাপার খুবই স্পষ্ট যে উনারা ব্যক্তিগত আক্রোশের জায়গা থেকেই যার যার বক্তব্য রেখেছেন। কারণ তাদের কারও বক্তব্যেই দলগত বা ব্যক্তিগতভাবে সঠিক দিকনির্দেশনামূলক কিছু ছিল না। তাদের যেন এ দেশের প্রতি কোনো দায়ভার নাই। এ সরকারের জায়গায় মৌলবাদীরা ক্ষমতায় এলেও সে ব্যাপারে যেন তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
পক্ষান্তরে, নির্বাচনের দারগোড়ায় দাঁড়িয়ে এ সরকারের বিরুদ্ধে দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলে যে মূলত বিরোধী শিবিরের জামায়াত-হেফাজত-বিএনপিকেই সমর্থন দিচ্ছেন, এটা না বোঝার কোনো কারণ তাদের নেই। এটা নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত এবং দুঃখজনক।
ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে দুঃখজনক এবং এর বিচার আমিও চাই। কিন্তু ত্বকীর বাবা রাফিউর রাব্বি সিপিবির একজন পুরনো সক্রিয় সদস্য হয়েও এ সেমিনারের এক-দু'দিন আগে রাজাকার জামায়াতি চ্যানেল 'দিগন্ত টিভি'র ব্যানার সামনে রেখে রাস্তায় মানবন্ধন করেন এবং সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এ চ্যানেলের সম্প্রচার উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য।
একজন বামপন্থী হয়েও যখন তিনি যুদ্ধাপরাধীদের টিভি চ্যানেলের জন্য স্বাধীনতার সপক্ষের সরকারকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলেন, তখন নিঃসন্দেহে তিনি ত্বকীর আত্নাকে অসম্মান করেন। রাফিউর রাব্বির সভাপতিত্বে ত্বকী মঞ্চের ব্যানারে যখন উপরের বামধারার নেতা-বুদ্ধিজীবীরা সরকারবিরোধী বক্তব্য দেন, তখন তারা নিশ্চয়ই ধরে নেন– 'আমার মতো মূর্খ আমজনতা কিছুই বোঝে না'।
বাংলাদেশকে আরেকটি পাকিস্তান-আফগানিস্তান বানানো থেকে রক্ষা করতে হবে। সে দায়ভার শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নয়, বামদেরও। এ দায়ভার এড়ালে ভবিষ্যতের ত্বকীরা কাউকে ক্ষমা করবে না। ব্যক্তিগত হীনমন্যতা আর আক্রোশ থেকে আর যাই হোক জাতীয় সমস্যার সমাধান করা যায় না। আমার অনেক বন্ধু বলেন, আওয়ামী লীগ জানে যে, তাদের ছাড়া উপায় নেই। তাই ঘুরেফিরে তাদের কাছেই আসতে হবে বা তাদেরই ভোট দিতে হবে।
আপাতদৃষ্টিতে কথাটি সত্য হলেও, সেই অপয়াবস্থা তো বামরাই তৈরি করে রেখেছেন। বাংলাদেশের মাটি থেকে স্বাধীনতাবিরোধী তথা জঙ্গি মৌলবাদ উৎখাতের জন্য চাই একটি শক্তিশালী বামমোর্চা। এ দায়বদ্ধতা বামদের বুঝতে হবে। ভারসাম্যের রাজনীতি করলে মৌলবাদের বিষাক্ত ছোবল থেকে তারাও রক্ষা পাবেন না। আর যদি সমঝোতার রাজনীতি করে টিকে থাকতে চান, তাহলে একসময় হয়তো বাম দলগুলোর চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য চলমান রাখতে এবং দেশ থেকে জঙ্গি মৌলবাদের মূলোৎপাটন করতে বিএনপি-জামায়াতকে আগামী নির্বাচনে প্রতিহত করতে হবে। বামদের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে মৌলবাদীদের ঘরে যেন ধর্না দিতে না হয়, সেটাও দেখতে হবে। এটাই হোক আপাতত বামদের নির্বাচনকালীন রাজনীতি।
বাম ঘরানার রাজনীতির সঠিক চর্চার জন্য চাই দেশে সঠিক রাজনৈতিক আবহাওয়া। আর সেই আবহাওয়া স্বভাবতই জামায়াতি-হেফাজতিরা বামদের দেবে না। বাম রাজনীতির স্বচ্ছ চর্চার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতা থেকে অন্তত আরও পাঁচটি বছর দূরে রাখতে হবে এবং সে সময়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমেই বামদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে জনগণের কাছে।
বাংলার মাটিতে চিরকবর দিতে হবে মওদুদীবাদ আর মৌলবাদকে। এ দায় আমাদের সবার।
সাব্বির খান : আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।