Published : 07 Aug 2013, 01:15 PM
টেলিভিশনের পর্দায় প্রিয় কোনো অনুষ্ঠানে মগ্ন হয়ে আছেন আপনি। হঠাৎ পর্দাজুড়ে ভেসে উঠল একটি ক্রেন। আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হতে থাকল নানা ধরনের নির্মাণকাজের দৃশ্য। আর ভরাট কণ্ঠে ভেসে এল কতগুলো কথা, 'ইকোনোমিক অ্যাকশন প্ল্যান, ক্রিয়েটিং জব, ক্রিয়েটিং প্রোসপারিটি।'
কানাডার প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলেই প্রচারিত হচ্ছে এই বিজ্ঞাপনচিত্র। দেশটির কনজারভেটিভ সরকার এর প্রচারণা শুরু করেছিল ২০০৯ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ার পরপর। কানাডাই একমাত্র দেশ যাকে সেই সময়কার মন্দা ছুঁতে পারেনি। তবু প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার অর্থনীতি উজ্জীবিত রাখতে ঘোষণা করেছিলেন মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা কর্মসূচি। আর সেই কর্মসূচি সম্পর্কে কানাডিয়ানদের অবহিত রাখতে হারপার সরকার নেমে যায় বিজ্ঞাপনী প্রচারণায়।
২০০৯ এর মন্দা কেটে গেছে, কেটে গেছে তার রেশও। কিন্তু কনজারভেটিভ সরকারের সেই বিজ্ঞাপনি প্রচারণা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। বরং প্রতি বছরই বিজ্ঞাপনের বাজেট স্ফিত থেকে স্ফিততর হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞাপন আর থামছে না।
মাঝখানে অবশ্য এই প্রচারণা নিয়ে একটা বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। 'রাষ্ট্রের পয়সায় রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন?' প্রশ্নটা উচ্চারিত হয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের মুখে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নামিদামি অধ্যাপকরা সেই প্রশ্ন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, এগুলো রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নয়। বিজ্ঞাপনগুলোতে রাজনৈতিক বক্তব্য নেই, রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি নেই। সরকার তার উন্নয়নকাজের ফিরিস্তি জনগণের সামনে তুলে ধরতেই পারে। আমাদের দেখা দরকার সরকার তার কাজের ফিরিস্তি দিতে গিয়ে করদাতা জনগণের যে অর্থ ব্যয় করছে তাতে স্বচ্ছতা আছে কি না।
রাজধানী ঢাকার রাস্তায় সরকারের উন্নয়নকাজের ফিরিস্তি দিয়ে টানিয়ে দেওয়া বিলবোর্ডগুলো নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাকে স্টিফেন হারপারের টিভি বিজ্ঞাপনচিত্র নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের কাতারে কোনো বিবেচনাতেই ফেলা যায় না। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন একটি ধারা সংযোজনের কৃতিত্বের জন্য আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে পারি।
পশ্চিমা রাজনীতিতে 'রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন' বহুল ব্যবহৃত এবং সমাদৃত একটি মাধ্যম। কেবল বিলবোর্ডই নয়, ভিডিও বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করেও রাজনৈতিক দলগুলো সারাবছর প্রচারণা চালায়। কানাডায় দেখি প্রায় প্রতি মাসেই প্রধান বিরোধী দল এনডিপি প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের কোনো কর্মসূচিকে আক্রমণ বা সমালোচনা করে বিজ্ঞাপনচিত্র প্রচার করে। সরকারি দল কনজারভেটিভ পার্টিও পাল্টা বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করে সেটির জবাব দেয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখনও প্রতিপক্ষের কর্মসূচির সমালোচনা বা আক্রমণের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমগুলোর ব্যবহার শুরু করেনি। ঢাকার উদার মিডিয়া রাজনীতিকরা যা বলেন, তাই সবিস্তারে প্রচার করে বলেই হয়তো-বা রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব কর্মসূচির প্রচারণায় কোনো নতুনত্ব বা উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখাতে পারছেন না। সেই বিবেচনায় বিলবোর্ডগুলো অবশ্যই ঢাকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন উদ্ভাবন।
কিন্তু নতুন একটি উদ্ভাবন দেখাতে গিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এমন তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ল কেন? সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন, বিলবোর্ডগুলো নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রথম প্রকাশ ঘটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে। আর সর্বপ্রথম যারা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন তাদের সবাই এই সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সমর্থক। অর্থাৎ, প্রচারণায় পিছিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ সরকার প্রচারণায় নতুনত্ব আনতে গিয়ে নিজদলের শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও সন্তষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু কেন? সমস্যাটা কোথায়?
প্রথম সমালোচনা শুরু হয় বিলবোর্ডগুলোর গুণগত মান নিয়ে। ভুল বানান, ভুল বাক্য-সম্বলিত বক্তব্য দিয়ে আওয়ামী লীগের মতো বড় এবং প্রাচীন একটি রাজনৈতিক দলের বিলবোর্ড প্রকাশ্য রাজপথে শোভিত হচ্ছে– সেটি দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের লজ্জা দিয়েছে। রঙের ব্যবহার এবং রুচিবোধ নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছেন। এগুলো নিতান্তই মৌলিক বিষয়। কিন্তু যে সরকার উন্নয়নের ফিরিস্তি জনগণকে জানাতে চান, তারা রুচিবোধ না দেখাতেই পারেন, অন্তত মাতৃভাষায় নিজেদের শুদ্ধতার প্রমাণ তো দেবেন?
লেখাটা শুরু করেছিলাম কানাডার রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের উদাহরণ দিয়ে। কানাডায় রাজনৈতিক দলের বিজ্ঞাপন কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হয় আইনি কাঠামো দ্বারা। বিজ্ঞাপনের ভাষা, সাইজ সবকিছুই অনুমোদিত হতে হয়। বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয়ের পুরোপুরি হিসাব রেভিনিউ কানাডা এবং নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হয়, জানাতে হয় খরচের অর্থের উৎসও। রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচারণার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও রয়েছে।
বাংলাদেশে যেহেতু রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের প্রচলনই ঘটেনি, ফলে এ সংক্রান্ত নীতিমালা বা বিধিমালার প্রশ্ন তোলা এই মুহূর্তে অবান্তর। সরকারের বিলবোর্ডের সূত্র ধরে এ নিয়ে আলোচনার সূচনা করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিলবোর্ডস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকার নিজেই বেআইনি এবং অনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত হওয়ায় সেই সুযোগটি আপাতত হিমঘরেই রাখতে হচ্ছে।
ঢাকার বিলবোর্ডগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো প্রশ্ন উঠেছে। বিলবোর্ডগুলো কারা প্রকাশ করেছেন তা বোর্ডে উল্লেখ করা হয়নি। আওয়ামী লীগ বা তার কোনো অঙ্গ সংগঠন করে থাকলে বোর্ডে তাদের নাম থাকা জরুরি ছিল। সরকার নিজ উদ্যোগে করে থাকলে তারও উল্লেখ থাকা প্রয়োজন ছিল।
কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা সংগঠন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির বা দলের কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড নিয়ে বিজ্ঞাপন করতে চাইলে তাতেও এই ব্যক্তি বা সংগঠনের নাম থাকতে হয়। যাদের হয়ে বিজ্ঞাপনটি করা হচ্ছে তাদের যে এতে অনুমোদন আছে সেটিও উল্লেখ করে দিতে হয়। এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও অনুসৃত নীতিমালা।
কিন্তু ঢাকার বিলবোর্ডগুলো যেমন নামহীন-গোত্রহীন, তেমনি রাতের অন্ধকারে অন্যের বিলবোর্ডের জায়গা দখল করে সেখানে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজধানীতে বিলবোর্ড লাগানোর জন্য সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন নিতে হয়। সিটি কর্পোরেশন এই জায়গাগুলো ভাড়া দেয়। কিন্তু কোনো ধরনের অনুমোদন না নিয়ে, পয়সা না দিয়ে, অন্যের ভাড়া করা জায়গায় 'উন্নয়নের ফিরিস্তি' টানিয়ে দেওয়া অনৈতিকই নয় শুধু, অপরাধও।
বড় ধরনের অনৈতিক এবং বেআইনি কাজ করে আওয়ামী লীগ জনগণকে আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে। দলটি এখানে চরদখল, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল, নদীদখলের মতো নিন্দনীয় শব্দগুলোর কাতারে 'বিলবোর্ড-দখল' শব্দটি যুক্ত করে নিজেদের অবৈধ দখলদার হিসেবে পরিচিত করে তুলল।
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, বিলবোর্ডগুলো সরকার বা আওয়ামী লীগ করেনি, তাদের কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী নিজ দায়িত্বে করেছে, তাহলে সরকারের দায়িত্ব হবে কালবিলম্ব না করে এগুলো সরিয়ে ফেলা। রাজনৈতিক স্বার্থ মাথায় রেখে কোনো দখলদার গোষ্ঠী বেআইনি কাজ করলে তার দায়ভার সরকার বা ক্ষমতাসীন দল নেবে কেন?
আর যদি সরকার নিজে করে থাকে বা সরকারের সম্মতিতে হয়ে থাকে, তাহলে কতগুলো প্রশ্নের মীমাংসা সরকারকেই করতে হবে। বিলবোর্ড স্থাপনার সিদ্ধান্ত কোন পর্যায়ে হয়েছে, কীসের ভিত্তিতে কাদের দিয়ে বিলবোর্ড বানানো হয়েছে, কোন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কত টাকা ভাড়ায় জায়গা নেওয়া হয়েছে– এই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা হওয়া জরুরি।
তা না হলে বিলবোর্ডগুলো সরকারের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েই দাঁড়াবে।
শওগাত আলী সাগর : প্রধান সম্পাদক, নতুনদেশ ডটকম, কানাডা।