Published : 30 Jul 2013, 05:30 PM
অপ্রত্যাশিতভাবে ৩৪ তম বিসিএসের বাছাইপর্বের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ছাত্রবিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করা গেল। শুরু হল নানা কথা, নতুন ভাবনা। ঢাকার অনুকরণে রাজশাহী, চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিধ্বনিত হল মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
দাবি উঠল কোটা-পদ্ধতির পুনর্বিন্যাস করতে হবে, ভাবতে হবে নতুন করে, মেধার অবমূল্যায়ন করা যাবে না। প্রাথমিক পরীক্ষার ফলাফল বা প্রার্থী বাছাই-এর পর্যায়ে ৮০ নম্বর পেয়ে একজন পরীক্ষার্থী ছিটকে পড়বে, অথচ ৫২ নম্বর পেয়ে অপর প্রার্থী যোগ্য বলে বিবেচিত হবে– এমন অবস্থা অনেকেই মানতে রাজি নন। শিক্ষাঙ্গনে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বিচার-বিশ্লেষণেও বিষয়টি নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। বৃহত্তর পরিসরে সূচনা হয়েছে ব্যাপক বির্তকের, নীতিগত বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবনার।
বাছাইপর্বে কোটার হিসেব করে মূল পরীক্ষার জন্য প্রার্থী নির্বাচনের কাজটি বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন প্রথমবারের মতো বিবেচনায় এনেছিলেন। অতীতের অনুসৃত পন্থা পাল্টে দিয়ে কেন এ জাতীয় ভাবনা তাদের প্রণোদিত করল সেটি অনেকের কাছে পরিষ্কার হয়নি এখনও। সৌভাগ্যক্রমে কর্মকমিশন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন এবং সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ৪৬ হাজার ছাত্রছাত্রীর লিখিত পরীক্ষা নিতে রাজি হয়েছেন। এখন লিখিত পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবেন তারাই শুধু কোটা-পদ্ধতির আওতায় বিবেচিত হবেন।
তবে এ বিপুল সংখ্যক পরীর্ক্ষাথীর লিখিত পরীক্ষা নেওয়া এবং তাদের মধ্য থেকে মেধা তালিকা প্রণয়ন করা অত সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের দক্ষতা আছে কিন্তু ভারগ্রহণেরও সীমা আছে। আবার আতঙ্ক আছে, কখনও যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায় বা খাতাপত্র হারিয়ে যায়। অর্থাৎ কাজের চাপ বেশি হলে ভুলভ্রান্তির আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়। তাই অনেকের প্রশ্ন– কেন কমিশন জটিলতায় জড়িয়ে পড়লেন? তারপরও আশা করি সব কাজই সুসম্পন্ন হবে; সরকারি কর্মকমিশনও তাদের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে পারবেন।
এবারের মতো পরীক্ষা সম্ভবত শেষ হবে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মাঝে, কিন্তু বিষয়টি বির্তকিত থেকেই যাচ্ছে। এ জাতীয় একটি নীতিনির্ধারণী বিষয় শুধুমাত্র ধমক দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে বন্ধ করা যাবে না। এক্ষণেই নতুন করে অবশ্যই ভাবতে হবে এ বির্তকের বাস্তবমুখী ও গ্রহণযোগ্য সমাধান কোথায় এবং সমস্যা নিরসনের উপায় ও পদ্ধতি কী হতে পারে যা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বা জাতির কল্যাণে অর্থবহ হবে।
তৃতীয় বিশ্বের সবদেশেই কম-বেশি কোটা-পদ্ধতির প্রচলন আছে। এ জাতীয় পদ্ধতির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে জাতির মূলস্রোতে অনুপ্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করে শতফুল একসঙ্গে ফুটতে দেওয়ার বাতাবরণ সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিবেচনায় এ হচ্ছে একটি গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ। তবে এ ব্যাপারে কয়েকটি বিষয় ভাবতে হবে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে।
প্রথমে বলা যায়, কোটা কোনো স্থায়ী পদ্ধতি নয়। এ হচ্ছে সাময়িক পদক্ষেপ। এ পদ্ধতিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে প্রায়ই বিবেচনা ও পুনর্বিবেচনা হতে পারে। সংখ্যা বা অনুপাত নির্ধারণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে মহিলা আসন নির্ধারণে তারতম্য হচ্ছে প্রায়ই।
দ্বিতীয় হচ্ছে, বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটাভিত্তিক নিয়োগের প্রশ্নে কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। সংবিধানের ২৯ নং ধারায় বলা হয়েছে–
"(১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।" মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে এমন অপূর্ব বার্তা পৃথিবীতে খুবই বিরল।
তৃতীয় হচ্ছে, বর্তমানে যে কোটা-পদ্ধতি আছে তা হচ্ছে নির্বাহী আদেশে প্রর্বর্তিত একটি প্রক্রিয়া। ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর (ইডি /আর আই/আর-৭৩/৭২-১০৯(৫০০) তৎকালীন সংস্থাপন বিভাগের সচিব এম এম জামানের স্বাক্ষরে দেশের স্বাধীনতার পর দেশের সকল অঞ্চলের জনগণকে সরকারি চাকরিতে অনুপ্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি এবং সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে চাকরিতে নিয়োগের আদেশ জারি করা হয়।
আদেশের শুরুতেই বলা হয়েছে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে জেলাভিত্তিক এ কোটা নির্ধারণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ওই আদেশেই মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবদান ও ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করে তাদের জনজীবনে পুনর্বানের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৩০ শতাংশ কোটা দিয়ে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়।
তেমনিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত নারীদের জন্যও ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে চাকরিতে নিয়োগের বিধান রাখা হয়। ওই আদেশটি সরকারি কর্ম কমিশনের জন্যও প্রয়োগযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়। তবে মুজিবনগর কর্মচারি ও পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত কর্মচারিদের ক্ষেত্রে এ আদেশ বলবৎ হবে না বলে উল্লেখ করা হয়। এসবই হচ্ছে সাময়িক ব্যবস্থা। সময় এবং সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পুনঃবিবেচনার সুযোগ রয়েছে।
চতুর্থ যে বিষয়টি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য তা হচ্ছে মেধার সঠিক মূল্যায়ন। সকল প্রকার নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা হচ্ছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। কোটা হচ্ছে একটি সুযোগ, পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে অনুপ্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করা। কোটা হচ্ছে ব্যতিক্রম; মেধা হচ্ছে নিয়ম।
মেধার মূল্যায়ন সর্ম্পকে ভারতের সুপ্রিম কোর্র্টে রায় হয়েছে এবং তাতে বলা হয়েছে, কোটাভিত্তিক নিয়োগ কখনও-ই মেধার চেয়ে বেশি হতে পারবে না। বাংলাদেশে বর্তমানে মেধা হচ্ছে ৪৫ শতাংশ আর কোটা হচ্ছে ৫৫ শতাংশ। এ জাতীয় ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবস্থা চলতে পারে না।
পঞ্চমত দেখা যায়, ড. আকবর আলী খান ও কাজী রকিবউদ্দীন আহম্মদ (এখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার) একটি গবেষণা করেছেন। তাতে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে বর্তমানে ২৫৭ প্রকারের কোটা আছে, যা ঐতিহাসিক এবং বিশ্বে বিরল ঘটনা। এ জাতীয় কোটার হিসেব-নিকাশ অতি জটিল একটি প্রক্রিয়া এবং তাতে ভুল হতে পারে। ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে সুবিধা দেওয়ার সুযোগও থাকতে পারে।
বিশেষ করে পাবর্ত্য চট্রগ্রাম এলাকায় কোটা নির্ধারণে এমনটি বেশি হওয়ার কথা শোনা যায়। এছাড়াও জেলা কোটা হিসেবের ক্ষেত্রে জনসংখ্যাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। দেখা যায়, মেধা থাকা সত্বেও বা বেশি নম্বর পেয়েও কম জনসংখ্যার অধিবাসী, যেমন মেহেরপুর, লক্ষীপুর, লালমনিরহাট জেলার প্রার্থীরা চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এসবই হচ্ছে সংবিধান-বিরোধী এবং সমসুযোগ প্রদানের ব্যত্যয়্।
ষষ্ঠ বিষয় হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা। মুক্তিযোদ্ধারা অবশ্যই প্রাধিকার পাবেন, এ নিয়ে কারও বিরোধ নেই। একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা যদি যথাযথভাবে সুযোগ না পেয়ে থাকেন তার সন্তান পাবেন। পুনরায় তার নাতি-নাতনিরাও প্রাধিকার পাবেন এ হচ্ছে অতিরিক্ত।
সহজ হিসেব হচ্ছে, কোনো মুক্তিযোদ্ধা যদি একবার মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরি পেয়ে থাকেন, তবে তার পরিবারের কোনো পোষ্যর এ সুযোগ পাওয়া সঠিক হবে বলে মনে হয় না। একই কারণে অনুরূপ সুযোগ এক ব্যক্তি বারবার প্রাপ্ত হবেন কিনা, বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে। মুক্তিযোদ্ধার কোটা ৩০ শতাংশ পুনর্বিবেচনা করা সঙ্গত হবে।
পরিশেষে বলতে হয়, কোটা যত বেশি হবে জনপ্রশাসন ততোধিক দুর্বল হবে এবং মেধাবী প্রার্থীদের সুযোগ তত হ্রাস পাবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা আলাপ প্রসঙ্গে ১৯৯৭ সালে আমায় বলেছিলেন, কোটা-পদ্ধতির কারণে তাদের মন্ত্রণালয়ে এমনসব কর্মকর্তা আছেন যাদের দুর্বলতা দৃশ্যমান এবং আচার-আচরণ হাস্যাষ্পদ।
বর্তমানে প্রস্তাব হচ্ছে একটি কমিশন করে কোটা-পদ্ধতির পুনর্বিন্যাস করা। বৃহত্তর জাতীয স্বার্থে মেধাকে গুরুত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারকে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে।
সমঅধিকার এবং সমসুযোগের প্রশ্নে এবং প্রতিভা মূল্যায়নের স্বার্থে কোটা-প্রথা কীভাবে অর্থবহ করা যায় সরকার তা পুনরায় ভেবে দেখবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
ধীরাজ কুমার নাথ : সাবেক সচিব এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা।