Published : 07 Aug 2010, 06:31 PM
আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় শাকসব্জির পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে জনপ্রতি প্রতিদিন গড়পরতা ১৫০ গ্রামের উপরে পৌঁছেছে। সুস্থ ও সবল দেহের জন্য, অতিরিক্ত ওজন ও মেদ কমাতে এবং রোগ প্রতিরোধে প্রতিদিন তরকারী, সালাদ, ভাজি, সস্, স্যুপ বা রস যে ভাবেই হোক না কেন শাকসব্জি খাওয়া বেড়েই চলেছে।
তবে এই শাকসব্জি আমাদের কতটুকু উপকার করছে তা নিয়ে সম্প্রতি শংকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সময়ে শাকসব্জি কোন কোন ক্ষেত্রে নিরাপদ নয় বলে সাবধান করে আসছেন। অন্যান্য খাদ্যের মত শাকসব্জি উৎপাদনেও রাসায়নিক বালাইনাশক বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। তবে শাকসব্জিতে এই রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য শাকসব্জি ক্রেতা ও উৎপাদনকারী উভয়ই দায়ী। ক্রেতারা শাকসব্জি চকচকে, তাজা ও অক্ষত না হলে উপযুক্ত দাম দিতে ইচ্ছুক থাকেন না। ফলে শাকসব্জি আবাদে চাষি ভায়েরা সার, কীটনাশক ও হরমোন প্রয়োগ করে ক্রেতাদের মন রক্ষা করছেন। ফলে ক্রেতারা অর্থ খরচ করে শাকসব্জির সাথে হয়তো বা বিষাক্ত দ্রব্যও কিনছেন।
দৈনিক আমরা খাদ্যের সাথে কী পরিমাণে কীটনাশক গ্রহণ করছি এবং কতটুকু শরীরে গ্রহণযোগ্য বা সহনশীল তা আমাদের জানা নেই। অন্যদিকে, শাকসব্জির উৎপাদনে কী পরিমাণ কোন কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তাও জানা নেই। তবে কৃষক ভাইদের সাথে আলাপ করে দেখা গেছে যে প্রায় সবরকম সবুজ শাকসব্জিতে কীটপতঙ্গ আক্রমণের ভয়ে কীটনাশক প্রয়োগ করেন। বিশেষ করে শাকসব্জির আবাদ যাদের অন্যতম পেশা। যে সমস্ত কীটনাশক সস্তা ও প্রয়োগ করলে দ্রুত পোকা মরে সেগুলোর চাহিদা বেশি। ক্রেতার মন রক্ষা করে বেশি দামের আশায় চকচকে শাকসব্জি উৎপাদনের জন্য কৃষকভাইয়েরা কোন কোন ক্ষেত্রে অনুমোদিত হারের তুলনায় অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। পাইকারী বাজারে বড় বড় সাইজের চকচকে শাকসব্জির চাহিদা বেশি। দেশী জাতের শাকসব্জির চেহারা ও আকৃতি আকর্ষণীয় নয়। ফলে বাজারে নতুন জাতের বা বিদেশী বীজ থেকে উৎপাদিত শাকসব্জির চাহিদা বেশি। আকারে বড় ও ফলন বেশি হওয়ার কারণে কৃষকভাইয়েরাও এসমস্ত জাতের শাকসব্জি উৎপাদনে আগ্রহী বেশি। অন্যদিকে, দেশী জাতের তুলনায় নতুন জাত বা বিদেশ থেকে আমদানীকৃত বীজ থেকে উৎপাদিত শাকসব্জির জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের হার বেশি।
কিছুদিন আগে টেলিভিশনে বাজারে জিনিসপত্রের দাম সংক্রান্ত প্রচারিত এক অনুষ্ঠানে জনৈক ক্রেতা শাকসব্জির দাম বেশি বলে অভিযোগ করতে গিয়ে বললেন "এই দেখুন পোকায় খাওয়া বেগুনও চল্লিশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।" তিনি হয়ত জানেন না যে এই বেগুনে রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়নি। যার ফলে পোকা আক্রমণ করতে পেরেছে। তবে এই বেগুন খাওয়া নিরাপদ।
তিনচার দশক আগেও আমরা কীটপতঙ্গ আক্রান্ত শাকসব্জি খেয়েছি। এ ব্যপারে কোন দ্বিধা বা অভিযোগ ছিলো না। বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি কাটার সময়ে সবুজ রং-এর সাদা কীড়া পাওয়া যেত। ডাটা ও লাল শাকে পোকায় খাওয়া জালের মত পাতা পাওয়া যেত। শাকসব্জি কাটতে গিয়ে পোকা দেখে অনেক সময় গৃহিণীরা আঁতকে উঠতেন। পয়সা খরচ করে পোকা-খাওয়া সব্জি কেন এনেছো, এই বলে অভিযোগ করতেন। তবে তারা সতর্কতার সাথে পোকা তুলে ফেলে এবং আক্রান্ত অংশ বাদ দিয়ে রান্না করতেন। তখন রাসায়নিক কীটনাশকের কোন ব্যবহার ছিল না। কেউ এই রাসায়নিক দ্রব্য চিনতোও না।
একই জমিতে একসাথে বিভিন্ন শাকসব্জির আবাদ করে, বেশি দূরত্বে বীজ বপন বা চারা রোপণ করে, জমি পরিষ্কার পরিছন্ন ও আগাছা মুক্ত রেখে, গাছের পাতায় ছাই ছিটিয়ে কীটপতঙ্গের আক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়া হত। তাছাড়া বিটল, উড়চুঙ্গা, মাছি, বোলতা, লাল পিঁপড়া, মাকড়সা, ব্যাঙ, শালিক, ফিংগে, গুইসাপ ও পেঁচা ইত্যাদি প্রাণীর বংশবিস্তার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকায় কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম হতো। কারণ এ সমস্ত প্রাণী ফসলে আক্রমণকারী কীটপতঙ্গ এবং তাদের ডিম, কীড়া ও পুত্তলি ধরে খায়। এর পরেও শাকসব্জিতে কীটপতঙ্গ পাওয়া গেলে বা আক্রমণের চিহ্ন থাকলে কেউ খেতে দ্বিধা বোধ করত না। বাজারে চাহিদারও কমতি ছিলো না।
সম্প্রতি আমরা হঠাৎ করে শাকসব্জিতে কীটপতঙ্গ দেখে আতংকিত হতে শুরু করেছি। ফলে বাজারে চকচকে শাকসব্জির যেমন চাহিদা তেমনি মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কীটপতঙ্গ আক্রান্ত হলে বিক্রি হয় না, দাম কম। খুঁজেও এখন শাকসব্জিতে পোকা পাওয়া যাবে না। ক্রেতাদের মন রক্ষা করতে গিয়ে শাকসব্জিসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনে বছরে পঁচিশ হাজার টন বা কিলো লিটারের উপরে রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করা হচেছ। এই প্রয়োগের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দু'দশক আগেও বছরে পাঁচ হাজার টন প্রয়োগ করা হতো। হিসেব করলে প্রতি একর আবাদি জমিতে ফসল উৎপাদনে বছরে সোয়া কেজি বা লিটার রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর একটা অংশ শাকসব্জি ক্ষেতে প্রয়োগ করা হয়।
কীটনাশকের প্রভাব থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমাদের কীটপতঙ্গ আক্রাস্ত শাকসব্জি পরিহার করা ঠিক হবে না। কীটপতঙ্গ আক্রান্ত শাকসব্জি নিরাপদ, খেতে স্বাদ বেশি, উপকারও বেশি। আগের মত এই শাকসব্জির চাহিদা থাকলে কৃষক ভায়েরা রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগে অনুৎসাহিত হতে থাকবেন। অর্গানিক বা জৈব শাকসব্জি আবাদে আগ্রহী হবেন। এই ধরনের চাষাবাদে কীটপতঙ্গ দমনে রাসায়নিকের পরিবর্তে জৈব দ্রব্য প্রয়োগ করা হয়। যেমন নিমের পাতা ও বীজ, তামাকের সতেজ বা শুকনা পাতা, মরিচের গুঁড়া ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে অথবা পাউডার বা তরল ডিটারজেন্ট সাবানের পানি শাকসব্জির ক্ষেতে ছিটিয়ে, শাকসব্জির বাগানে মাঝে মাঝে তামাকের গাছ লাগিয়ে, ফাঁদ পেতে বা হাত জালে কীটপতঙ্গ ধরে, ইত্যাদি। এই সমস্ত পদ্ধতিতে শাকসব্জির আবাদে ফলন বা উৎপাদন কম হতে পারে। ফলে মূল্য বেশি হতে পারে এবং কম করে খাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তবুও আমাদের শরীর ও পরিবেশ নিরাপদ থাকবে।