Published : 12 Jul 2013, 04:46 PM
৮ জুলাই ৩৪তম বিসিএস-এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশের প্রেক্ষিতে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় দুদিন পর বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন ফল পুনর্বিবেচনার জন্য তা বাতিল করে।
কমিশন কীসের ভিত্তিতে ফল প্রকাশ করেছে ঘোষণা না দিলেও নানা খবর ছড়িয়ে পড়ে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে '৮৯টি সঠিক উত্তর দিয়েও চান্স পাইনি' শিরোনামে খবর হয়। অন্য সংবাদপত্রগুলোয় বিক্ষোভকারীদের মন্তব্যে উঠে আসে কোটায় ৫০ নম্বর এবং মেধায় ৮০ নম্বর পেয়ে এবার পাশ করানো হয়েছে। তথ্যের বিভিন্নতায় স্পষ্ট যে ফল নিয়ে গুজবও ছড়িয়েছে।
পরীক্ষায় ভালো ফল করা ছাড়াও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কোটা চালু রয়েছে।
এক প্রতিবেদনে এসেছে- ১৯৭২ সালে ২০ শতাংশ মেধা, ৪০ শতাংশ জেলা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা আর ১০ শতাংশ যুদ্ধবিধ্বস্ত নারী কোটা ছিল। ১৯৭৬-এ তা পরিবর্তন করে মেধা ৪০শতাংশ আর জেলা কোটা ২০ শতাংশ করা হয়। ১৯৮৫-তে মেধা ৪৫ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ৫ শতাংশ করা হয়। প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ ছিল। পরে এ কোটার সুযোগ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরও দেওয়া হয়।
একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, গত ৪১ বছরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সত্যিকার অর্থে পূরণ হলে সরকারি চাকরি করে না এমন মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হত। কিন্তু আজও সংবাদপত্রে ভিক্ষে করে, বিনা চিকিৎসায় মরে শিরোনাম হন মুক্তিযোদ্ধারা। কেন?
বিসিএস পরীক্ষার্থীদের একাংশ দাবি করছে শুধুমাত্র পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই করতে হবে। প্রকাশিত ফল বাতিল করার পর এ আন্দোলন মারমুখী হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় আগুন দিয়ে, ঢাবি উপাচার্যের বাসভবনসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অশ্লীল শ্লোগান দিয়ে চলেছে তারা। 'মুক্তিযোদ্ধাদের দুই গালে জুতা মার তালে তালে' এমন সব শ্লোগান দিচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা।
দক্ষিণ এশিয়ায় আলোচিত কোটাবিরোধী আন্দোলন ভারতের মণ্ডল কমিশনকে ঘিরে। এ কমিশনের সুপারিশে সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মসংস্থান ও শিক্ষার সুযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ৪৯ দশমিক ৫ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করতে গেলে ১৯৮৯ সালে ভারতজুড়ে প্রতিবাদ হয়। ওই আন্দোলন ছিল সেদেশের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির স্বার্থরক্ষার আন্দোলন। তাদের দাবি ছিল 'মেধার পরিবর্তে জন্মসূত্রে সুবিধাদান চলবে না।'
৩৪ বিসিএস নিয়ে আন্দোলনকারীরাও একই যুক্তি তুলে ধরছেন। তবে কয়েক হাজার তথ্য মুখস্ত করে এমসিকিউ পদ্ধতিতে নম্বর পাওয়া মেধার সাক্ষর কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নিজেদের মেধাবী হিসেবে জাহির না করে সঠিক হত যদি তারা বলতেন 'প্রাপ্ত নম্বরের প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি চালু করা হোক।'
প্রাপ্ত নম্বরই মেধাবী বাছাইয়ের একমাত্র মাপকাঠি হলে সব কোটাই বাতিল হয়ে যায়। শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে কথা উঠলেও আন্দোলকারীদের দাবিও তেমনই। ওদের কথা মানলে বাতিল হবে মফস্বলবাসীর, প্রতিবন্ধীর, পিছিয়ে-পড়া জাতিসত্তার জন্য বরাদ্দ সব কোটাই। এমন দাবির সঙ্গে একমত হতে পারেন শুধু সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী। এখানেই ভারতের মণ্ডল কমিশনবিরোধী বর্ণবাদী আন্দোলনের সঙ্গে বিসিএস চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের মিল। এমনটা হলে প্রশাসনে সুবিধাপ্রাপ্ত পরিবারগুলোর আধিপত্য নিশ্চিত হবে।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন গড়ে ওঠে বাংলা ও আসাম রাজ্যে সরকারি চাকুরেদের নিয়ে। এ দুই রাজ্যে সমমর্যাদার চাকুরেদের পদবিতে ভিন্নতা থাকায় নতুন দেশে আসাম রাজ্যের চাকুরেরা একধাপ এগিয়ে যায়। এতে চাকুরেদের উপরই শুধু নয়, সরকারি নানা সুবিধার ক্ষেত্রে সিলেট বাড়তি সুবিধা পায় বলেও অসন্তোষ ছিল। চাকরিতে জেলা কোটা সৃষ্টির পেছনে এ অভিজ্ঞতা অনুঘটক হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি সব চাকরির উদ্দেশ্য এক নয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে একই মাপকাঠিও মান্য হতে পারে না। ব্রিটিশ আমলে এমন কথাও চালু ছিল যে, অভিজাত পরিবারের সন্তানরা হুকুম করা শিখতে শিখতেই বড় হয়, তাই তারা ভালো ম্যাজিস্ট্রেট হয়। এমন 'লর্ড-মার্কা' দর্শন নিশ্চয়ই এদেশের জনপ্রশাসন গঠনের দর্শন হতে পারে না।
লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়ে দেশগঠনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে লাগানোই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রথম থেকেই তাদের কাজে লাগানোয় অথবা মর্যাদার স্বীকৃতিদান কাগুজেই থেকে গেছে। একটুকরো সনদ হাতে দিয়ে গাওয়া হয়েছে 'তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না।' যারা এ দেশ চান না বা যারা পাকিস্তান উচ্ছেদের দুঃখে এখনও কাতর তারা যা খুশি তা বলতে পারেন; কিন্তু দেশের মূলভিত্তিকে অসম্মান করে ফের সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুধু বুঝি এদেশেই সম্ভব।
লক্ষণীয়, আন্দোলকারীরা জনসংখ্যার শতকরা হিসেবের সঙ্গে মিলিয়ে কোটার হারের সমালোচনা করছে। স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দৃশ্যপট উল্টে না গেলে আজ হয়তো মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রসঙ্গ উঠত না। জনগণের মধ্যে অন্যান্য ধরনের বৈষম্য না থাকলে অন্য কোটারও অবতারণা হত না।
যারা একবার পরীক্ষার নম্বর, ফের শতকরা হিসেব, আবার কোটা প্রথাই বাতিলের কথা তুলছেন তারা খুব ভেবেচিন্তে এ আন্দোলনে নামেনিন। যে কারণে জামায়াতের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করা সম্ভব হচ্ছে। সরকারি চাকরি শুধু নম্বরভিত্তিক হলে পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়েও কথা ওঠে। অন্যসবকিছুর মতো কোটার অসৎ ব্যবহার হতে পারে; তার অর্থ কোনোভাবেই মূল দর্শনের মাথা কেটে ফেলা নয়।
আবার কোটা ব্যবস্থা অনড়-অচল না রেখে একে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া হিসেবে দেখাও খুব জরুরি। কী কী বিষয়ে কোটা থাকবে আর কতটুকুই-বা থাকবে তা প্রতিবছরই মূল্যায়ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এমন তো হতেই পারে যে, জেলার জনসংখ্যার ভিত্তিতে পদগুলো ভাগ করে তা আবার পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠী, যেমন কৃষক, শ্রমিক, অতিদরিদ্র, ভূমিহীন, নারী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভাজিত করা।
ভারতের সুবিধাপ্রাপ্তদের সামাজিকভাবে যে বর্ণবাদী আধিপত্য রয়েছে এদেশে সুবিধাভোগীদের তা নেই। ফলে নিম্নবিত্তের জন্য কোটার ঘোষণা এলে এ আন্দোলনের পেছনের রাজনৈতিক শক্তিই পরাস্ত হবে।
খুব কম সংখ্যককে এবার লিখিত পরীক্ষার জন্য বাছাই করাও অসন্তোষের বড় একটি কারণ। লিখিত পরীক্ষার জন্য ৫০ হাজার বা এক লাখ শিক্ষার্থী অনুমতি পেলে সমস্যা কোথায়?
মুজতবা হাকিম প্লেটো : সাংবাদিক।