Published : 11 Jul 2013, 01:29 AM
সরকার সম্প্রতি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মঠ, মন্দির, দেবোত্তর সম্পত্তি নিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করতে উদ্যোগ নিয়েছেন। এটি করতে গিয়ে যদি সরকার সংখ্যালঘুদের অন্তরে আঘাত দেন তবে সেটি কোনো শুভউদ্যোগ হবে না। মন্দির কমিটিগুলোর মতামত নিয়ে কাজটি করা দরকার ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হল সরকার সেটি করেননি। আদি সনাতন শৃঙ্খল, শাস্ত্র-আচারকে যদিও আমি এখন পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল বিষয় বলে মনে করি। মানুষের মধ্যে ধনবৈষম্য, শ্রেণিবৈষম্যেরও আমি ঘোর বিরোধী। কিন্তু আমি রাষ্ট্রের কাছে ধর্মনিরেপেক্ষ আচার ও বিচার আশা করি। জোর করে কারও বিশ্বাস, আস্থা আর ভালোবাসা কেড়ে নেওয়াকে কায়েমিপনা এবং অমানবিক ও নিষ্ঠুর অপরাধ বলেই আমার মনে হয়।
এত গৌরচন্দ্রিকা এ জন্য যে, ৩ জুন সরকার দেবোত্তর সম্পত্তি প্রশাসন, সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার, ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা, উন্নয়ন এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান তৈরির জন্য একটি বিল এনেছেন। খুব তাড়াতাড়িই এটি সংসদে উপস্থাপন করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে একে অ্যাক্টে (আইনে) পরিণত করা হবে।
এ উদ্যোগের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন সংগঠন ও মতবাদীরা মঠ-মন্দির ও দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষা ও পুনরুদ্ধার জতীয় কমিটি গঠন করেছেন। ওই বিলে তাদের ধর্মীয় অনুভূতির মর্মমূলে আঘাত করা হয়েছে বলে একে একটি 'কালো আইন' হিসেবে অভিহিত করেছেন তারা। ৩০ দিনের মধ্যে বিলটি বাতিলেরও দাবি জানানো হয়েছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের কোলকাতার জানবাজারের জমিদার রানি রাসমনি দেবী দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। ওই মন্দিরে দেবীপূজার জন্য পৌরহিত্যের বিষয়ে জাত্যাভিমানী ব্রাহ্মণরা কেউ রাজি না হলে বালক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে বললে তিনি রাজি হন। এভাবেই রানি রাসমনি দেবী কূপমণ্ডূক ও কায়েমী স্বার্থবাদী হিন্দুদের নৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে পরাজিত করেন।
রানি রাসমনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। ব্রিটিশদের হাত থেকে গঙ্গায় জেলেদের মাছ ধরার অধিকার কেড়ে নেন কঠিন ও একনিষ্ঠ আইনি সংগ্রামের মাধ্যমে। ইংরেজ আমলে না হয় এদেশের হিন্দুদের বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। কিন্তু এখনও কারও কারও লড়াই চলছে নব্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে। তখন ইংরেজদের দালালি করত আমাদেরই কোনো ভাই। এখনও এমন কিছু লোক মঠ-মন্দিরের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সরকারের আনুকূল্য পেতে নানা রকমের দালালি করে।
এমনিতেই কয়েক যুগ ধরে শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে সংখ্যালঘুরা। তারপর সেখানে একটু আলোর রেখা দেখা গেলেও আবার নতুন এ উপদ্রব। গণমাধ্যম থেকে বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় সংঠনের সংগ্রহ করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৫ লাখ একর মঠ, মন্দির ও দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করে রেখেছে আগ্রাসীরা। ওদিকে প্রতিদিনই তো মন্দির ভাঙা হচ্ছে বিভিন্ন উছিলায়। এ ব্যাপারে আবার সব রাজনৈতিক দল সমানে সমান। সরকার ও রাষ্ট্র এ সব ভয়ঙ্কর অনাচার থামাতে পারছে না।
১৯৮৬ সালে সাবেক সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মাজার শরীফ কুক্ষিগত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সুফি-সন্তদের আন্দোলনের ফলে তার সরকার ওই অপকর্ম করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৯৬ সালে সুধীজনের মতামত উপেক্ষা করে তৎকালীন সরকার কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় লালন আখড়া প্রাঙ্গনের সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য হত্যা করে। আখড়া প্রাঙ্গনেই মিলনায়তন অর্থাৎ অডিটরিয়াম তৈরির উদ্যোগ নিয়ে শেষ পর্যন্ত সে অপকর্ম সম্পন্নই করে ফেলে সরকার। প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন 'লালন আখড়া রক্ষা কমিটি' নামে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তাদের আন্দোলনের পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাঘাত করেন সরকারের কজন পোষা বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
মন্দির নির্মাণ করে তাতে দেবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা-অর্চনার ব্যয় নির্বাহের জন্য সম্পত্তি দান করলে তা সাধারণত 'দেবোত্তর সম্পত্তি' বলে পরিচিতি পায়। আইনের দৃষ্টিতে এ রকম বিগ্রহ বা দেবতার মূর্তি একটি বৈধ আইনি সত্তা বা জুডিশিয়াল পারসন। এ রকম সম্পত্তির আইনি মালিক ওই বিগ্রহই। কারণ তার উদ্দেশে সেটি দান করা।
দেবোত্তর দুই রকমের হয়। যখন কোনো পরিবারের কোনো ব্যক্তি পারিবারিক গৃহদেবতার পূজা-অর্চনার জন্য কোনো সম্পত্তি দান করে যান, তখন তাকে 'ব্যক্তিগত বা পারিবারিক দেবোত্তর' বলা হয়। কারণ তখন বিগ্রহের সেবা ও পূজার দায়িত্ব তার বংশধরদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
অপরদিকে, সর্বসাধারণের জন্য অনুরূপ দান সম্পন্ন হলে এটি 'সর্বজনীন দেবোত্তর' সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। কারণ এতে কোনো একক ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থ বা দায়দায়িত্ব থাকে না। সে অবস্থায় এটি সাধারণের সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। যেমন, রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির।
বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো বিগ্রহ যেখানে আইনত সম্পত্তির মালিক সে ক্ষেত্রে বিগ্রহের সেবায়েতগণ বিগ্রহ ও দেবোত্তর সম্পত্তি যদি এদেশে ফেলে দেশান্তরে চলে যান তারপরও তাদের কাছে দেবতার মালিকানা থেকে যায়। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত ও হিন্দুদের ব্যক্তিগত আইন তাই বলে। অর্থাৎ, বিগ্রহ দেশান্তরে না গেলে শুধুমাত্র সেবায়েতগণ দেশান্তরী হয়েছেন বলে এ অজুহাতে বিগ্রহের সম্পত্তি শত্রুসম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হবে না এবং সরকারও এ ধরনের সম্পত্তির দখল নিতে পারে না।
বিষয়টি সিদ্ধান্ত আকারে শুকদেব বনাম প্রভিন্স অব ইস্ট পাকিস্তান, ২২ ডি এল আর, পৃষ্ঠা ২৪৫ মুদ্রিত রয়েছে।
প্রাসঙ্গিক কারণেই এখন আমরা জানব কাদের সেবায়েত বলা হয়। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবতার নিত্য পূজা- অর্চনার কাজে যিনি নিয়োজিত থাকেন তিনিই সেবায়েত। একজন সেবায়েত দেবতা বা বিগ্রহের যাবতীয় বিষয়ের কার্যনির্বাহীও বটে। দেবতা সম্পত্তির মালিক হলেও কার্যত সম্পত্তি পরিচালনায় সম্পূর্ণ অক্ষম। সে জন্য দেবতার পক্ষে তদীয় সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন উপযুক্ত পরিচালকের প্রয়োজন। আর সে দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে সেবায়েতের উপর।
সেবায়েতের কর্তব্য ও দায়িত্ব প্রকৃতপক্ষে নাবালকের সম্পত্তির অভিভাবকের মতো। নাবালকের সম্পত্তি থেকে বেদখল হলে নাবালক অভিভাবকের মাধ্যমে প্রতিকার পেতে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। ঠিক একইভাবে সম্পত্তি বেদখল হলে দেবতাকেও সেবায়েতের মাধ্যমে প্রতিকারের জন্য আদালতে যেতে হয়। তখন বিগ্রহের পক্ষে সেবায়েতদের দিয়ে মামলা করতে হয়। নাবালকের অভিভাবক যেমন আইনসঙ্গতভাবে নাবালকের প্রকৃত স্বার্থে তার বৈধ প্রয়োজনে কিছু অংশ বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারেন, তেমনি দেবতা তার সম্পত্তি থেকে বেদখল হলে সেবায়েতের মাধ্যমে আদালতে যেতে পারেন। দেবতার স্বার্থে কোনো সম্পত্তি বিক্রিতে সাবধাননীতি অবলম্বন করতে হয় সেবায়েতকে। দেবতার সম্পত্তি কিনতে গিয়ে সেবায়েতের সঙ্গে দেবতার স্বার্থবিরোধী লেনেদেনে জড়িয়ে পড়া নিয়ে একটি বিখ্যাত মামলার উদাহরণ রয়েছে।
হনুমান প্রসাদ পাণ্ডে বনাম মুসাম্মাৎ বাবুয়ী মুনরাজ মামলায় প্রিভি কাউন্সিল সেবায়েতের ক্ষমতা, কর্তব্য এবং ক্রেতার দায়দায়িত্ব নিয়ে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।
আরেকটি বিষয় খুব প্রাসঙ্গিক আলোচনা। দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত কে হবেন আর তার উত্তরাধিকার কারা হবেন, কোন নিয়মে হবেন তা সাধারণত অর্পণনামা বা উৎসর্গপত্রে লেখা থকে। সেবায়েত দেবতার বিরুদ্ধে কাজ করলে বা তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তাকে প্রয়োজনে আদালত কর্তৃক অপসারণ করে অন্য সেবায়েত নিয়োগ করা যায়।
দেবোত্তর অথবা দাতব্য কারণে দান করার নির্দিষ্ট পদ্ধতিও রয়েছে। দেবোত্তর বা দাতব্য কারণে দান করতে লিখিত দলিল আবশ্যিক নয়। তা মৌখিকও হতে পারে। তবে এ জাতীয় দলিল দানপত্র অথবা ইচ্ছাপত্রও হতে পারে। আবার কোনো ট্রাস্ট গঠন করে ট্রাস্টিদের হাতেও দেবোত্তর বা দাতব্য বিষয়ের দায়িত্ব অর্পণ করা যায়।
লিখিত দলিল হলে দানের ব্যাপারে সবকিছু সুস্পষ্টভাবে লিখিত হতে হবে। নতুবা অস্পষ্টতা এবং অনিশ্চয়তায় দান বাতিল বলে গণ্য হবে। উৎসর্গিত সম্পত্তির পূর্ণ তালিকা এবং পরিচয় দলিলের তফসিলে দিতে হবে। দাতা চিরকালের জন্য দানটি করবেন। এতে পূজার ধরন ও মানবসেবার স্বরূপ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। দান করা সম্পত্তিতে দাতার কোনো স্বার্থ থাকবে না।
দানটি যদি শুধুমাত্র মুখে মুখেই রয়ে যায়, অন্যকে দেখানোর জন্য হয়, তাহলে প্রকৃত মালিকানা দাতার হাতেই থেকে যায়। উদাহরণ টেনে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যাক। যেমন, রাম যথেষ্ট ঋণগ্রস্ত রয়েছে। রামের পাওনাদাররা যদি তার তাদের পাওনার দাবিতে রামের বিরুদ্ধে মামলা করে তবে রাম ফেঁসে যাবে। রাম পাওনাদারদের ফাঁকি দেওয়া এবং সম্পত্তি নিলামের হাত থেকে রক্ষার জন্য কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে কালীমায়ের নামে যাবতীয় সম্পত্তি দান করে তার নিজের ছেলেকে সেবায়েত নিযুক্ত করল। এটি কাল্পনিক বা ইলিউসরি দান। এটিকে কোনো দেবোত্তর সম্পত্তিতে দান বলা যাবে না।
দান আবার আংশিকও হতে পারে। এরূপ দানে দেবতা মালিক হন না। দেবপূজার নিমিত্তে সম্পত্তির সঙ্গে একটি বাধ্যবাধকতা (চার্জ) সৃষ্টি হয় মাত্র।
কিন্তু এসবের দীর্ঘদিনের অনুশীলন ও ব্যবস্থাপনা অস্বীকার, প্রত্যাখ্যান করে দেবোত্তর সম্পত্তির প্রশাসন, সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার, ব্যবস্থাপনা পরিচালনা, উন্নয়ন এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে বিধান প্রণয়নের জন্য বিল আনা হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন সংগঠন প্রস্তাবিত এ আইনের মূখ্য অংশগুলোর বিরোধিতা করে আন্দোলন শুরু করেছেন।
তাদের দাবি, এ আইন হলে ব্রহ্মচারী-সাধু-মোহন্ত-সন্ন্যাসীরা মুক্তমনে, স্বেচ্ছায়, নির্বিবাদে ঈশ্বরের সেবা ও আরাধনা করতে পারবেন না। এ আইনের প্রস্তাবে সুকৌশলে তাদের ধর্মপালনের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হবে বলে মনে করেন তারা। তারা বলছেন, এটি করলে সাধু-মোহন্ত-সেবায়েতদের জোর করে বেতনভূক কর্মচারিতে পরিণত করা হবে। আর নিয়ন্ত্রক হবেন সরকার বা বোর্ড। ফলে ভগবানের বিধান নয়, নিয়োগকর্তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাই বেশি গুরুত্ব পাবে। ঈশ্বরালয়ে প্রত্যক্ষ ও সরাসরি রাজনীতির বেনোজল ঢুকে পড়বে।
দেবতাকে সন্মান না করে সরকারকে সম্মান করার এ চালকে আমিও তাদের মতো কূটচাল এবং ধর্মধারণকারী ও চর্চাকারীদের অপমান বলে মনে করছি। কারণ এ ক্ষেত্রে রাজনীতিক পাণ্ডারা প্রবলভাবে উৎসাহিত হবে। ওই সব রাজনীতিক পাণ্ডাদের ইচ্ছানুযায়ী না চললে সেবায়েত মোহন্তগণ বিতাড়িত হবেন।
প্রস্তাবিত এ আইনের ৪১ ধারায় উল্লেখ করা হযেছে, মন্দিরের আয়ের একটা অংশ প্রশাসনকে দিতে হবে। ৫৩ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড রিকুইজিশন অব ইমমুভেবল প্রপার্টি অর্ডিন্যান্স ১৯৮২-এর বলে যে কোনো সময় যে কোনো মঠ-মন্দির হুকুমদখল করে যে কোনো কাজে লাগাতে পারবেন। আইনের ৫৬ ধারায় প্রস্তাব এসেছে দেবোত্তর সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ডের কোনো সিদ্ধান্ত ও কাজের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে মামলা করা যাবে না। ৪(২) ধারায় বোর্ডকে মন্দিরের সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
দেবোত্তর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা নিয়ে আইন হোক, অসুবিধা নেই। কিন্তু এ রকম আইন কীভাবে কল্যাণমুখী, গণতান্ত্রিক আইন হবে? এ আইন কি মঠ ও মন্দিরের স্বার্থে হচ্ছে? এ আইন কাদের স্বার্থে যাবে? এ আইনের সুবিধা নেবে কারা? কোনো তর্ক বা পক্ষ না নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যদি দেখি তাহলে কী দেখা যাবে? যদি বলি দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সহনশীল আর অনুচ্চকিত, সহিংসতাবিরোধী অবস্থানের জন্য এ রকম একটি বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়নের সাহস দেখানো হচ্ছে, তাহলে কি সেটা খুব বাড়াবাড়ি হবে?
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন সংগঠনের সংগৃহীত বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকার ইতোমধ্যেই শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ দেবোত্তর সম্পত্তি, মঠ-মন্দির, অর্পিত ও অনাগরিক সম্পত্তির তালিকাভূক্ত করেছে। তাছাড়া দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক নেতাদের ছাতার তলায় যে যেখানে যতটুকু পেরেছে দখল করেছে।
এ অবস্থায় আমি মনে করি, সরকারের অবৈধ তালিকাকরণের বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা নিতে জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব, পুলিশ সুপার সরকারের দিকে দেখবেন নাকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ের স্বার্থ দেখবেন? তাদের সাংস্কৃতিক মান এবং মনোজগত কি এতটাই উঁচুমার্গের? আইনটি পাশ হলে ঈশ্বরের অংশ মানুষকেও ভালোবাসা যাবে না। ভালোবাসতে হবে দলীয় সরকারকে।
কান্তজী মন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের বিপুল জায়গা বেদখলের কথা আমরা সবাই জানি। গণমাধ্যমে অনেকবারই এ সংক্রান্ত অনেক খবর পড়েছি। কিন্তু সেগুলো উদ্ধারের ব্যাপারে সরকার তো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। প্রাসঙ্গিকভাবেই রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের কথা চলে আসে। এ মন্দিরের পেছনের ইতিহাসে যাই। দেবোত্তর সম্পত্তি, মঠ, মন্দির নিয়ে সরকারের আইন প্রণয়নের প্রাক্কালে ইতিহাস একটু ঘেঁটে দেখা দরকার।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষদিকে অথবা মে মাসের শুরুতে ধ্বংসপ্রাপ্ত রমনা কালী মন্দির (রমনা কালীবাড়ি) ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে পাকিস্তানি হানাদাররা আবার হামলা চালায়। স্বাধীনতার পর মন্দির ও আশ্রমের ভগ্নাবশেষ গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা বুলডোজার চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। সরিয়ে ফেলা হয় এর ধ্বংসস্তূপ।
তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান ছিল ঢাকা ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে। স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে মদ, জুয়া, রেস বন্ধ করার পর জায়গাটুকু গণপূর্ত বিভাগের উপর ন্যস্ত হয়। মন্দির ও আশ্রমবাসী যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলার পর পালিয়ে গিয়েছিলেন তারা বিভিন্ন আশ্রয় থেকে স্বাধীনতার পরপর এখানে ফেরত আসেন। তারা যথারীতি অস্থায়ী মন্দির গড়ে পূজা-অর্চনা শুরু করেন। পুনরায় ঘরবাড়ি বানিয়ে আশ্রমবসীরা থাকতেও শুরু করেন সেখানে।
জাতীয় তিন নেতার মাজার-সংলগ্ন শাহবাগ জামে মসজিদের খাদেম ও রমনা কালীমন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরির বন্ধু আবদুল ফকির স্বাধীনতার পর রমনা কালীমন্দির ও আশ্রম নির্মাণের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি স্মারকলিপি দেন। সঙ্গে থাকেন পরমানন্দের স্ত্রী সুচেতা গিরি এবং আশ্রমের সন্ন্যাসিনী জটলী মা। ১৯৭৩ সালের শেষদিকে রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের বাসিন্দাদের রাজধানীর পোস্তগোলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শ্মশান-সংলগ্ন বালুর মাঠে তারা বসবাস শুরু করেন। তাদের কিছু তাঁবু সরবরাহ করা হয়। তারা সেখানে কয়েকটি ঘরও তোলেন। তাদের জন্য রেশনেরও ব্যবস্থা করা হয়।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসন বন্দুকের মুখে সেখান থেকে তাদের উচ্ছেদ করে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য বলে। সেখানে স্থাপন করা হয সেনা সংস্থাপন। তখন থেকে আশ্রম ও মন্দিরবাসীরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েন। অনেকে ভারতে চলে যান। সুচেতা গিরি ১৯৯২ সালে ভারতে যান। জটালী মা মারা যান। মহাকালের কাছে এ ইতিহাস হয়তো কোনো এক বিন্দু স্পর্শও রেখে যেতে পারবে না। তারপরও একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনেক কান্নাজড়ানো এ ইতিহাস কেউ না কেউ মনে করবেন।
বর্তমানে রমনা কালীবাড়ি দেবোত্তর সম্পত্তি কিনা এ নিয়ে ঢাকার জেলা জজ আদালতে ও হাইকোর্টে মামলা রয়েছে। দীর্ঘ ৩০ বছর পর ২০০০ সালে এ মন্দিরে শারদীয় দূর্গাপূজা শুরু হয়। এখানে আরও নতুন মন্দির হয়েছে যেটি মূল মন্দিরের সঙ্গে ছিল না।
সরকারি আমলাতন্ত্র কী রকম দুনীর্তিগ্রস্ত তা সবাই আমরা দেখছি। তারা পারবে না এমন কোনো কাজ নেই। এমনিতেই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুনীর্তির ভারে টালমাটাল। অনিয়মে রুগ্ন আর কৃশ। তা না হলে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানকেই কেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাছে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে?
প্রস্তাবিত এ আইনের ৬ এবং ৭ ধারায় দেবোত্তর বোর্ডের কেন্দ্রীয় কমিটির ১৭ জন সদস্যের মধ্যে ১২ জন থাকবেন গণ্যমান্য হিন্দু। কিন্তু আমাদের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমি আগাম সিদ্ধান্ত নিয়ে বলতে পারি যে এরা সবাই হবে সরকারি দলের সদস্য। সরকার যা বলবে সবকিছুতেই তারা হ্যাঁ বলবে। তাদের মুখে না শব্দটি থাকবে না। ধর্মীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হলেও তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা থাকবে না।
সন্দেহ নেই, দেবোত্তর সম্পত্তি এং মঠ-মন্দিরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন আইন প্রয়োজন। কিন্তু উপরে উল্লিখিত ধারাগুলো অবশ্যই সংখ্যালঘু ধর্মীয় সত্তাকে পীড়নের আরও একটি সরকারি কালো উদ্যোগ হিসেবেই আমি মনে করি। যেটি এ রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সুবাতাস বয়ে আনবে না।
প্রকাশ বিশ্বাস : আইনজীবী ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আদালত প্রতিবেদক।