Published : 01 Aug 2010, 08:05 PM
শুক্রবার (৩০ জুলাই) সকালেই শুনতে পেলাম গার্মেন্ট শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছে। এটাই হবার কথা ছিল। তার আগের দিন বৃহস্পতিবার বিকালে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনীয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন মজুরী বোর্ডের নির্ধারিত সর্বনিম্ন মজুরির একটি কাঠামো ঘোষণা দিয়েছেন। শ্রমিক সংগঠনগুলো এতোদিন সর্বনিম্ন মজুরি ৫০০০ টাকা করার যে দাবী করে এসেছে, তা রক্ষা করা হয় নাই, ঘোষিত সর্বনিম্ন মজুরী হচ্ছে ৩০০০ টাকা। যা চেয়েছে তার কাছাকাছিও নয় যে মেনে নেবে। ফলে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়েছে, এই ক্ষোভ আরো নিশ্চয়ই বাড়বে। সরকার শ্রমিকদের বিক্ষোভের বিষয়টি নৈরাজ্য ও ষড়যন্ত্র ইত্যাদি হিসাবে আখ্যায়িত করে শ্রমিকদের সাবধান করে দিচ্ছেন, ফাঁদে পা না দেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার, কিন্তু একবারও কি শ্রমিকের দিক থেকে বিষয়টি দেখা যেতো না?
আমরা মনে করি সরকার মালিক পক্ষের কথা যতো ভেবেছেন শ্রমিক পক্ষের কথা ততটা ভাবেন নি। হতে পারে সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীদের অনেকেরই নিজেদের গার্মেন্ট কারখানা আছে। কাজেই এই সিদ্ধান্তের সাথে তাদের স্বার্থও জড়িত। যে শিল্পের মূল মন্ত্রই হচ্ছে সস্তা শ্রমিক, (এবং সে কারণেই তো ৮৫% নারী) সে শিল্পের চরিত্র বদল করা তাদের কাজ নয়। শ্রমিককে যতো কম টাকা দেয়া যায় মালিকের ততই লাভ। গত শতাব্দীর আশির দশকে যে কিশোরী এই কারখানায় যে কোন মূল্যে কাজ করেছে মাথা নিচু করে, শোষণ নির্যাতন যা হয়েছে মুখ খোলেনি, একটুও।
এই কয় দিন আগেও একজন নারী শ্রমিককে গার্মেন্ট কারখানার ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। আগুনে পুড়ে কত মেয়ে মরেছে। এত কষ্টের মধ্যেও শ্রমিকরা টিকিয়ে রেখেছে এই শিল্পকে অথচ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে বলে সরকারের কাছ থেকে সুযোগ নিয়েছে মালিকরা। শ্রমিকদের কম মজুরী দেয়াও এই সুযোগেরই অংশ। এখন তাঁরা কেনই বা মেনে নেবেন এই বাড়তি মজুরীর বোঝা?
প্রতিটি সরকার মালিক পক্ষকে আদর যত্ন করেছে, সুযোগ সুবিধা দিয়েছে, এখন শ্রমিকদের কথা তাঁরা কেন শুনবেন? আর যদি শ্রমিকের মজুরী বেশি দিতেই হয় তাহলে তাদের সুবিধাগুলোও বাড়াতে হবে। আমি বুঝে কুল পাচ্ছি না শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরীর দাবীর সাথে মালিক পক্ষের ব্যবসায়িক সুযোগ সুবিধার শর্তের কথা আসে কেন? নিম্নতম মজুরী বোর্ডের স্থায়ী শ্রমিক প্রতিনিধি পত্র-পত্রিকায় বলেছেন এই সব শর্ত ঘোষিত মজুরী বাস্তবায়নের সাথে কোন ভাবেই যুক্ত নয়। আমার সব চেয়ে অবাক লেগেছে যে শ্রমিকদের দাবী মানা হ্য় নি, তা সত্ত্বেও মালিক পক্ষ বলছেন বাস্তবায়ন করতে চার মাস লাগবে। এটা খুব অন্যায় এবং অহেতুক দাবী। এর মাধ্যমে মালিকপক্ষ নিজেই প্রমাণ করছেন শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টির জন্য ইন্ধন যোগাবার জন্য বাইরের কাউকে দরকার নেই, তাদের অন্যায় আচরণই শ্রমিকদের ক্ষুব্ধ করার জন্য যথেষ্ট। মালিক পক্ষ থেকে ন্যূনতম ৫০০০ টাকা মেনে নেয়ার জন্য সময় চাইতে পারতেন, তাতে শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ মেনেও নিত হয়তো বাধ্য হয়ে, কিন্তু এখন কি তা মেনে নেয়া সম্ভব?
আর কয় দিন পর রোজা, তার পরেই ঈদ। সারা বছর এই হাড়ভাঙা খাটুনি খাটার পর মজুরী এতোই কম যে পরিবারে সবার জন্য কিছু কিনতে পারার ক্ষমতাও শ্রমিকদের অনেকের থাকে না। অন্তত যারা এই নিম্ন মজুরী পাবার জন্যে দাবী করছে তারা ঈদের আগে বাড়তি মজুরী পেলে তাদের সুবিধা হোত, কিন্তু মনে হয় গার্মেন্ট মালিকরা তাদের ঈদ শপিং কম করতে চান না। শ্রমিকদের এতো টাকা দিয়ে দিলে তাদের ঘাটতি পড়তে পারে, তাই কি? শ্রমিকদের মজুরী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নভেম্বর পর্যন্ত সময় নেয়া ও শর্ত জুড়ে দেয়ার কোন বিষয় থাকতে পারে না। তবে মজুরী বোর্ডও বাস্তবায়ন করার জন্য কেন কোন সময় বেঁধে দিয়ে বলেন নি, তাও পরিষ্কার নয়। মালিক পক্ষকে এই অহেতুক দাবী তোলার সুযোগ দেয়া তাঁদের উচিত হয় নি।
গার্মেন্ট শ্রমিকরা যে দাবি তুলেছেন তার কারণে এই শিল্পের ক্ষতি হবে বলে যারা মন্তব্য করছেন তাঁরাও পক্ষান্তরে মালিকের পক্ষে এবং শ্রমিকের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন অর্থনীতির হিসাব দেখিয়ে। আমরা জানি, বিশ্ব বাজারের অবস্থা, গার্মেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের দাম বেড়েছে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু একই সাথে এটাও সত্য যে জীবন যাত্রার মান রাখার জন্যে খাদ্য, ঘর ভাড়া, যাতায়াত খরচ সবই বেড়েছে। এমনকি স্বাস্থ্য সেবা নেয়ার জন্য সরকারী হাসপাতালে গেলে সেখানেও ইউজার ফি'র নামে প্রতি পদে টাকা গুনতে হয়। যারা ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছে তাদের পক্ষে এই বেতন দিয়ে কোনভাবেই চলা সম্ভব নয়। কই সরকার তো গার্মেণ্ট শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য কোন ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন না।
আমরা দেখেছি, মালিক পক্ষ যেমন গার্মেন্ট কারখানা ভালবাসেন তার চেয়ে শ্রমিকরা কোন অংশে কম ভালবাসেন না। বরং স্বার্থের দিক থেকে দেখতে গেলে এই শিল্প যেন বাংলাদেশে থাকে এবং উন্নতি করে তা সরকার এবং মালিক কারো চেয়ে তারা কম চান না। তাদের বেঁচে থাকার উপায় এবং মাধ্যম এই শিল্প। শুক্রবারে আন্দোলনরত নারী শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই রেডিও সাক্ষাতকারে বলছিলেন, নিজে কাজ করে ছোট ভাইকে পড়াচ্ছে; স্বামী ছেড়ে চলে গেছে, এখন ছোট ছোট বাচ্চাদের মানুষ করার দায়িত্ব তার। অনেক মেয়ে এখন পরিবারে পুত্র-সন্তানের মতো দায়িত্ব পালন করছে।
কাজেই ষড়যন্ত্র করে এই শ্রমিকরা এই শিল্পকে ধ্বংস করবে, এমন ধারণা করার সুযোগ নেই। কোন মহল যদি এই ষড়যন্ত্র করে এবং শ্রমিকদের কোন অংশকে ব্যবহার করে তাহলেও সরকার এবং মালিক পক্ষকেই এর দায়দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ আন্দোলনের শর্ত তারাই তৈরী করছে। একজন শ্রমিক তার নিজের বেঁচে থাকার প্রয়োজন থেকেই বিচার করবে, তার ন্যায্য মজুরী দিতে গিয়ে একেবারে শিল্পই ধ্বংস হয়ে যাবে এমন হিসাব কষতে বসার কাজ তার নয়।
ঈদের আগেই এই ব্যাপারে একটা সুরাহা হবে, আমরা সবাই দেশের স্বার্থে এবং শ্রমিকদের স্বার্থে এটাই আশা করছি।