Published : 30 Jun 2013, 11:16 AM
প্রস্তাবিত বাজেটে যে তেমন কোনো সংশোধনী আসছে না, মিডিয়ায় আসা অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যেই সেটি স্পষ্ট। তাও অর্থবিল পাসের আগে সরকারের প্রধান নির্বাহী তথা প্রধানমন্ত্রী কিছু সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছেন এর মধ্যে। সে মতো সংশোধনী আনা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সংসদের বাইরে বাজেট নিয়ে যেসব গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে, তাও বিবেচনায় আনা হবে।
সত্যি বলতে, সংসদের বাইরেই কিছু পর্যালোচনা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর। সংসদের ভেতরে হয়েছে মূলত খিস্তিখেউর। এটা হয়েছে দুপক্ষ থেকেই। কোনো বাজেট অধিবেশনে এত খিস্তি হয়েছে বলে মনে হয় না। অনেকেই এখন বলবেন, বিরোধী দল এ অধিবেশনে না গেলেই ভালো হত। তাহলে ওসব শুনতে হত না জাতিকে। মুশকিল হল, এসব সরাসরি সম্প্রচারিত হয় আজকাল। সংসদে একটা শিশু গ্যালারিও আছে। এগুলোর ব্যবস্থা যখন করা হয়, তখন এর কুফল নিয়ে বোধহয় বেশি ভাবতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
খিস্তি বেশি আউড়েছেন সংরক্ষিত আসনে সংসদে আসা কয়েকজন নারী সদস্য। স্পষ্টতই তারা সংসদ সদস্য হয়েছেন দুই প্রধান দলের নেত্রীর ইচ্ছায়। নেত্রীদ্বয়ের ইচ্ছার বাইরে তারা খিস্তিখেউর করেছেন বলেও মনে হয় না। বাজেট আলোচনার সুযোগে তারা মূলত টার্গেট করেছেন দুই নেত্রী ও তাদের পরিবারকে। 'মাইনাস টু'র শংকা ব্যক্ত করেন দুই নেত্রী। প্রধানমন্ত্রী তো প্রায়ই বলেন, ওই তত্ত্বের প্রবক্তারা এখনও সক্রিয়। কিন্তু সংসদে তাদের নিয়ে যেসব খিস্তি হয়ে গেল আর করলেন তাদেরই পছন্দে সংসদে আসা কয়েকজন নারী– এতে কি 'প্লাস' হচ্ছেন দুই নেত্রী?
এসব নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বক্তব্য অবশ্য প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, খোদ প্রধানমন্ত্রীকে এর দায় নিতে হবে। কেননা তিনি যে ভাষায় বক্তব্য দেন, তাতে এসব খিস্তির প্রবণতা বাড়ে। চলতি অধিবেশনে তারা কে কীভাবে কখন দিন শুরু করেন, এর বর্ণনা দিতে গিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। ধর্মনির্দেশিত জীবনাচরণ করেও 'নাস্তিক' অভিধা পাচ্ছেন বলে আক্ষেপ প্রকাশ করতেই তাঁর ওই বক্তব্যের অবতারণা, সেটা বোঝা যায়।
প্রতিপক্ষের নেত্রীর বিষয়ে মন্তব্য না করেও সেটি প্রকাশ করা যেত কিনা জানি না। প্রধানমন্ত্রীর জন্য এ আক্ষেপ প্রকাশ বেমানান। নিজেকে ও নিজের রাজনীতিকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরবেন তিনি, এটাই কিন্তু প্রত্যাশিত। যদি সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইচ্ছাতেই এটি না ঘটে থাকে তো ওই নারী সদস্যের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত হবে তাঁর। সংসদে এবার কারা খিস্তি শুরু করেছে, সে কূটতর্কে না গিয়ে সরকারপক্ষের উচিত হবে ওই সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। বিএনপি কী করছে বা করবে, সেটি দেখার দরকার নেই। সরকারপক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে প্রমাণ করুক খিস্তিখেউর বন্ধে তার সদিচ্ছা আছে।
স্পিকার বিধিমতো যতটুকু করার করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে একজন নারী স্পিকারের বিব্রতকর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। কে না জানে, তিনি স্পিকার হয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়। সংসদে কী হবে না হবে, কীভাবে এটা চলবে, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বড় ভূমিকা রয়েছে। এদেশে প্রধানমন্ত্রীই তো হয়ে থাকেন সংসদ নেত্রী।
খিস্তি বন্ধে সরকারি দলের একজন সদস্য জরিমানার প্রস্তাব দেওয়ায় সেটি প্রায় লুফে নিয়েছেন বিরোধী দলের সিনিয়র সংসদ সদস্য মওদুদ আহমেদ। এতে সাধারণের কিন্তু মনে হবে, বিরোধী দল চাইছে খিস্তি বন্ধ হোক সংসদে। সরকারি দলও যে তা চাইছে, সেটি প্রমাণ করুন তারা। সংসদে তারা এতটাই সংখ্যাগুরু যে বিরোধী দলকে প্রায় দেখাই যায় না। সংসদে তারা আসেনও মাঝে মাঝে– সদস্যপদ রক্ষায়, কখনও কৌশল হিসেবে। তারা যাতে এখানে বেশিদিন থাকতে পারেন, সেজন্যও খিস্তিটা বন্ধ হওয়া দরকার। বিরোধী দলের খিস্তির মুখটাও সরকারপক্ষকে বন্ধ করতে হবে।
বিরোধী নেত্রীর একটা শক্তির দিক হল, অরাজনৈতিক বা দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দিলেও তিনি সাধারণত প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কথা বলেন না। প্রধানমন্ত্রী মাঝে মাঝে এটা করেন। বিরোধী নেত্রী থাকাকালেও এটা করতে দেখা গেছে তাঁকে। এতে কী লাভ হচ্ছে কে জানে। তবে ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতায় দৃশ্যতই পিছিয়ে পড়ছেন তিনি। এবারও দেখা গেল, সংসদ বা এর বাইরে তেমন কোনো বাদানুবাদেই শামিল হলেন না বিরোধী নেত্রী। বলিয়ে থাকলে তার পছন্দের কয়েকজন এমপিকে দিয়েই বলিয়েছেন।
মজার বিষয়, পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হয়ে আসা মাত্র কয়েকজন সদস্য যখন এসব বক্তব্য রাখেন, তখন দুপক্ষের শত শত সদস্য প্রতিবাদ করেন না সংসদে। তারা হয়তো জানেন, ওইসব সদস্যকে দিয়ে এগুলো বলানো হচ্ছে 'উপর থেকে'। স্পিকারও তাদের মাইক বন্ধ করে দিতে মাঝে মাঝে পড়ে যান দ্বিধায়। কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা নাকি তার নেই।
এ জায়গায় কোনো সংশোধনী আনা হবে কিনা, সেটিও নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। সরকার ও সংসদে তিনিই তো সর্বেসর্বা। বর্তমান বিরোধী নেত্রীও তাই ছিলেন ক্ষমতায় থাকাকালে। তবে তার সময়ে সংসদে বোধহয় এর চেয়ে কম খিস্তিখেউর হয়েছে। কম হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আগের শাসনামলেও।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে ও হচ্ছে– এমনকি দ্রুতগতিতে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিই দেখা যাচ্ছে নিম্নগামী। সংসদে দুই নেত্রী ও তাদের পরিবার নিয়ে খিস্তি তারই একটা প্রকাশ। এ ক্ষেত্রে দুপক্ষের প্রয়াত রাজনীতিক ও অরাজনীতিকদের নিয়েও বাজে গল্প বা মন্তব্য করা হচ্ছে। হায়, তাদের তো সুযোগ নেই এসবের জবাব দেওয়ার। আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদেরই দায়িত্ব এঁদের মর্যাদা রক্ষার।
আমরা যারা সাধারণ, তাদের হাতে অবশ্য কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতায় থাকলে কার্যপ্রণালী বিধিতে এমন সংশোধনীই হয়তো আসত, যার বলে স্পিকার 'সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস' ডেকে খিস্তিকারীকে অধিবেশন কক্ষ থেকে বের করে দিতে পারতেন। কে জানে, তখন হয়তো আবার দেখা যেত স্পিকার বিরোধী দলীয় সদস্যদের ওপরই বেশি করে ব্যবহার করছেন ওই অস্ত্র। সেটি হয়ে যেত আরেকটি ইস্যু।
বিরোধী দলের হাতে ইস্যু তুলে না দিয়ে সরকারের উচিত ছিল আরও একবার ক্ষমতায় আসার জন্য দেশটা ভালোভাবে পরিচালনা করা। সে রকম মোটিভেশন তার মধ্যে এ পর্যন্ত দেখা গেল না। বড়মাপের ভালো কাজ যে তারা করেননি, সেটি তো নয়। সাফল্যের লম্বা তালিকাই দেওয়া যাবে। সেটি ছাড়িয়ে যাবে বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারকে। তারপরও সত্য যে, চারটি গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একযোগে হারলেন সরকারি দল সমর্থিতরা। তারা নন– হেরেছে নাকি সরকার!
এমন পরাজয়ের পরই সংসদে শুরু হল খিস্তি। বিরোধী দলের কোনো এক নারী সদস্যই হয়তো শুরু করেন এটা– অতিউৎসাহে। সরকারপক্ষের উচিত ছিল এতে আরও খারাপভাবে শামিল না হয়ে তাদের মুখ বন্ধ করা। দুর্ভাগ্যজনক যে, আক্ষেপ প্রকাশ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীও বিরোধী নেত্রীকে করে বসলেন আক্রমণ। অপ্রত্যাশিত বিজয়ের আনন্দে যিনি ভাসছেন বহুদিন পর, তাকে আক্রমণ করে কী লাভ?
মুশকিল হল, এতে জনগণকে বোঝার মানসিকতার দুর্বলতাটা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। কে কীভাবে জীবনযাপন করেন তা নয়– মানুষ দেখছে কার রাজনীতি কেমন; কে কাদের সঙ্গে আছেন, কী করছেন, কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, কার অভিমুখ কোনদিকে। কার বা কোন দলের দেশপরিচালনা কেমন, সেটিও কি তারা নিজেদের মতো করে দেখছে না? এতে কি নিহিত নেই ক্ষমতাসীনদের কাছে বেড়ে ওঠা প্রত্যাশাও? ক্ষমতাসীনরা যে জনগণকে আরও বেশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটি তারা ভুলে গেলেও লোকে কিন্তু ভোলেনি।
ওয়ান-ইলেভেনের অভিজ্ঞতার নিরিখে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানোন্নয়নের কথাও তারা জোর দিয়ে বলেছিলেন। তাহলে সংসদে উচ্চারিত বাজে কথায় শামিল হওয়ার বদলে সেটি বন্ধে তারা উদ্যোগী হবেন না কেন? দুই নেত্রী যাদের পছন্দ করে সংরক্ষিত নারী আসনে নিয়ে আসছেন, তাদের কাছে কারও তেমন প্রত্যাশা আছে বলে মনে হয় না। অসম্ভব ক্ষমতার অধিকারী বলে প্রত্যাশা দুই নেত্রীর কাছেই; বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
যে নারী ও পুরুষ সদস্যরা এ অধিবেশনে বাজেট আলোচনার নামে মুখ নোংরা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কিছু একটা ব্যবস্থা নিক দল। আবার বলি, এমন পরিস্থিতি রোধে স্পিকারের হাত শক্তিশালী করতে কার্যপ্রণালী বিধিতে কিছু সংশোধনীও আনা যায়। এর প্রভাব হয়তো পড়বে সংসদের বাইরেও। সেখানেও তো খিস্তিখেউর নিরুৎসাহিত হওয়া দরকার।
এদেশের মানুষের শুধু তো পয়সাকড়ি হচ্ছে না, শিক্ষাদীক্ষায়ও উন্নতি হচ্ছে। একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যাতায়াত করছে দেশের বাইরে। টিভি ও ইন্টারনেটে কত কী দেখছি আমরা। এর প্রভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিছুটা হলেও পাল্টাক এবার। বাজে কথার বদলে কিছু কাজের কথা হোক সংসদে।
এটা তো আসলে সরকারের জবাবদিহির জায়গা। খিস্তিখেউর হলে সেটিও যে দুর্বল হয়ে যায়, তা অবশ্য বেশি করে দেখার কথা বিরোধী দলের। সরকারের কাজ নিয়ে খিস্তি হলে তাতেও না হয় জনগণ কিছু সারবত্তা খুঁজে পেত। হেলাল হাফিজের যে কবিতাংশ সংসদে চিৎকার করে পড়েছেন একজন বিরোধীদলীয় নারী সদস্য, তিনি কি জানেন কবি ওইসব লিখেছিলেন এদেশের বিরাট এক জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা ও ক্রোধ প্রকাশ করতে? ইতোমধ্যে তাদের সে অবস্থায় কতটা কী পরিবর্তন এসেছে, সেটি হল রাজনীতির এক বড় দিক।
সেদিকে তাকানোর বদলে নেতানেত্রীর উচ্চকিত প্রশংসা ও এর বিপরীতে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তাদের নিন্দামন্দ আর কত শুনব আমরা?
ক্লান্ত লাগে তো!
হাসান মামুন : সাংবাদিক।