Published : 27 Jun 2013, 02:32 AM
পুঁজিবাদী তথা গণতান্ত্রিক পথ-পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তনের একমাত্র বৈধ উপায় হচ্ছে নির্বাচন। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এ নির্বাচন পদ্ধতি কাঠামোবদ্ধ রূপ পেলেও অনুন্নত দেশগুলোতে তা এখনও কাঠামোর বাইরেই রয়ে গেছে। ফলে এসব দেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অনিবার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে শঙ্কা, সহিংসতা, ভোটচুরি, কালো টাকা আর পেশিশক্তির আধিপত্য।
অনুন্নত ও বিকাশমান গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। তখন ক্ষমতায় ছিল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে থাকা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বিরোধী দলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। যুদ্ধপরবর্তী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় নির্বাচন প্রক্রিয়া কাঠামোবদ্ধ করার কোনো সুযোগই মেলেনি সে সময়ের সরকারের। বিস্তর অভিযোগসমৃদ্ধ একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকার হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ।
এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে এদেশে শুরু হয় কালো এক অধ্যায়ের। যা চালু থাকে নব্বইয়ের নাগরিক গণঅভ্যুত্থান অবধি। পঁচাত্তর থেকে নব্বই– দীর্ঘ এ সময়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক শাসনে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সর্বোপরি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। বিপর্যস্ত করে ফেলা হয় দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম নির্বাচন কমিশন।
নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে দেশে আবারও ফিরে আসে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা। দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থেকেও নিজেদের জনগণের আস্থার জায়গায় নিতে যারপরনাই দ্বিধায় পড়ে যায় রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের মধ্যে সমঝোতা হয় নির্বাচন সময়ে দেশের দায়িত্বে থাকবে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যাদের কাজ হবে রাষ্ট্রিক দৈনন্দিন কাজ করার পাশাপাশি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
এতে আপাতভাবে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও, ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেও, একটি স্বাধীন ও সমর্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়ে নির্বাচন কমিশন। ধারণাজগত থেকে খানিকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় দেশপরিচালনায় বিরাজনীতিকরণের প্রয়াস।
বিরাজনীতিকরণের এ প্রয়াস মানুষের মনোজগতে জায়গা করে নেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়ার পর জনগণকে দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে দুর্বৃত্ত হয়ে ওঠার সংস্কৃতি। আর এ সংস্কৃতির বাস্তবায়ন ঘটাতে গিয়ে নেতাকর্মীদের দিতে হয় রাষ্ট্রিক সব প্রশ্রয়।
ফলে বিপুল ভোটে বিজয়ী দলটি ক্ষমতার পাঁচ বছরে হয়ে পড়ে জনবিচ্ছিন্ন কিংবা কোনো কোনো সময় জনধিকৃত। আর তাই আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতায় আশ্রয় নিতে হয় কালো টাকা, সন্ত্রাস ও পেশিশক্তির।
এমনি সব রাজনৈতিক সন্ত্রাস করতে যেহেতু প্রচুর অর্থের দরকার হয় তাই এ ক্ষেত্রে সবসময়ই এগিয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। যাদের বেশিরভাগই আবার কালো টাকার মালিক। কালো টাকার আধিপত্যে খুব সহজেই এমপি হিসেবে লড়াইয়ের দৌড়ে মনোনয়ন পেয়ে যান তারা। কোনোভাবেই জায়গা পান না দীর্ঘদিন ধরে দল করা ত্যাগী নেতারা কিংবা সমাজে সজ্জন হিসেবে পরিচিত মানুষেরা। যে কারণেই আমরা দেখি সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের ক্রমবর্ধমান মাত্রায় অংশগ্রহণ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জরিপ বলছে, বর্তমান সংসদের সদস্যদের মধ্যে ব্যবসাই প্রধান পেশা এমন সদস্যসংখ্যা ৫৯ শতাংশ।
রাজনীতিতে কালো টাকার মালিক সব ব্যবসায়ীদের ক্রমবর্ধমান মাত্রায় অংশগ্রহণ আর রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়ার ও ক্ষমতা ধরে রাখার জনবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি মারাত্মক সংকটে ফেলে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র মাধ্যম নির্বাচন প্রক্রিয়াকে। সাধারণ মানুষ আস্থা হারায় ভোটের রাজনীতিতে।
এ পরিস্থিতিতে শাসনব্যবস্থার সংকট তীব্রতর হচ্ছে অনুধাবন করতে পেরে শাসকশ্রেণিই জন্ম দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির। যার মূল ও প্রধান কাজ নির্ধারিত হয় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সফল করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ কাজ সফল করার পেছনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা রাখে দেশের সামরিক বাহিনী।
নব্বইয়ের নাগরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তিনবার। তবে এসব নির্বাচনেও সূক্ষ্ণ কারচুপির অভিযোগও করেছে পরাজিত দল। সবশেষ ২০০৬ সালে স্বাভাবিক নিয়মে দায়িত্ব নেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে দুটি রাজনৈতিক দলের সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির ফল হিসেবে বিশেষ এক পরিস্থিতিতে পড়তে হয় এ সরকারকে। সে পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনেকটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়ে সামনে চলে আসে সামরিক বাহিনী। টানা দুবছর ক্ষমতা ধরে রাখে সে সরকার।
সে শাসনের প্রথমদিকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুশাসন এবং রাষ্ট্রিক কাজকর্মে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার মতো জনকাঙ্ক্ষিত ইস্যু বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়ায় তাদের স্বাগত জানায় দেশের মানুষ। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসায় দক্ষতা দেখায় তারা। এমনকি দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ দু নেতাকেই নেওয়া হয় কারাগারে।
কিন্তু এক পর্যায়ে খেই হারিয়ে ফেলে বিশেষ এ সরকার। আবারও নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়; আর তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা নিয়ে প্রথমেই যে কাজটি করে তা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করে যাওয়া 'না' ভোটের বিধানটি বাতিল করে দেওয়া।
এতে ফের প্রমাণিত হয়, জনগণের সমর্থন তথা ভোট নিয়ে ক্ষমতায় এলেও এসব রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে বেশি ভয় জনপ্রত্যাখ্যান। কেননা এরা ক্ষমতার পাঁচ বছরে জনকল্যাণে কাজ করে খুব কমই। তা সে আওয়ামী লীগই বলুন, আর বিএনপিই বলুন, দুদলই এ ক্ষেত্রে একই ভূমিকায়।
বিএনপির বিস্তর দুর্নীতি আর সরকারি সম্পদ লুটপাটের সংস্কৃতিতে বীতশ্রদ্ধ দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনলেও তারা এক রকম একই পথে পা বাড়ায়। সৃষ্টি হয় হলমার্ক, পদ্মা সেতু ও রেল-কেলেঙ্কারির মতো বড় ধরনের দুর্নীতি ও লুটপাটের উদাহরণ।
তারপরও আমি বলব, রাজনৈতিক সুশাসনের পথে এগোনোর একটা চেষ্টা কিন্তু আওয়ামী লীগের ভেতরে চালু থাকে। আর সে জন্যই আমরা দেখি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, এদেশকে পাল্টাতে হলে আগে আওয়ামী লীগকে পাল্টাতে হবে। এমনকি খোদ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ''কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতে হবে।''
প্রধানমন্ত্রীর এ সাহসী উচ্চারণের মর্মার্থ খোলাসা হয় সদ্য হয়ে যাওয়া চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটের ফলাফলে। যে ফলাফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পুরনো সহিংস ও ভোটচুরির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। চারটি সিটি কর্পোরেশনের বিজয়ী হয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটসমর্থিত প্রার্থীরা। যদিও এ বিজয়ে বিরোধী দলের আচরণ সে পুরানো সংস্কৃতিতেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
তবে এ ফলাফলে মনে হয়েছে, দেশে রাজনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সহজ করতে আওয়ামী লীগ নিজেকেই 'বলি' দিয়েছে। এছাড়া গণজাগরণের সোচ্চারণে সরকারের তথা আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক নৈতিক সমর্থন আর হেফাজতে ইসলামের মতো ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে নতি স্বীকার না করাও একটি অসাম্প্রদায়িক সুশাসনের বাংলাদেশের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগের কার্যকর অংশগ্রহণ।
আসলে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা তো কাউকে না কাউকে বাঁধতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশে আর্থ-রাজনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজটি করতে কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। তাকে 'বলি'ই বলি বা দায়িত্ব নেওয়াই বলি– কাজটি করাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের জন্য।
তবে বাংলাদেশ টাইমলাইনের ইতিহাস যদি আমরা দেখি তাহলে বলতে হয়, কাজটি করার প্রথম সুযোগ আসে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সংক্ষেপে যদি বলি, সে সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও যুদ্ধকালীন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বন্দ্বের কারণেই তা সম্ভব হয়নি।
আরেকটি সুযোগ আসে ওয়ান-ইলেভেনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বিশেষ সে সরকারের প্রথমদিকের উদ্যোগ ও ইচ্ছায় তা সম্ভব হবে বলে মনে হলেও পরে তাদের পথবিচ্যুতির কারণে ভেস্তে যায় সব। তবে এবার আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ ও ইচ্ছা আবার আমাদের আশাবাদী করে তুলছে।
আমরা আশাবাদী হচ্ছি বাংলাদেশ যে চরিত্রের রাষ্ট্র হওয়ার জন্য স্বাধীন হয়েছিল সে দিকেই হয়তো যাত্রা শুরু করছে।
সেলিম খান : সংবাদকর্মী।