Published : 12 Jun 2013, 11:51 PM
বাজেটের রাজনৈতিক অর্থনীতির মূল সূত্র হচ্ছে বাজেটের শ্রেণিগত ভিত্তি চিহ্নিত করা। অর্থাৎ বাজেটের আয়-ব্যয়ের মাধ্যমে কোন শ্রেণির প্রতি সরকার পক্ষপাতিত্ব করছে সেটি নির্ণয় করা হচ্ছে বাজেটের রাজনৈতিক-অর্থনীতি নির্মাণ করা। যেহেতু এটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা উত্তরণশীল একটি দেশের জাতীয় বাজেট, ফলে এখানে দেশের সকল শ্রেণি এ বাজেট কেন্দ্র করে তদবির করে, দাবি উত্থাপন করে, প্রতিযোগিতা করে যাতে বাজেটের বেশি অংশ তার পক্ষে যায়।
অর্থনীতির ভাষায়, বরাদ্দের ধরন এমন হয় যাতে লাভটা ওই শ্রেণির হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি সরকারের ওপর চাপ দেয়। এ চাপের একটি অভ্যন্তরীণ ও অন্যটি আসে বাইরে থেকে। বাইরে যে প্রতিষ্ঠান বা দেশ রয়েছে তাদেরও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে একটা সম্পর্ক রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি পরস্পর মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে পরস্পরকে প্রভাবিত করে।
অভ্যন্তরীণ শ্রেণিসমূহ ও বাইরের শক্তিসমূহের ভারসাম্য- দুটো মিলিয়ে চূড়ান্তভাবে বাজেটের শ্রেণিগত ভারসাম্য নির্ধারিত হয়। ফলে যে প্রশ্ন দিয়ে আমি শুরু করেছিলাম সে প্রশ্নের উত্তর খুবই জটিল।
বিরোধী দল ও কোনো কোনো বামপন্থী দল সচরাচর বছরের পর বছর যেরকম একটি সাধারণ, বিমূর্ত ও একরৈখিক কায়দায় নেতিবাচক বাজেট-প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছেন তাতে বাজেটের এ জটিলতা পূর্ণাঙ্গভাবে ধরা পড়ে না। জনগণও ভাবতে থাকে, বাজেট নিয়ে গভীর কিছু ভাবার নেই, সরকারি দল একে প্রশংসা করবে এবং বিরোধী দল এর নিন্দা করবে!
সুনির্দিষ্ট, ঐতিহাসিক ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাজেট বিশ্লেষণ করলে কিন্তু কিছু এদিক-ওদিক মিশ্র জটিলতা দেখতে পাব। যদি শ্রেণিভিত্তি নির্ণয়ের কথা বলা হয় তখন বাজেটের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থার (long term feature of budget) প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।
'লং-টার্ম ফিচার অব দ্য বাজেট' বলতে কী বোঝায়? বর্তমান ও পূর্বের অনেকগুলি বাজেট একত্রে দেখলে এ বৈশিষ্ট্যগুলি আলাদা করে চিহিৃত করা সম্ভব হবে। এভাবে দেখলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আমলের বাজেটগুলির মধ্যে আলাদা দুটি সূত্র দেখতে পাব।
গণতান্ত্রিক আমলের যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। এরপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আমল পালাক্রমে আলাদা করা যাবে। পালাক্রমে প্রণীত বাজেটগুলো দু ভাগে বিভক্ত করে তুলনা করে আমরা দু দলের রাজনীতির ভিত্তি ও শ্রেণিভিত্তির মধ্যে বিরাজমান ঐক্য ও পার্থক্য নির্ণয় করতে পারব। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাজেট থেকে যদি শ্রেণিভিত্তিতে যেতে চাই তাহলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগ সরকার সবসময়ই ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি উদার। এর অর্থ হচ্ছে সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয়ের ঝোঁকটা বেশি। অর্থাৎ ওই পিরিয়ডে মুদ্রাস্ফীতি ও অস্থিতিশীলতা বেশি ছিল।
আওয়ামী লীগের শাসনামলের বাজেট-সম্পর্কিত তথ্য জোগাড় করলে বিষয়টি সহজেই প্রমাণ হবে। আওয়ামী লীগের আমলে বাজেট ঘাটতি, বাণিজ্য ঘাটতি, রাজস্ব ঘাটতি, অধিক ব্যাংকঋণ, অতিরিক্ত সামাজিক ব্যয়, ভর্তুকি- এগুলো তুলনামূলকভাবে বিএনপির তুলনায় বেশি থাকে। পাশ্চাত্য দৃষ্টিতে দেখলে দাতারা বিএনপিকে বেশি পছন্দ করবে। দাতাদের মনোযোগ স্থিতিশীলতার দিকে। বিশেষ করে মুদ্রাস্ফীতি যাতে কম হয়, ঘাটতি কম থাকে, কম রাষ্ট্রীয় ব্যয়, উচ্চ সুদের হার, কৃষিতে ভর্তুকি না থাকা, জ্বালানি, গ্যাস প্রভৃতি খাতে ভর্তুকি না থাকা প্রভৃতি হচ্ছে সাধারণভাবে নয়া উদারনীতি বা Washington Consensus -এর এজেন্ডা।
আওয়ামী লীগ যেহেতু উদার ব্যয়ে বিশ্বাসী, ফলে তারা এসব এজেন্ডার সবটুকু সবসময় মানে না। এতে দাতাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয় এবং কিছুটা চাপ থাকে আওয়ামী লীগের ওপর। এবারের বাজেটেও বিষয়টি এদকম পরিষ্কার। পদ্মাসেতু বাতিল করে দিয়েছে তারা। এর চেয়ে অনেক বেশি দুর্নীতির নজির থাকলেও অন্য অনেক দেশে তা করা হয়নি। কৃষি-ভর্তুকি নিয়েও চাপ ছিল। আইএমএফ-এর চাপে নতি স্বীকার করে শেষ পর্যন্ত লোনের বিনিময়ে সরকারকে জ্বালানির দামও বৃদ্ধি করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই দাতাদের সঙ্গে সম্পর্কে একটু একটু করে অবনতি হয়েছে।
সুতরাং পলিটিক্যাল-ইকোনমির প্রয়োগ নিরিখে, পাশ্চাত্য দাতাগোষ্ঠী বা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ যে ধরনের ইকনোমিক্যাল পলিসি বা অর্থনৈতিক নীতি পছন্দ করে সেটি প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের মেয়াদে বিএনপি আমলে যতটা সহজে বাস্তবায়ন হত, এ সরকারের আমলে তত সহজভাবে হয়নি। স্বয়ং সাইফুর রহমানের সে অসহায় উক্তির কথা নিশ্চয়ই আপনাদেরও মনে আছে, ''আমরা ড্রাইভিং সিটে বসে থাকলেও ষ্টিয়ারিংটা রয়েছে দাতাদের হাতে।" এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সত্য যা আওয়ামী লীগের শ্রেণিঅবস্থান ও জাতীয় অবস্থান নির্ণয়ের সময় আমাদের মনে রাখা উচিত।
পশ্চিমা নীতি হচ্ছে, মার্কেট-শৃঙ্খলার ভেতর এদেশে তাদের স্বার্থরক্ষা করে পরনির্ভশীল পুঁজিবাদ বিকশিত করা। প্রশ্ন হল, মার্কেট-শৃঙ্খলার ভেতর পুঁজিবাদ বিকশিত হোক, এটা কি আওয়ামী লীগ চায় না? অবশ্যই চায়। পুঁজিবাদ বিকাশের দুটো ধারা আছে। চিরায়ত বুর্জোয়া বিপ্লব যেখানে হয়েছে সেসব দেশে কমবেশি (যেমন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ইত্যাদি) ছোট-মাঝারি পুঁজিবাদ তলা থেকে আগে বিকশিত হয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠেছে।
এরপর বৃহৎ পরিসরে তাদের বিস্তৃতি ঘটেছে। যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদী মডেলের বিকাশ এভাবেই হয়েছে। তবে তারা ছিল Early Starter, আমাদের মতো Late Starter নয়! আওয়ামী লীগের হাল আমলে সেটার কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন- এসএমই, কৃষি প্রভৃতি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব ক্ষুদ্র উদ্যোগ। নিজের সম্পদের ওপর ভিত্তি করে ছোট পুঁজির ওপর নির্ভরশীল পণ্য বাজারে বিক্রি করে মুনাফা করতে চাচ্ছেন তারা।
এসএমই, কৃষিখাত (ব্যাপক ও বহুমুখী অর্থে) ছাড়াও বর্তমান সরকার রেমিট্যান্স খাতকেও বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। এ জন্য তারা পুরষ্কারও পেয়েছে। এ সময়ে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। প্রায় ১৫ বিলিয়নের কাছাকাছি। এর সঙ্গে গুরুত্ব দিয়েছে গার্মেন্টস খাতের দিকে। এ খাতও অনেক এগিয়ে গিয়েছে।
এসএমই, কৃষি, রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টস এ চার খাতকে আওয়ামী লীগ সরকার কিছু গুরুত্ব দিয়েছে, যদিও আরও গুরুত্ব দিলে উৎপাদনশীল Bottom Up Capitalist Development ত্বরান্বিত হত। পুঁজির বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে চরম উদ্বৃত্ত মুল্য আদায় করা হয়; এখানেও তাই হচ্ছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে পুঁজির অংশবিশেষ বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে, সবটা পুঁজি দেশেই বিনিয়োগ হচ্ছে না!
বিএনপির সময়কে ভালোভাবে দেখলে দেখা যাবে, তখন কৃষিখাতকে অতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে এসএমইকে ভালোভাবে গুরুত্ব দেওয়া যায়নি। দুটো একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কৃষির আয়-ব্যয় হয় এসএমই'র পণ্যের পেছনে। সুতরাং এ দুটো খাতে ঘাটতি ছিল বিএনপির। গার্মেন্ট খাতের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-দাতাসংস্থা সবাই একমত। কারণ দাতাদের কৌশল হচ্ছে, তারা ক্যাপিটাল-ইনটেনসিভ প্রোডাক্ট তৈরি করবে। আর লেবার-ইনটেনসিভ প্রোডাক্ট তৈরি করবে তৃতীয় বিশ্বের দেশ। দাতারা চায়, সস্তাশ্রমের ভিত্তিতে বাংলাদেশে গার্মেন্ট খাত আরও উন্নতি করুক।
কিন্তু এখানে দাতাদের নিজেদের মধ্যে কিছু বাধা আছে। তাদের বেশিরভাগই গণতান্ত্রিক দেশ। ফলে দেশের শ্রমসংস্থার কথা কিছুটা হলেও শুনতে হয়। সে সংস্থাগুলো চায় না, সমস্ত পোশাক শিল্প তৃতীয় বিশ্বে উৎপন্ন হোক। এতে তারা কর্মহীন হয়ে পড়বে। তারা একটা চাপ দেয় যাতে তৃতীয় বিশ্বে ন্যূনতম ভালো কর্মপরিবেশ তৈরি হয়। ওদের ভাবনা হচ্ছে, উচ্চমানের পণ্য তারা নিজেরাই তৈরি করবে, যাতে শ্রমিকদের উচ্চতর বেতন দেওয়ার পরও তাদের তৈরি পোশাকের প্রতিযোগিতামূলক মূল্য থাকে।
আরেকটি কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক এনজিও, আইএলও, মানবাধিকার সংস্থার শর্ত। তাদের শর্ত ন্যূনতম কর্মপরিবেশ বজায় রাখা। এটা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শ্রমিকের ন্যূনতম মূল্য যাতে বজায় থাকে, সেটি সবাই প্রত্যাশা করে। এসব কারণে গার্মেন্টস খাতের পুঁজিবাদীদের ওপর দাতাদের একটা চাপ আছে। তাদের কথা হচ্ছে, কমপ্লায়েন্স করতে হবে।
এর সঙ্গে মান বা কোয়ালিটিও নিশ্চিত করতে চায় পশ্চিমা ক্রেতারা। কিন্তু একটি শার্টের কোয়ালিটি দশটি জায়গায় পরীক্ষা করতে গেলেও তার ব্যয় বেড়ে যায়। যাহোক, দাতাদের একটা চাপ ছিল এ খাতের ওপর। তাদের কথা ছিল, এখানে যদি মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি হয় তাহলে সে অনুযায়ী শ্রমিকদের বেতনও দিতে হবে। আর যদি নিম্নমানের পণ্য তৈরি হয় তাহলে কোনো আপত্তি নেই।
এ কারণে প্রথমদিকে গার্মেন্ট শিল্পে কমপ্লায়েন্সের জন্য বিশেষ কোনো চাপ দেয়নি তারা। যখন এ শিল্পটা বড় আকার ধারণ করেছে, তাদের দেশের উচ্চমানের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করছে, তখন কমপ্লায়েন্সের ব্যাপারটি এসেছে। এ পরিবর্তনটা বুঝতে হবে। শ্রমিকদের কথা চিন্তা করলে একে খারাপ বলা যায় না। চিরকাল কেন আমরা সস্তাশ্রমেই আটকে থাকব? আমরা ধীরে ধীরে বড় উৎপাদনে যাব, 'মোর ক্যাপিট্যাল-ইনটেনসিভ প্রোডাক্টে' যাব। আমাদের আয় বাড়বে। আমরাও উন্নত দেশে পরিণত হতে চাই। 'পরিযায়ী পাখি মডেলে' সবচেয়ে নিচে থাকব কেন?
এভাবে পরনির্ভরশীল পুঁজিবাদের অধীনেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে কোনো কোনো অনুন্নত দেশে শিল্পায়ন হয়েছে। যেমন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান। আরেকটি হচ্ছে মালয়েশিয়া। ফলে ওই মডেলের দেশগুলিতে রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি শাসকদলই সমর্থন করেছে। সাম্রাজ্যবাদও তা অনুমোদন করেছে। এ কারণে এ খাতে তেমন কোনো মতভেদ তৈরি হয়নি।
এখন যদি লেবার-ইনটেনসিভ প্রোডাক্ট থেকে আরেকটু ক্যাপিটাল-ইনটেনসিভ প্রোডাক্টে যেতে চাই তখন কিন্তু এ সমস্যাটি আসবে। আমরা যেহেতু দ্বিতীয় প্রজন্মের দিকে প্রবেশ করব ফলে শ্রমিকের বেতন দ্বিতীয় প্রজন্মের হতে হবে। হলেও অসুবিধা নেই। কারণ চীন ও ভারত তৃতীয় প্রজন্মে চলে গেছে।
এর প্রতিফলন হয়তো এ বাজেটে আমরা দেখব। যে কারণে ট্রেড ইউনিয়ন রাইটের প্রসঙ্গ এসেছে। প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে হয়, রানা প্লাজার ঘটনা বিষয়টিকে আরও তরান্বিত করেছে। এটা এমনিতেই হত। কিন্তু ভবনধসের ঘটনা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এটা এখন তাড়াতাড়ি হবে। আটকাতে পারবে না। বিজিএমইএ মালিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংস্থা; এরা কিছুটা এদিক-ওদিক করলেও শেষে এ পথেই আসতে বাধ্য হবেন।
শ্রমিকদের চারজন প্রতিনিধি, চারজন মালিক প্রতিনিধি ও সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে একটা যৌথ নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে এগুলি করার সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছেন সরকার। আসলে একে 'ট্রেড ইউনিয়ন বডি' বললে ভুল হবে। বরং এর নাম দেওয়া উচিত 'ট্রেড ইউনিয়ন রেগুলটরি বডি'। ট্রেড ইউনিয়ন কারখানার ভিত্তিতেই হবে এবং সেটার ফেডারেশনও হবে। বিজিএমইএ ও ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, এ দুই পক্ষ হবে দরকষাকষির এজেন্ট।
যখন এ দুটি পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব কারখানা পর্যায়ে মীমাংসা করা সম্ভব হবে না তখন মীমাংসার জন্য রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে। যেহেতু রাষ্ট্রের রেগুলেটরি বডি সর্বদলীয় Form-এ হওয়ার কথা, সেহেতু এখানে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে ভারসাম্য বজায়ের সুযোগ থাকবে।
এ মডেলটাই বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, উৎপাদনশীল পুঁজিবাদের মডেল থেকে কিছুটা শিক্ষা নিয়ে আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। কিন্তু এ সরকারের আমলে যদি অন্য একটি দিক তথা হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, ডেসটিনি, শেয়ার মার্কেট-কেলেঙ্কারি দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে এখানে Crony Capitalist মডেল যথেষ্ট সক্রিয় রয়েছে। 'ডিসিপ্লিনড্ ক্যাপিটালিস্ট মডেলে'র ছাপ এসব ক্ষেত্রে নেই।
তবে ক্রনি ক্যাপিটালিস্টের মধ্যেও রয়েছে একধরনের দ্বৈততা, তার রয়েছে দুটি হাত। যেমন- বেক্সিমকো শেয়ারবাজারের মাধ্যমে প্রচুর লুট করেছে বলে তদন্তে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণখেলাপী করে প্রচুর ঋণ নিয়েছে। কিন্তু আবার এদেশের প্রথম বড় দেশীয় রপ্তানিমুখী ঔষধ কারখানা ও Integrated Textile Mill এ কোম্পানিই করেছে! অতএব দেখা যাবে যে এদেশে লুটেরা পুঁজিবাদ ও উৎপাদনশীল পুঁজিবাদ পরস্পর জড়াজড়ি অবস্থায় বিদ্যমান।
রাজনৈতিকভাবে এটাও সত্য যে উল্লিখিত কোম্পানির মালিক সরাসরি আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষক। প্রধানমন্ত্রীর রেড টেলিফোনে কথা বলার মতো সম্পর্ক রয়েছিল এ কোম্পানির সত্ত্বাধিকারীর। সুতরাং তিনি সরকারকে প্রভাবিতও করতে পারেন বলে অনুমান করা যায়। ফলে সহজেই ব্যাংক, আদালত, দুদক সামলানোর ক্ষমতাও তার আছে বলে অনুমান করা যায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে আওয়ামী লীগ সরকার কেন তাকে আগলে রাখবে? কারণ সহজেই অনুমেয়, তারা দলটির নির্বাচনী তহবিলে সহয়তা করবেন। লুটেরা শ্রেণির আর্থিক সহায়তা নিয়ে যে রাজনীতি পরিচালনা করা হয় তাকে তো আর রাজনীতির সুস্থ ক্যাপিটালিস্ট মডেল বলা যায় না। ক্রনি ক্যাপিটালিস্ট মডেল এখনও তাই আওয়ামী লীগ পুরোটা ছাড়েনি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বামের একাংশের মধ্যে জনপ্রিয় মতটি হচ্ছে, পুঁজিবাদ বেড়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। তারা লুটপাট করে অর্থ আয় করে। সেগুলো পাচার করে দেশের বাইরে। সেখানেই সম্পদ-সম্পত্তি করে। যাতে বিপদে পড়লে দ্রুত বিদেশে আশ্রয় নেওয়া যায়। সরকার এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। কারণ সে এখান থেকে সুবিধা ভোগ করে। সংসদ নির্বাচনের সময় দেখা যায়, দীর্ঘদিন রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ত্যাগী রাজনীতিবিদ মনোয়ন পাওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে থাকেন। বহু কষ্টে মনোয়ন পেলেও জয়ী হতে পারেন না।
মানুষের মানসিকতাও বদলে গেছে। অর্থের বিনিময়ে ভোট- এমন একটা ধারণা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বামপন্থীদের বলা হয়, 'ভালো কিন্তু কাজের নয়'! বেশিরভাগের ধারণা, বিত্তশালী রাজনীতিবিদ ক্ষমতায় গেলে তার একটা প্রভাব থাকবে। মন্ত্রণালয় থেকে কাজ আনতে পারবে। এক তরুণ সুশিক্ষিত রাজনীতিবিদ কিছুদিন আগে বললেন, তার বাবা নিজের এলাকায় প্রচুর বরাদ্দ দিয়েছিলেন। একই অবস্থা এরশাদের ক্ষেত্রেও। অন্য জেলাকে বঞ্চিত করে নিজের এলাকায় উন্নয়ন অনৈতিক বটে। কিন্তু লাভ হয়েছে ওই রাজনীতিকের। এতে তার আসনে পরাজিত হওয়ার সুযোগ কমে গেছে।
অন্য জেলা বা অঞ্চলকে বঞ্চিত করে অর্থ দেওয়া অন্যায়- ওই এলাকার মানুষ সেটা ভাবে না। নিজ এলাকার জনসাধারণ ভাবে, তিনি খুবই ভালো করেছেন! রাজনৈতিক নেতারা ওই এলাকার জনগণকে মনে করে 'ভোট ব্যাংক'। এটা নীতি-আদর্শের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে। এটা এখনকার রাজনৈতিক মডেল। এ মডেলের আওতায় পুঁজিবাদ যথাযথভাবে বিকশিত হবে কী করে?
এ জনপ্র্রিয় মতটির বিপরীতে উৎপাদনশীল পুঁজিবাদী অংশের প্রতিনিধিরা মনে করেন, বেশিরভাগ বুর্জোয়া বিশেষত ছোট ও মাঝারি বুর্জোয়ারা লুটপাটে আগ্রহী নয়, তবে তারা রাজনৈতিকভাবে এখনও অনেক দুর্বল। প্রকৃত পুঁজিবাদীরা কখনও-ই রাজনীতিবিদ হতে তদবির করবে না।
তারা তদবির করবে কম দামে জ্বালানি, উন্নত বন্দর, হরতাল বন্ধ করতে, বেতন কমাতে, ক্ষুদ্রশিল্পের বাজারের সুরক্ষা, কাঁচামালের প্রতুলতার ব্যবস্থা, দক্ষ শ্রমিক, প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে, সহজে ব্যাংকঋণ পেতে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে।
সে ধারার একটু একটু লক্ষণ ২০১৩-এর বাজেটে উঁকি মারতে শুরু করেছে। এই দোলাচলের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের উত্তরনকালীন অর্থনীতি চলছে।
এম এম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।