টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও টিভি টকশোতে ক্যানসারের জীবাণু!

বিগত আটাশ বছরের চিকিৎসক জীবনে আজ পর্যন্ত কোনো জার্নালে ক্যানসারের ‘কোষ’ বা ‘জীবাণু’-এর সন্ধান পাইনি।

এ বি এম কামরুল হাসানএ বি এম কামরুল হাসান
Published : 8 Nov 2022, 07:43 AM
Updated : 8 Nov 2022, 07:43 AM

অফিস আর বাসা। বাসায় ফিরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। এভাবেই যাচ্ছে গত দু-সপ্তাহ। এদিকে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ পরবর্তী আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে। বাংলাদেশ কেন হারল? বৃষ্টি না হলে কি ভালো হতো? কোহলির ফেক ফিল্ডিংয়ের জন্য আম্পায়ার কেন পাঁচ রান দিল না? মাঠ শুকানোর আগেই কেন খেলা শুরু হলো? আম্পায়াররা কি পক্ষপাতিত্ব করল? এসব খবরের ভিড়ে গত কয়েকদিন ধরে চোখে পড়ল বেগুন নিয়ে আগুন ঝলসানো সব খবর। নেমে পড়লাম উৎসের সন্ধানে। কেন বেগুন নিয়ে সবাই আগুন।

প্রথমেই ইউটিউব ঘেঁটে পেলাম পনেরো মিনিটের একটি ভিডিও। সেদিনের সেই টকশো। টকশো তো নয়, এটাকে বলে একাত্তর জার্নাল। জার্নালের ভেতর জার্নাল নিয়ে আলোচনা। আচ্ছা, অনুষ্ঠানের নাম একাত্তর জার্নাল কেন? জার্নাল মানে তো পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রকাশনা। যেখানে সব লেখাগুলো থাকবে গবেষক, অধ্যাপক বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের। একাত্তর জার্নালে আলোচনা হয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর নিয়ে। নাকি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলোকে তারা গবেষণাকর্ম মনে করেন। নাকি যারা আলোচনা করেন তারা সবাই পণ্ডিতশ্রেণির লোক। নাকি তারা সবাই গবেষক, অধ্যাপক বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞ। যাকগে, নাম দিয়ে কাম নেই।

ফিরে আসি একাত্তর জার্নালের আলোচনায়। একদিকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আরেকদিকে দুজন আলোচক। আর যিনি আম্পায়ার মানে সঞ্চালক, তিনিও যেন বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের মতো পক্ষপাতিত্ব করছেন। সবাইকে সমান সুযোগ দিচ্ছেন না। আলোচনাটি দেখে থার্ড আম্পায়ারের খুবই অভাব বোধ করলাম। এসব টকশোতে কোনো থার্ড আম্পায়ার থাকে না? পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে সাকিবের আউট নিয়েও বিতর্ক। সেখানে টিভি আম্পায়ার রিপ্লে দেখেও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দিলেন। সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক হুপার বললেন ‘শকিং’। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট বললেন ‘বিতর্কিত’। তেমনিভাবে দেশে-বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি গবেষকেরা একাত্তর জার্নালের জার্নাল বিষয়ক আলোচনায় ‘শকড’। বেগুন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনায় সেই বিষয়টিই ফুটে উঠেছে। তাই টিভি টকশোর এ ধরনের আলোচনায় তৃতীয়-চতুর্থ আম্পায়ার রাখার ব্যাপারে আগামীতে গুঞ্জন উঠতে পারে।

আবার ফিরি একাত্তর জার্নালে। যে খবর নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যে খবরটি টিভি স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে তার শিরোনাম “বেগুনে ক্যানসারের উপাদান পেয়েছেন বাকৃবির গবেষকরা”। সঞ্চালক প্রথমেই বললেন, “বেগুনে ক্যানসারের কোষ পাওয়া গেছে”। একজন চিকিৎসক হিসেবে এই ‘কোষ’ শব্দটি প্রথমেই আমার মস্তিষ্কে কষে একটা হাতুড়ি পেটা করল! একটু পর শুনলাম ক্যানসারের ‘জীবাণু’ পাওয়া গেছে! সর্বনাশ। বিগত আটাশ বছরের চিকিৎসক জীবনে আজ পর্যন্ত কোনো জার্নালে ক্যানসারের ‘কোষ’ বা ‘জীবাণু’-এর সন্ধান পাইনি। জীবন আজ সার্থক হয়ে গেল একাত্তর জার্নালে ক্যানসারের ‘কোষ’ বা ‘জীবাণু’-এর খোঁজ পেয়ে। ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠলাম।

অনুষ্ঠানের সাড়ে তিন মিনিটের মাথায় জানা গেল, অধ্যাপক সাহেব যা বলছেন তার একটি বর্ণও কেউ বুঝছেন না। বুঝতে গেলে দু-পক্ষকেই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। অধ্যাপক সাহেব কার্সিনোজেনিক বা কার্সিনোজেনেসিস শব্দগুলো পরিহার করতে পারতেন। সহজ-সরল বাংলায় বলতে পারতেন। আলোচক তিনজন শিক্ষিত হলেও আমরা যারা টিভির সামনের জনগণ, তারা আমজনতা। তাই অধ্যাপক সাহেবের ভাষা হওয়া প্রয়োজন আমজনতার ভাষা। অধ্যাপক সাহেবকে বারবার বাধা না দিয়ে বলতে দিলে, প্রশ্ন ছুঁড়ে উত্তর দেয়ার আগেই আবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত না করলে তিনি নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতেন। শিক্ষকের কাজই তো বুঝিয়ে বলা। আবার এক্ষেত্রে অপর পক্ষের ভূমিকা অনেক। অধ্যাপক সাহেবের কর্মটি একবার একটু চোখ বুলিয়ে আসা যেত। অবশ্যই সেটি করা প্রয়োজন। তার কর্মটি ‘ওপেন অ্যাক্সেস’ জার্নালে আছে। টাকা-পয়সা দিয়ে কেনা লাগবে না, একদম ফ্রি। গুগোলে সার্চ দিলেই পাওয়া যাবে। আর প্রকাশিত জার্নালটি পড়ে একাত্তর জার্নালের জার্নাল বিষয়ক আলোচনায় আসলে অধ্যাপক সাহেবের কোনো বর্ণই বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

অনেকে বলছেন, গবেষণা কোন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে সে প্রশ্নও করা যাবে না? আমার প্রশ্ন হলো, প্রশ্নটি করা কি সমীচীন হয়েছে? যে খবরটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, টিভি স্ক্রিনে বাংলা ট্রিবিউনের যে খবরটি দেখানো হয়েছে তাতে লেখা আছে, “চলতি বছরের ২২ আগস্ট সায়েন্টিফিক রিপোর্ট জার্নালে গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়।” এখানে সুস্পষ্ট যে, আলোচকবৃন্দ মূল জার্নালটি পড়া তো দূরের কথা দেশি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটিও ঠিকমতো দেখে আসেননি অথবা দেখার সময় পাননি।

নেচার জার্নাল, নেচার পোর্টফলিও ও সায়েন্টিফিক রিপোর্ট জার্নাল নিয়ে অনুষ্ঠানের ভেতরে যে বালখিল্যপনা হয়েছে তা ছিল খুবই দৃষ্টিকটু ও শ্রুতিকটু। এই অংশটি পুরো অনুষ্ঠানের জাত মেরে দিয়েছে। আমার জানা মতে, নেচার পোর্টফলিও ১৬৯টি জার্নাল প্রকাশ করে। এর মধ্যে ‘নেচার’ একটি জার্নাল। ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্ট’ও একটি জার্নাল। নেচারের জার্নালসমূহ খুবই উচ্চমার্গের। জার্নালের মানের মাত্রা প্রকাশ করা হয় দুটি শব্দ দিয়ে– ‘ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর’। জার্নাল ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর হলো বিগত দুই বছরে প্রকাশিত জার্নাল থেকে বছরে যতবার লেখাটি উদ্ধৃত করা হয়েছে তার গড় সংখ্যা। নেচার পোর্টফলিওর ‘নেচার’ নামের জার্নালটির ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ৬৯ দশমিক ৫। সেটি মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে সর্বাধিক ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর প্রকাশনা। সায়েন্টিফিক রিপোর্ট জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর প্রায় পাঁচ। ২০২১ সালে জার্নালটি থেকে প্রায় ৭ লক্ষ উদ্ধৃত হয়েছে। এটি বিশ্বের পঞ্চম সর্বাধিক উদ্ধৃত জার্নাল। নেচার পোর্টফলিও জার্নালসমূহে যে সমস্ত লেখা জমা হয় তার মধ্যে ৭ থেকে ১২ শতাংশ লেখা প্রকাশিত হয়। অনেক লেখা রিভিউতেই যায় না। পত্রপাঠ ‘না’ করে দেয়। এমন একটি জার্নালের নাম শুনে জার্নালটির বাড়ি কই, ঠিকানা কই, সম্পাদক কারা– এ জাতীয় প্রশ্ন অনুষ্ঠানটির মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। আলোচক-সঞ্চালক নির্বাচনে যথার্থতা নিয়ে কর্তৃপক্ষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।

কেউ কেউ বলছেন, একজন সম্মানিত বিজ্ঞানীকে হেনস্থা করা হয়েছে। প্রতিত্তরে কেউ কেউ বলছেন, প্রকাশিত গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন করার নাম হেনস্থা নয়। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে জনগণের মনে আসা প্রশ্ন তোলা হেনস্থা নয়। অবশ্যই সেটি হেনস্থা নয়। তবে প্রশ্ন করে কথা বলতে না দিয়ে তাকে হেনস্থা করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। একজন গবেষকের সাথে আলোচনায় আলোচকদের শারীরি ভাষা, মুখের ভাষা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। অধ্যাপক জাকির হোসেনের কর্মটিকে ফৌজদারি অপরাধের সারিতে ফেলায় ইউরোপে কর্মরত একজন বাংলাদেশি তরুণ জীববিজ্ঞানী ‘ভয়াবহভাবে আপসেট’ অনুভব করছেন। ইউটিউবে তার নিজস্ব চ্যানেলে তিনি বিশ মিনিটের আলোচনায় তার সুন্দর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। ‘বিজ্ঞান, বেগুন ও বাংলাদেশ’ লিখে ইউটিউবে খোঁজ করলে ভিডিওটির সন্ধান মিলবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার দেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। গবেষণার মান ও সংখ্যা বাড়াতে বলেন। এ ধরনের ফৌজদারি অপরাধের হুমকিতে আগামীতে গবেষণার মান না কমলেও সংখ্যা কমলে তাতে অবাক হবার কিছুই থাকবে না।

আবার ফিরে আসি ক্রিকেটে। বাংলাদেশের মতো ছোট দলগুলোর খেলাতে আইসিসিসির পক্ষপাতিত্ব ক্রমেই বেশি বেশি চোখে পড়ছে। ২০১৫ সালে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জেরে প্রতিবাদ করেছিলেন তদানীন্তন আইসিসিসি সভাপতি, বর্তমান অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল। তার জেরে পরবর্তীতে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। ক্রিকেটে আগে ছিল জুয়াড়িদের আক্রমণ। এখন ঢুকেছে ক্যানসারের উপাদান। ক্যানসার হলো একটি রোগ যখন কোষগুলি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজিত হয় এবং পার্শ্ববর্তী টিস্যুতে ছড়িয়ে পড়ে। ডিএনএ পরিবর্তনের কারণে ক্যানসার হয়। বড় দলগুলোর ডিএনএ-এর মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে পার্শ্ববর্তী অন্য বড় দলগুলোতে। সেমিফাইনাল ফাইনালে আসছে ওই বড় দলগুলো। সুক্ষ কারচুপি করে ছোট দলগুলোর মোমেন্টাম নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে।

টিভি চ্যানেলগুলোতে ক্যানসারের কোষ বা জীবাণুর উপস্থিতি কাম্য নয়। কিন্তু আমরা একাত্তর জার্নালে জার্নাল বিষয়ক আলোচনায় ক্যানসারের কোষ বা জীবাণুর উপস্থিতি পেয়েছি। যিনি ফুটবলের রেফারি তাকে দিয়ে ক্রিকেট খেলা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। একজন সব বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে পারেন না। যিনি সর্ববিষয়ে অভিজ্ঞ বলে দাবি করেন, তিনি আসলে কোনো বিষয়েই অভিজ্ঞ নয়। আলোচ্য আলোচনাটি যদি কোনো গবেষক, বিজ্ঞানী বা অধ্যাপকের উপস্থিতিতে করা হতো– তাহলে কেমন হতো বলুন তো। আর যদি সঞ্চালক নিদেনপক্ষে প্রকাশিত প্রবন্ধটি একটু পড়ে আসতেন, তাহলে আলোচনাটি ভিন্ন হতে পারত। পরিশেষে বলি, বেগুনকাণ্ড নিয়ে যে আগুন সোশ্যাল মিডিয়াতে জ্বলছে, নিকট অতীতে আর কোনো টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে এমন হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। পুরো ঘটনা পরিক্রমায় অধ্যাপক জাকির হোসেন কোনো কষ্ট পেয়েছেন কিনা জানা নেই। তবে হলফ করে বলতে পারি, সুধী সমাজ ও দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা দেশি গবেষকদের অধিকাংশই মনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন, ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু চোখ মেললেই এর সত্যতা মিলবে। একাত্তর টিভি কর্তৃপক্ষ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলে তাদের মান-সম্মান বাড়বে বৈ কমবে না।