১২ জুলাই একদিকে বিএনপি ও মিত্রদের এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দুটো বড় সমাবেশ থেকে আমরা দুই পক্ষের ‘এক দফা’ শুনেছি। ‘শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে’ বনাম ‘শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন’। দুটি ‘এক দফা’য় প্রকৃতপক্ষে ভোট ও ভোটাররা গৌণ। মুখ্যত নির্বাচন হয়ে দাঁড়ালো এক ব্যক্তি তথা হাসিনাকেন্দ্রিক বিষয়। এটা রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতিহীন নিছক ক্ষমতার লড়াই।
Published : 15 Jul 2023, 11:36 AM
বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক আন্দোলনের লক্ষ্য কী? সরকারের পতন ঘটানো, না দেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান?
নির্বাচনের আগেই যদি সরকারকে পদত্যাগ করতে হয় বা তার পতন ঘটাতে হয় তাহলে নির্বাচনের দরকার কি?
১২ জুলাই রাজধানী ঢাকায় একদিকে বিএনপি ও মিত্রদের এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দুটো বড় সমাবেশ থেকে আমরা দুই পক্ষের যার যার ‘এক দফা’ শুনেছি। ‘শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে’ বনাম ‘শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন’। দুটি ‘এক দফা’য় প্রকৃতপক্ষে ভোট ও ভোটাররা গৌণ। মুখ্যত নির্বাচন হয়ে দাঁড়াল এক ব্যক্তি তথা হাসিনাকেন্দ্রিক বিষয়। এটা রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতিহীন নিছক ক্ষমতার লড়াই।
এই দুটি পাল্টাপাল্টি সমাবেশ হলো এমন সময়ে যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ ঢাকায় রয়েছেন এবং তাঁদের সফরে নির্বাচনসংশ্লিষ্টতা আছে।
বিএনপির আন্দোলনের লক্ষ্য নির্ণয়ের আগে তাঁরা কী কৌশলে এগোচ্ছেন সেটা দেখা যাক।
২.
সাত মাস আগে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগের মাঠে বিএনপির গণসমাবেশে নেতারা জাতীয় সংসদ থেকে দলীয় সদস্যদের পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সদস্য মাত্র সাত জন। আমরা তখনই বুঝেছিলাম এটি একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক বিবেচনা হচ্ছে, সংসদে যতটুকুই কথা বলা যাক তা সারাদেশের মানুষ শোনে। সেটা তাঁরা বন্ধ করে দিলেন। বুঝলেন না যুদ্ধে সব ফ্রন্টে লড়তে হয়, কোনোটিতে কখনো জোর পড়ে, কোনোটিতে কম, কিন্তু কোনো পোস্ট ছেড়ে দিতে হয় না। তাহলে পুরো প্রতিরক্ষা বা আক্রমণব্যুহ দুর্বল হয়ে যায়।
গোলাপবাগের সমাবেশের কম-বেশি তিরিশ ঘণ্টা আগে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দুই নেতা গ্রেপ্তার হন। এক মাস পরেই জামিনে বেরোন। মহাসচিবের অনুপস্থিতিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেখানে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ১০-দফা’ দাবিনামাও ঘোষিত হয়, তবে পদত্যাগের বিষয়টিই নজর কাড়ে সবার।
সিদ্ধান্তটিতে যে হঠকারিতা ছিল তা পরবর্তী কয়েক মাসে প্রমাণিত হয়। দশটি বিভাগীয় কর্মসূচিতে ভালো ও ক্রমবর্ধমান গণজমায়েতের শেষটিতে ঢাকায় পদত্যাগের ঘোষণার পরে আর উচ্চতর কোনো কর্মসূচি দেওয়া সম্ভব হয়নি, বরং আবার স্থানীয় বা তৃণমূল পর্যায় থেকে বিক্ষোভমিছিল, গণমিছিল, গণঅবস্থান, পদযাত্রা, নবীন সমাবেশ প্রভৃতি হরেক নামে কর্মসূচির চর্বিত চর্বন চলতে থাকে। জমায়েত স্তিমিত হয়ে আসে।
অথচ ২০২১-এর অক্টোবর থেকে পর পর চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লা ও রাজশাহীর গণসমাবেশগুলো হয়েছিল অত্যন্ত সফল ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী। পথে পথে পুলিশ ও সরকারি দলের কর্মীদের বাধা, হামলা উপেক্ষা করে সমাবেশগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা এসেছিল মোটরসাইকেল, বাইসাইকেলে, নৌকায়, পায়ে হেঁটে, চিড়া-মুড়ি সঙ্গে নিয়ে। আগের রাতে পৌঁছে মাঠ ভরিয়ে দিয়ে সেখানে শীতের রাত যাপান করেছে তারা। দেখা যায়, দশ-বারো বছরে হাজার হাজার মামলা ও গ্রেপ্তারে পর্যুদস্ত অবস্থায়ও দলটির সমর্থক সংখ্যা কমেনি এবং নানারকম চাপ ও প্রলোভন দলটিতে ভাঙন ধরায়নি।
বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে বোঝা গিয়েছিল সংগঠিত কর্মীবাহিনীর বাইরের দলীয় সমর্থকরা সক্রিয় হতে শুরু করেছে। রাজনীতিতে দুঃসময়ে নেতৃত্বের আহ্বানে প্রথম এগিয়ে আসে ত্যাগে ব্রতী ও ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত সংগঠিত নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা। তার পরে আসে সমর্থকরা। আন্দোলনটিকে নিজেদের স্বার্থে সদর্থক মনে করলে শেষে নির্দলীয় ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসে আত্মদানও করে। সেটাই গণআন্দোলন। কখনো তা গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। আমাদের জীবনাভিজ্ঞতায় এমন গণঅভ্যুত্থান দেখেছি ১৯৬৮-৬৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসক আইউবের উৎখাতে। ওই গণঅভ্যুত্থান ও পরবর্তী দেশ স্বাধীন করা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ। সমাজতন্ত্রকামী বাম শক্তির ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীন বাংলাদেশে আরেক স্বৈরশাসক এরশাদেরও পতন ঘটেছে তীব্র গণআন্দোলনে।
বর্তমানে কিছু রাজনৈতিক নেতার মুখে হরহামেশা ‘গণঅভ্যুত্থান’ ও ‘সরকারের পতন’ ঘটানোর আওয়াজ, হুমকি ও ভবিষ্যদ্বাণী শোনা যায়। এগুলো হাস্যকর ও রাজনৈতিক কর্মীদের শিক্ষার দিক থেকে ক্ষতিকর। গণঅভ্যুত্থান নেতা বা দলবিশেষের ইচ্ছায় হয় না। ব্যাপক জনগণের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা একটি বাস্তব শক্তি হয়ে উঠলে তবেই গণঅভ্যুত্থান হতে পারে। বিএনপির কর্মী ও সমর্থক গোষ্ঠী সংহত থাকার প্রমাণ দিলেও জনগণকে টেনে আনতে নেতৃত্ব ব্যর্থ হচ্ছে।
এই অবস্থায় অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বুধবার ‘এক দফা’ ঘোষণার যে গণজমায়েত বিএনপি করল তাতে সরকারের ‘পতন’ ঘটানো বা পদত্যাগে বাধ্য করার মতো কোনো শক্তির পূর্বাভাস মেলে না। দলীয় কর্মী-সমর্থক ও বাস-ট্রাকে গুছিয়ে আনা কিছু নিম্নবিত্ত মানুষের সমাবেশ হয়েছে। স্পষ্টত বিভাগীয় সমাবেশকালে দলের আরও বড় পরিধির যে সমর্থকরা উৎসাহী ছিল তারা ঝিমিয়ে গেছে। পরবর্তী কর্মসূচিও সেই চর্বিত চর্বণ পদযাত্রা। ঢাকায় ১৮-১৯ জুলাই গাবতলী-যাত্রাবাড়ি ১৬ কিলোমিটার ও আবদুল্লাহপুর-বাহাদুর শাহ পার্ক ৩৭ কিলোমিটার যে দুটি পদযাত্রার কর্মসূচি নেতারা দিয়েছন, তা কর্মীদের ক্লান্ত করে দিতে পারে, ফল পাওয়া যাবে কতটুকু?
তাহলে কেন পতনের আওয়াজ বা পদত্যাগের দাবি?
৩.
আন্দোলনকারী বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর যুক্তি, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যই শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বলা হচ্ছে, কারণ ২০১৪ ও ২০১৮-এর দুটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এই সরকারের উপরে আস্থা রাখা যাচ্ছে না। গত নির্বাচনের আগে সংলাপে বসে সরকারপ্রধান যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কিছুই রক্ষা করা হয়নি এবং সরকারি দল ও সরকারের প্রভাবে নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট থেকেছে এবং পুলিশ-প্রশাসন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ ও কারচুপি করেছে। এই সব কারচুপির অন্যতম হচ্ছে ‘রাতের ভোট’ বা পুলিশ প্রশাসনকে দিয়ে আগের রাতে ব্যালটবাক্সে আংশিক ব্যালটপেপার ভরিয়ে রাখা। এই অভিযোগ সরকারের জন্য খুব স্পর্শকাতর, নির্বাচন কমিশন ও সরকার জোরালোভাবে অস্বীকার করে এবং বিএনপি ও কোনো বিরোধীদল আইন-আদালতে প্রমাণের চেষ্টা করেনি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে অভিযোগটি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ২০২২-এর নভেম্বরে ঢাকায় তৎকালীন জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী এ-বিষয়ক সবিস্ময় মন্তব্য, ২০১৯-এর মার্চে বহু সমালোচিত-নিন্দিত স্বয়ং তৎকালীন প্রধান নির্বাচান কমিশনার কে এম নূরুল হুদার ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোট হলে আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভরে রাখার সুযোগ থাকবে না’ উক্তি, ভোটের দিন ভোরে চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্রে বিবিসির নিউজ ফুটেজে ধরা ভোটের আগেই স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ব্যালটপেপারের ছবি, তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার সম্প্রতি প্রয়াত মাহবুব তালুকদারের এ বছর প্রকাশিত ‘নির্বাচননামা’ গ্রন্থে ২০১৮ সালে একাধিক সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনে অনুরূপ ঘটনাসহ নানা অনিয়মের বিবরণ—এগুলো তো মুছে ফেলা যায় না।
নানা রকমের গোলযোগের মধ্যে ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বর সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯টিতে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাত্র সাতটি আসন পায়। বাংলাদেশে ভোটের ইতিহাস ও বাস্তবতার আলোকে এই ফলাফলই নির্বাচনটির বিশ্বাসহীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ।
৪.
তাহলে উপায় কি? আগে সরকার পরিবর্তন, পরে নির্বাচন? কী সমাধান আনবে এই প্রক্রিয়া?
বিএনপির ১০ দফার প্রথম চারটিতে আবছা রাজনৈতিক রূপরেখায় আছে সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকার পদত্যাগ করবে এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফলে গঠিত নির্দলীয় নিরপক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে একটি নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তী সরকার হবে যারা নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে এবং বেগম খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দিয়ে সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে।
এই প্রক্রিয়ার জন্য পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ঐকমত্য লাগবে এবং তাতে উপনীত হওয়ার জন্য সংলাপে বসতে হবে। আপাতত সংলাপ প্রশ্নে উভয়পক্ষ উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু।
দলকানা মনোভাব ত্যাগ করে যে-কেউ দেশের সমকালীন ইতিহাসের একটু পেছনে তাকালে দেখবেন ও বুঝবেন যে নির্বাচনকালীন অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য কোনো টেকসই সমাধান দেয়নি। যুক্তি দেওয়া যাবে যে এরূপ সরকারের অধীনে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮-এর চারটি সংসদ নির্বাচনই কেবল সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে, দলীয় সরকারগুলোর অধীনে তেমন কখনই হয়নি। হ্যাঁ, এ চারটি ছাড়া আমাদের ইতিহাসে অন্য নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে কম-বেশি নানা অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ থাকলেও সেগুলো গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর হয়েছে। অনুশীলন করতে করতেই গণতন্ত্র ও নির্বাচনের পরিপক্কতা ও মান অর্জিত হবে। একটি নির্বাচিত সরকারের হাত থেকে আরেকটি বা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা যাওয়াই কাঙ্ক্ষিত ও স্বাভাবিক, যেমন হয় উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতে। মাঝে কোনো অস্থায়ী, অনির্বাচিতদের সরকারের ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে অস্বাভাবিক।
আমাদের সাম্প্রতিক কালের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অভিজ্ঞতায় দেখি দুটি প্রধান দলের নেতারাই ক্ষমতায় থাকলে তত্ত্বাবধায়ক চান না, বিরোধীদলে থাকলে চান। এই নেতারা তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে কখনই নীতিনিষ্ঠতা ও সততার পরিচয় দেননি। নিজেদের চাওয়া তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ভোটে হেরে গেলে ‘সূক্ষ্ণ কারচুপি’, ‘স্থূল কারচুপি’, ‘ষড়যন্ত্র’ ইত্যাদি বলে ফলাফল প্রত্যাখান করতেও চেয়েছেন। পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিশেষ ব্যক্তিকে পাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেশে বিরোধ সৃষ্টি ইত্যাদি তাঁরা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতায় যাওয়ার সাময়িক কৌশল, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র নয়।
দেশের মানুষের মনের কথা বুঝতে চাইলে দেখা যাবে তারা চায় কোনো দলের স্বার্থে অন্য দলের সরকার হঠানো নয়, সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্থায়ী ব্যবস্থায় নিরাপদে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। এই ব্যবস্থাটা তথা সুষ্ঠু রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অনেকবার বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী ওয়েস্টমিনস্টার ধরণের গণতন্ত্র, নির্বাচন আমরা করবো। এটা চাইলে ক্ষমতাসীন সরকারকে ওয়েস্টমিনস্টার আচরণ করতে হবে, কারচুপি-জবরদস্তি নয়।
তাহলে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক শক্তিগুলোর আন্দোলন এখন কোন লক্ষ্যে, কোন ধারায় পরিচালিত হওয়া উচিত?
৫.
আমাদের বিবেচনায় বিএনপিকে ২০২৪-এর আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। নির্বাচনে অংশ নিয়েই নির্বাচনকে সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য করার লড়াই চালাতে হবে। সেই লড়াইয়ে দলের সকল কর্মী-সমর্থক ও ভোটদানে ইচ্ছুক ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ মানুষকে সক্রিয়ভাবে টেনে আনতে হবে। আমরা দেখেছি, শীর্ষনেতৃত্ব নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত দিলেও বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ন্যূনতম সুযোগেই নির্বাচনে অংশ নিতে চান। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নির্বাচন এড়ানো নেতিবাচক এবং তা জনবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে। ২০১৪-১৫ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে ও ভোট প্রতিহত করতে দীর্ঘদিন টানা অবরোধ-হরতাল ডেকে অচলাবস্থা তৈরির চেষ্টা চালিয়েও অগণিত মানুষকে সহিংসতার শিকার হয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া ছাড়া কোনো রাজনৈতিক ফললাভ করেনি। এবারও ‘নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না’-মার্কা আওয়াজ তুলে ব্যর্থ হলে দলটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন উঠবে, আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে যদি বিএনপির ভোটাররা ভোট দিতেই না পারে, কেন্দ্র, ব্যালটবাক্স দখলে রাখা হয় তাহলে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে লাভ কি?
জবাব হলো, এটাই আন্দোলন, এটাই লড়াই। ভোট দেওয়া নাগরিকের অধিকার। ভোট দেওয়ার জন্য ভোটকন্দ্র, ব্যালটবাক্স পাহারা দিতে হবে। মাস্তানি করে নয়, বরং আইনি অধিকার প্রয়োগ করে, শান্তিপূর্ণভাবে। রাজনৈতিক দলকে আদর্শবান, নিবেদিত সাহসী কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। শুধু ক্ষমতায় গেলে চাঁদাবাজি করবে এমন কর্মী নয়। যে আসনে প্রার্থী দাঁড়াবে সেখানে প্রতিটি কেন্দ্রে ও বুথে পোলিং এজেন্ট দেওয়ার মতো কর্মী থাকতে হবে। আইনি চাহিদা পূরণ করে ঠিকমতো কাগজপত্র পরিচয়পত্র নিয়ে কেন্দ্র্রে যেতে হবে। বিক্ষোভমিছিলে, গণজমায়েতের পথে সংঘর্ষে কর্মীদের মৃত্যু এখন দুঃখজনক ও অর্থহীন হয়ে গেছে। পোলিং এজেন্ট হিসেবে ভোটকেন্দ্রে টিকে থাকতে গিয়ে সেখানে মৃত্যু হলে তোলপাড় হয়ে যাবে। ‘পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে দেয়নি’, ‘বের করে দিয়েছে’ এমন মিডিয়ার সামনে কাঁদুনি গাইলে চলবে না। রিটার্নিং অফিসার, নির্বাচন কমিশনের কাছে যথাযথ অভিযোগ দায়ের করতে হবে, কে বের করে দিয়েছে শনাক্ত করে প্রমাণ দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোট গণনার ফলাফল পোলিং অফিসার, রিটার্নিং অফিসারের স্বাক্ষরসহ হাতে নিয়ে বেরুতে হবে।
বিএনপি নেতারা তো দাবি করছেন সুষ্ঠু ভোট হলে আওয়ামী লীগ তিরিশটার বেশি আসন পাবে না। তাহলে এই ভোটারদের মধ্য থেকে নির্বাচনকর্মী বের করুন, সংগঠিত করুন। নির্বাচন বর্জন নয়, নির্বাচনী লড়াই করে আপনাদের দাবি প্রমাণ করুন। বিক্ষোভমিছিল ও পদযাত্রায় আওয়াজ তুলবেন আর অন্য কেউ বা বিদেশীরা এসে আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে এমন ভাবার কারণ নেই।
অবশেষে আমেরিকার ভিসা নীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষণ তৎপরতাসহ সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে যে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে তাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া বিকল্প নেই। ধারণা করা যায়, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিলেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সবাই নড়ে-চড়ে বসবে। ‘সরকারপতনের এক দফার আন্দোলনে’ আওয়ামী লীগ ভীত নয়। কিন্তু বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনে এলে সেটা মোকাবেলা করা তাঁদের জন্য এর চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তা অবশ্যই দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক হবে। উভয় দল তাতে দেশবাসীর ধন্যবাদ পাবে।
অন্যথায় সরকারপতনের আওয়াজ দিয়ে বিএনপি এখন যা করছে তা একটি লক্ষ্যভ্রষ্ট আন্দোলন বলে পরিগণিত হবে। অথবা একে ভ্রষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলন বলা যাবে যা ব্যর্থ হতে বাধ্য।