সব মানুষ মুক্ত বাংলাদেশে বুকে চিতিয়ে চলবে। মোটামুটিভাবে এটাই ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর এক অতি সাধারণ আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু তাদের এই সামান্যতম আকাঙ্ক্ষাকেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঠিকঠাক মতো অনুবাদ করতে পারেননি।
Published : 01 Sep 2024, 04:44 PM
একদা এক পথিক রাস্তা দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ একটি হাতি দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তিনি বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, এতবড় একটা সৃষ্টিকে কেবল সামনের পায়ে একটি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কোন শিকল বা খাঁচা, কিছুই নেই। হাতিটি তো যে কোন সময় এই বাঁধন এক লহমায় ছিঁড়ে ফেলতে পারে। কিন্তু কেন সে এটা করছে না?
পথিক তখন হাতি প্রশিক্ষককে প্রশ্ন করলেন, “এই প্রাণীটি কেন দড়ি ছেঁড়ার চেষ্টা করছে না?”
প্রশিক্ষক বললেন, "যখন হাতিটির বয়স কম ছিল এবং আকারে খুবই ছোট ছিল, তখন আমরা তাকে বাঁধার জন্য এই একই ধরণের দড়ি ব্যবহার করতাম। সেই বয়সে এই দড়িটিই হাতিটাকে পালাতে বাধা দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। সে চেষ্টা করেও দড়িটি ছিড়তে পারতো না। পরবর্তীতে, হাতিটি এই বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছে যে, সে এটিকে ছিঁড়তে পারবে না। হাতি এখনও বিশ্বাস করে দড়িটি তাকে আটকে রাখতে সক্ষম, তাই সে আর এটি ছেঁড়ার চেষ্টা করে না।"
স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স অর্ধশত বছর হয়ে গেলেও এদেশের মানুষের পা যেন কোন অদৃশ্য দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার অন্তরে কখনও এই বিশ্বাস জায়গা করে নিতে পারেনি যে সে স্বাধীন। তাই সে স্বাধীনতার আনন্দ নিয়ে দিগন্ত জুড়ে দৌঁড়াতে পারেনি। এই আনন্দটা কেমন?
একজন সাধারণ কৃষকের আশা ছিল, সে তার জমিতে ফসল ফলাবে। তার উৎপাদিত পণ্য বাজারে ন্যায্য দামে বিক্রি করবে। লাভের টাকা দিয়ে পরিবার-সন্তানদের নিয়ে সুখি একটা জীবন পার করে দেবে। তার পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষিত হবে, তাদের চেয়ে আরেকটু উন্নতভাবে জীবন-যাপন করবে। আবার, একজন শ্রমিকের আশা ছিল, সে শিল্প-কারখানায় ন্যায্য দামে তার শ্রম বিক্রি করবে। একটা ভালো-বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সে হাসিমুখে শ্রম দেবে। কেউ তাকে প্রতারিত করবে না। এই শ্রমের বিনিময়ে সেও ওই কৃষকের মতোই আশা করেছিল, পরিবার-পরিজন নিয়ে একটি সুখি-সমৃদ্ধজীবন কাটাবে। এরপর ধরা যাক, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জীবনের কথা। সেখানেও এই শ্রেণীটার আশা ছিল, তার ক্ষুদ্র ব্যবসা কিংবা চাকুরি বা কর্মময় জীবন মর্যদাপূর্ণ হবে। তাদেরও আশা ছিল, পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত কর্মময় জীবনে আসীন হবে। সব মানুষ মুক্ত বাংলাদেশে বুকে চিতিয়ে চলবে। মোটামুটিভাবে এটাই ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর এক অতি সাধারণ আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু তাদের এই সামান্যতম আকাঙ্ক্ষাকেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঠিকঠাক মতো অনুবাদ করতে পারেননি।
শাসন-ব্যবস্থা কেমন হলে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার গণমানুষের দুয়ারে পৌঁছাতে পারে, সেটা আমাদের রাজনীতিকরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি বা ইচ্ছকৃতভাবে এড়িয়ে গেছেন। কেননা, শাসন-ব্যবস্থা প্রণয়ন ও পরিচালনায় গণমানুষের অংশগ্রহণ করা ও মতামত দেবার সুযোগ ছিল না। ফলে যা হবার তাই-ই হয়েছে। স্বাধীনতা আর জনগণের কাছে থাকল না। শাসকদের হাতে চলে গেল। রাজনৈতিক গোষ্ঠী তাদের নিজেদের মতো করে দেশ শাসন করা শুরু করল। ফলে, অতি সুক্ষ্মতার সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে তার বিকাশকাল থেকেই এক ধরণের অদৃশ্য দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হলো। মানুষের বিশ্বাস করতে শুরু করল, এই বাঁধন তার কপালের লিখন! সে তার এঁকে দেওয়া সীমানা অতিক্রম করতে পারবে না।
তাছাড়া অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলে আমরা দীর্ঘ ১৮ বছর সময় ধরে সামরিক শাসনের অধীনে নিমজ্জিত হই। এই সময়কালের পুরোটাই দেশের মানুষ বন্দি ছিল এক অদৃশ্য জেলখানায়। এক ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পায়ের বাঁধন আরও বেশি শক্ত মনে হয়েছিল তাদের কাছে।
তারপর আসে পালাক্রমের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসন, ঠিক সমান্তরালে চলে ধর্মীয় রাজনীতির অতি সুক্ষ্ম বিস্তার। ফলে, বর্তমানে দেশের মোট জনশক্তির বড় একটি অংশের রাজনৈতিক আদর্শিক ভাবধারা প্রধান তিনটি পৃথক ছাতার তলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এখানে অবশ্য অতি ক্ষুদ্র আকারে বাম ঘরানার এবং জাতীয়পার্টি নামের দুটি ধারারও ছাতা আছে। স্বাধীনতার আগে ও পরে বাম ঘরানার রাজনীতি আকারে বেশ বড়ই ছিল। পরবর্তীতে এই ধারাটা বর্তমানের প্রধান দুই বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে মিশে যায়। এখন যতটুকু তার অস্তিত্ব আছে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না বললেই চলে। অন্যদিকে, সামরিক শাসক এরশাদ মেজর জিয়াউর রহমানের পথ অনুসরণ করে জাতীয় পার্টি নামের একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুললেও নব্বইয়ের পরে, সেটি টুকরো টুকরো হয়ে এক ক্ষীণ রাজনৈতিক নালায় পরিণত হয়।
রাজনৈতিক এই বিবর্তনের মাঝে অনেক আদর্শিক চমক থাকলেও নিপীড়িত ও বঞ্চিত গণমানুষের জীবন কাটে চমক ছাড়াই। এই কারণে যে তাদের মাঝে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেনি, তা কিন্তু না। ১৯৯০, ১৯৯৬ এবং ২০০৭ সালে আমরা এ রকম ঘটনা ঘটতে দেখেছি। ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানটি ছিল গণ-মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামীলীগ মানুষের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের পথ দেখাতে পারেনি।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত রাজনৈতিক সাফল্য বলতে আমারা দেখেছি: খাল কাটা কর্মসূচি, যোগাযোগের জন্য রাস্তা তৈরি, পুঁজিবাদের বিকাশ, বৈদেশিক ঋণ নিশ্চিত করা, ব্যাপক পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও উদ্যোক্তার বিকাশ এবং একই সঙ্গে বড় বড় শিল্প-উদ্যেক্তাদের সেগুলোকে গিলে ফেলা, সমাজের উঁচু স্তরে পুঁজির পাহাড় গড়া...ইত্যাদি, ইত্যাদি। বিপরীতে, এসব অর্জন করতে গিয়ে আমরা সীমাহীন দুর্নীতি, বৃটিশদের বাতিলযোগ্য আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের অভাব, সু-শাসনের অভাব, বিচারহীনতা, অধিকার হারানো, প্রতিহিংসামূলক নিপীড়ন, দমন, চরম বৈষম্য, অর্থপাচার, কষ্টকর জীবন-জীবিকার নাভিশ্বাসে প্রতিনিয়ত হাঁসফাঁস করেছি। শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, সব কিছুতে পিছিয়ে পড়েছি। আমরা আবারও মুক্তির জন্য সুযোগ খুঁজেছি। হতাশার কথা বলার জন্য কণ্ঠ খুঁজেছি।
এ রকম অবস্থায়, যখন আমরা কর্তৃত্বের শাসনে-শাসনে প্রায় নির্জীব হয়ে পড়েছিলাম, ঠিক তখনই আসে ২০২৪ সাল। এই সময়ে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণরা ঠিক করল, এভাবে আর চলতে পারে না। তরুণ শক্তি ঘুম থেকে জেগে উঠল। অতি দ্রুতই তারা গণমানুষের আস্থা অর্জন করল। ছাত্র-জনতা-পুলিশের অসংখ্য লাশের বিনিময়ে অবসান হলো একক ক্ষমতাধারী আওয়ামীলীগ সরকারের। পরের ঘটনাগুলো এখন আর কারও অজানা নেই। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন ঘুরপাক খায়– যে অভ্যুত্থানে দেশের গণমানুষ অংশ নিল, তাদের আকাঙ্ক্ষা কি বাস্তবে পরিপূর্ণতা পাবে?
এখন পর্যন্ত এই অভ্যুত্থান-উত্তর পর্বে যতটুকু কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করা যায়, তা একদিকে যেমন শুরু হয়েছে দেশের আর্থিক খাত সংস্কারের মধ্য দিয়ে, অন্যদিকে একটা প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষাও সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে, হাসিনা সরকারের পতনের পর পরই শুরু হয় ভাঙচুর আর লুটপাট। বিগত সরকারের সঙ্গে থাকা মানুষদের বিচারের পর্ব শুরু হয়েছে ‘সত্য প্রতিষ্ঠা করতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে’। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখেছি ‘পারষ্পরিক সম্পর্কহীন’ উদ্ভট সব মামলা দায়ের করতে। সেই সঙ্গে অপর রাজনৈতিক শক্তি, বিশেষভাবে বিএনপি, আওয়ামী লীগ আমলের রেখে যাওয়া শূন্য চেয়ারগুলো একে একে নিজেদের দখলে নিয়ে ফেলেছে।
আমরা বার বার ভুলে যাই, প্রতিহিংসা পাল্টা প্রতিহিংসা রূপেই কিন্তু ফিরে আসে। ক্ষমার চেয়ে বড় মানবিকতা আর নেই। যার যার প্রাপ্য বিচারটুকু শুরু করে আমাদের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংস্কারে হাত দেওয়া। সকলের অংশগ্রহণে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা। তাছাড়া, মানুষ এখনও নিশ্চিত না আমরা কি আগের সেই সংবিধান নিয়েই চলব, নাকি একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য নতুন করে আরেকটি দলিল লিখব? জনগণকে এখনই সেটা জানাতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্ম-পরিকল্পনা সম্পর্কেও একটি রোড ম্যাপ জনগণের সামনে হাজির করতে হবে। সেখানে জাতীয় জীবনের সকল প্রকার বৈদেশিক চুক্তির দলিলসমূহ প্রকাশ, ক্ষতিকর চুক্তি বাতিল করা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের শাসন, দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহিতা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ইত্যাদি উপাদানের উপস্থিতি নিশ্চিত থাকতে হবে। সর্বোপরি, রাজনীতি হতে হবে মানুষকেন্দ্রিক। শাসককেন্দ্রিক নয়। যতদিন পর্যন্ত ক্ষমতার বণ্টন নিচ থেকে উপরে না উঠে আসছে, ততদিন পর্যন্ত জনগণের পায়ের বাঁধনমুক্ত হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ অর্থাৎ গার্মেন্টস শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক এবং কৃষকরাই কিন্তু এই দেশেটিকে টিকিয়ে রেখেছে, শাসকরা নয়।