বিদেশে ব্যাংকের চাকরিতে নিয়মের বাইরে এক মিনিটও বেশি সময় বাইরে থাকতে পারিনি। যে কোনো কাজে আধঘণ্টা বিরতি মানে তিরিশ মিনিট। এক মিনিট ও এধার-ওধার হতে পারেনি।
Published : 16 Jun 2024, 10:32 AM
আমাদের দেশের বিরুদ্ধে যারা কথা বলে তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করে। মাঝখানে মনে হতো তাদের অপপ্রচার সত্য। হয়তো এই সরকারের হাতে সময় আর বেশি নেই। এদের অধিকাংশ এখন হাল ছেড়ে দিয়ে অদৃষ্টবাদী। তারা এখন ভিন্ন কথা বলে। তাদের নতুন মত, সময় বিচার করবে। তো সময় ই যদি বিচারক মনে করেন তো জ্বালাও পোড়াও মানুষ মারার কি দরকার ছিল? বিরোধী বলতে যে একটি শক্তিশালী দল বা প্রতিপক্ষ সেটাই ভুলে গেছে মানুষ। আহম্মকিরও একটা সীমা থাকে। দেশ জনগণের সাথে যোগাযোগ নেই পার্টি অফিসে রাতজাগা নেতারা কি ভাবে দেশকে নেতৃত্ব দেবেন? এটা বলে বোঝানোর দরকার পড়ে? বিরোধিতার নামে যে উগ্রতা আর শাসনের নামে যে কঠিন আচরণ তার চাপে রাজনীতি দিশেহারা। রাজনীতির কথা থাক।
বলছিলাম দেশের উন্নয়নের কথা। আমরা মাঝে মাঝে দেশে যাই। কাজেই সবসময়ের অনিয়ম আমাদের ভোগায় না। বিশেষ করে গিয়ে ফিরে আসার সময়টুকু কাটে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের সাথে। বাস্তবতা তখন অধরা। জরুরি কাজে ব্যংকে যেতে হয়েছিল। সরকারি বা রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক। আমরা সবাই জানি অবগত আছি ব্যাংকের অবস্থা নাজুক। এর সাথে ওর সাথে ওর মিশ্রণের মাধ্যমে ব্যাংক বাঁচানোর শেষ চেষ্টা চলছে দেশে। যখন ব্যাঙের ছাতার মতো ব্যাংকগুলো গজিয়ে উঠছিল তখন এ নিয়ে কথা বলে দেখেছি। তিরস্কার আর বাঁকা চাউনির বাইরে কিছু জোটেনি। আমার নামের পাশে যতই প্রাবন্ধিক, লেখক , ছড়াকার-কবি লেখা হোক না কেন আমার মূল পেশা ছিল ব্যাংকিং। আশির দশকে চাকরির হাহাকার কোন মিডিয়া নেই, প্রতিষ্ঠান নেই, এক নায়ক এরশাদের খেয়াল খুশির আমলে আমি চাকরি পেয়ে গিয়েছিলাম প্রবেশনারি অফিসার পদে। সে চাকরির এক পর্যায়ে আমাকে একটি ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়েছিল। বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শ ও সুপারিশ ক্রমে ঋণ খেলাপি নির্ণয়ের ভার পড়ে আমাদের ওপর। সহজ হিসাব। সাধারণ ঋণের জন্য, মন্দ ঋণের জন্য আলাদা আলাদা খাত। রাখতে হবে পর্যাপ্ত মজুদ অর্থ বা প্রভিশন। তাতেই কাজ সারা। রাতারাতি ব্যাংকগুলোর মুনাফা উধাও। জোর করে নেয়া দু-তিনটা বোনাস বন্ধ। অনেকে আমাদের ওপর বেজায় রাগ করলেন। কী দরকার এত হিসাব মানার? যে ভাবে চলছে চলুক। কোন এক কর্মকর্তা যাবে ঋণ দিতে, ঋণের খবর নিতে, তাকে উপহারের নামে নগদ ধরিয়ে দিলেই বলবে, সব ঠিক আছে। সে কর্তা যদি সৎ বা নীরিহ হন তো তাকে বল প্রয়োগে রাজি করাতে হবে। এমন গোঁজামিল বন্ধ হওয়াতে বেজার কর্মচারী-কর্মকর্তারা টের পাননি সামনে কী দিন আসছে।
আজ ব্যাংকগুলো করুণ বাস্তবতার মুখোমুখি। অস্ট্রেলিয়া আসার পর আমি মূল চারটি বড় ব্যাংকের তিনটিতে কাজ করেছি। সবসময় ভাবতাম আড়াই কোটির বেশি জনসংখ্যার এই দেশে হাতে গোণা মাত্র কয়েকটি ব্যাংক কেন? জনসংখ্যা যাই হোক মানুষের আয় আর লেনদেন ক্ষমতা অনেক বেশি। সে বিবেচনায় নিঃসন্দেহে আরো চার ছয়টি ব্যাংক থাকতে পারে। কিন্তু না রাতারাতি ব্যাংকের মালিক হবার স্বপ্ন দেখে না কেউ। ব্যাংক তো দূরের কথা। পোস্ট অরইস প্রাইভেট হবার পর যে কেউ চাইলে এর শাখা ক্রয় করে নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে পারে। পাসপোর্ট থেকে টাকা তোলা সব কাজ হয়ে এই পোস্টাপিসে। লাভজনক ব্যবসা। যে সব বাঙালি এমন শাখা খুলে বসেছিলেন তাদের সিংহভাগই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। কারণ চাইলেই ইচ্ছে মতো লাভ করা যায় না। সাথে আছে নিয়ম কানুনের ঝক্কি। বাংলাদেশে উন্নয়নের পাশাপাশি যে ব্যাংক খোলার হিড়িক আজ তা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কথা পরে আলাপ করা যাবে।
একটি সরকারি ব্যাংকের প্রধান শাখায় গিয়ে যে সব সমস্যার সমুখীন হয়েছি তার তালিকা দিলে এ লেখা শেষ করা যাবে না। মূলত যা চোখে লেগেছে দুর্ব্যবহার। আমি কারো অমঙ্গল চাই না বলে নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম। কিন্তু যে অফিসারটি চট্টগ্রামের মূল শাখায় বসে প্রতিনিয়ত গ্রাহকের সাথে খারাপ আচরণ করছেন নিজেকে শাহেনশাহ মনে করছেন তার দায় নেবে কে? মৃত্যু পথযাত্রী ব্যাংকের এই অফিসার জানে না কদিন পর হয়তো তাকে বেতন দেয়ার টাকাও থাকবে না। কিন্তু লোকটি সমানে তার গ্রাহকদের অপমান করে যাচ্ছে ।
আচরণের পাশাপাশি সমস্যার আরেক নাম ডকুমেন্ট। বাংলাদেশে দশ বছর আগে জন্ম নেয়া নব্বই শতাংশ মানুষের জন্মতারিখ বানোয়াট। তার আগের কথা না বলাই ভালো। পৃথিবীর আর কোন দেশে এতো মানুষ একসাথে ১ জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেছেন? এর কারণ সঠিক তারিখ না থাকা। মা-বাবারা তখনকার দিনে এগুলো লিখে রাখতেন না। নিবন্ধনেরও কোন নিয়ম ছিল না। অথচ এসব জানার পর ও ডকুমেন্ট নিয়ে বাড়াবাড়ি করে এরা। এটা দিলে বলে ওটা দেন ওটা দিলে বলে সেটা চাই। আপনি সবকিছু দিলে তারপর শুনবেন উনি খেতে গেছেন। খেতে গেলে যে ফিরে আসতে হয় এ কথা মানে না তারা। উন্নয়ন মানে যদি এই বাস্তবতা হয় বলার কিছু নাই।
আমরা বিদেশে ব্যাংকের চাকরিতে নিয়মের বাইরে এক মিনিটও বেশি সময় বাইরে থাকতে পারিনি। যে কোনো কাজে আধঘণ্টা বিরতি মানে তিরিশ মিনিট। এক মিনিট ও এধার-ওধার হতে পারেনি। লাট বাহাদুরের নাতি সরকারি ব্যাংকের কর্তা খেতে যান না ভোজনে যান তার হিসেব রাখে কে? বলছি ব্যাংকগুলোর সেবার মান আর টাকা ফেরতদানের অনীহা কি উন্নয়নের সাথে যায়? তিন ধরণের মানুষ কোন দুর্ভোগ পোহায় বলে মনে হলো না। ১. উচ্চ পদমর্যাদার কেউ, ২. নেতা বা তাদের পরিচিত জন, ৩. মিডিয়া বা অন্যভাবে বিখ্যাত কেউ। এ ছাড়া আমজনতার অবস্থা ভয়াবহ। ব্যাংকিং যে একটি সেবার কাজ সেটি কারো মাথায় আছে বলে মনে হয় না।
ব্যাংকের নাভিশ্বাসের আরেকটি কারণ অদক্ষ জনশক্তি। আমি কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি কাজ করছে, নিয়ম মানছে, কিন্তু পলিসি জানে না। জানলেও তার অর্থ বোঝে না। এর জন্য চাই ট্রেনিং। দূর দেশ থেকে গিয়ে এটা বোঝা মুশকিল তারা কতটা দক্ষ বা কতটা প্রশিক্ষিত। আমার ধারণা আগপাশতলা পরির্বতন করা না গেলে বাংলাদেশের সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেবাদানে আগ্রহ ভালো ব্যবহার এবং কাজ বুঝে কাজ করার পাশাপাশি নীতিমালয় পরির্বতন না আনলে এর সমাধান হবে না।