মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন ভাঙার অভিযোগে দণ্ডিত রয়টার্সের দুই সাংবাদিক ৫১২ দিন কারাগারে কাটানোর পর মুক্তি পেয়েছেন।
Published : 07 May 2019, 09:46 AM
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, রাজধানী ইয়াংগনের ইনসেইন কারাগার থেকে মঙ্গলবার সকালে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন সাংবাদিক ওয়া লোন (৩৩) ও কিয়াও সো ও (২৯)।
রোহিঙ্গা নিপীড়নের তথ্য সংগ্রহের সময় গ্রেপ্তার এই দুই সাংবাদিক বরাবরই নিজেদের নির্দোষ দাবি করে এসেছেন।
তাদের মুক্তির দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব দাবি মিয়ানমার সরকার এতদিন উপেক্ষা করে আসছিল।
জজ আদালত রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে সাত বছরের সাজা দেওয়ার পর হাই কোর্ট এবং আপিল বিভাগেও তা বহাল থাকে। আপিল বিভাগের ওই রায় আসার মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় দুই সাংবাদিকের মুক্তির খবর এল।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর বর্ষবরণের মওসুমে মিয়ানমারে প্রেসিডেন্টের ক্ষমায় বিপুল সংখ্যক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। এবছর সেই প্রক্রিয়া শুরু হয় এপ্রিল থেকে।
এর আওতায় কয়েক হাজার বন্দির সঙ্গে সাংবাদিক ওয়া লোন ও কিয়াও সোকেও মিয়ানমার সরকার মুক্তি দিয়েছে।
তাদের মুক্তির জন্য তাদের স্ত্রীরা গত এপ্রিলে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করেছিলেন। তবে সেখানে অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
মঙ্গলবার সকালে তারা কারাগার থেকে বেরিয়ে এলে বন্ধু, স্বজন আর সহকর্মীরা তাদের স্বাগত জানান।
ক্যামেরার সামনে বুড়ো আঙুল তুলে ‘থাম্বস আপ’ দেখিয়ে ওয়া লোন বলেন, তাদের মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে সমর্থন দিয়ে গেছে, সেজন্য তারা কৃতজ্ঞ।
“আমার পরিবার, আমার সহকর্মীদের মাঝে ফিরে আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে। বার্তা কক্ষে ফিরতে আমার আর দেরি সহ্য হচ্ছে না।”
ইয়াঙ্গনে পুলিশ কর্মকর্তাদের এক ডিনারের আমন্ত্রণে যাওয়ার পর ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গোপন নথিপত্র ছিল তাদের কাছে।
পরে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ওয়া লোন এবং কিয়াও সো ও রাখাইনের সেনা অভিযানের সময় এক গ্রামে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে লাশ পুঁতে ফেলার একটি ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান করছিলেন।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংগঠন দুই সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে তাদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানালেও মিয়ানমার সরকার তাতে সাড়া না দিয়ে মামলা চালিয়ে যায়।
নিম্ন আদালতে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশে বলা হয়, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের অধীনে অভিযোগ এনেছে। সেখানে বলা হয়েছে, তারা জাতীয় নিরাপত্তাকে হমকির মুখে ফেলার উদ্দেশ্য নিয়ে সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্পর্শকাতর তথ্য ও নথি সংগ্রহ করেছেন।
এ মামলায় পুলিশের বক্তব্য ছিল, রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তাদের কাছে সেনাবাহিনীর গতিবিধির বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত নথি পাওয়া যায়। আর মোবাইলে পাওয়া যায় বিভিন্ন মাত্রার গোপনীয় তথ্য।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেনি। সংবাদ সংগ্রহে বাধা দিতেই ঘটনা সাজিয়ে দুই সাংবাদিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
ওই মামলায় ওয়া লোন ও কিয়াও সো ওকে গত বছর সেপ্টেম্বরে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয় ইয়াংগনের জেলা জজ আদালত। পরে হাই কোর্টে ওই রায় বহাল থাকে। ২৩ এপ্রিল আপিল বিভাগও দুই সাংবাদিকের আপিল খারিজ করে দেয়, ফলে সাত বছরের সাজার রায়ই বহাল থাকে।
পশ্চিমা কূটনীতিবিদের কেউ কেউ এবং কোনো কোনো অধিকার সংগঠন দুই সাংবাদিকের এই বিচারকে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়ায় থাকা মিয়ানমারের জন্য একটি পরীক্ষা হিসেবে বর্ণনা করে সতর্ক করে আসছিলেন। কিন্তু মিয়ানমারের অবস্থান তখন বদলায়নি।
আপিল বিভাগের রায়ের পর মিয়ানমারে জাতিসংঘের প্রতিনিধি কুন্ট অস্তাবি হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “ওয়া লোন এবং কিয়াও সো ওকে মুক্তি দিয়ে তাদের পরিবারের কাছে এবং সাংবাদিকতায় ফেরার সুযোগ দেওয়া উচিৎ। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রতি সব সময় জাতিসংঘের পূর্ণ সমর্থন থাকবে।”
সাহসী সাংবাদিকতার জন্য ওয়া লোন এবং কিয়াও সো ওকে চলতি মাসের শুরুতে সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ পুরস্কার পুলিৎজার দেওয়া হয়।