‘যাচাই করে’ রোহিঙ্গাদের ফেরাতে রাজি সু চি

নব্বইয়ের দশকে করা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন দেশটির নেত্রী অং সান সু চি। 

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2017, 05:55 AM
Updated : 5 Oct 2017, 08:36 AM

তিনি বলেছেন, “যে শরণার্থীরা মিয়ানমারে ফিরতে চায়, ওই চুক্তির আওতায় আমরা যে কোনো সময় তাদের ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া শুরু করতে প্রস্তুত। আর যে শরণার্থীরা মিয়ানমার থেকে গেছে বলে চিহ্নিত হবে, কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তার পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়ে আমরা তাদের গ্রহণ করব।”  

রাখাইনে সহিংসতার প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মধ্যে মঙ্গলবার মিয়ানমারের পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর সু চি।

মিয়ানমারের রাখাইনে বিদ্রোহীদের হামলার জবাবে সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানে গত প্রায় এক মাসে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ ওই অভিযানকে বর্ণনা করছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে।   

সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ না নেওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনায় থাকা সু চি মঙ্গলবারই প্রথম রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে জাতির সামনে বক্তব্য দিলেন। 

রাখাইনের পরিস্থিতির কারণে ওই রাজ্যের মুসলমানদের পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কথা স্বীকার করলেও সু চি ইংরেজিতে দেওয়া তার আধা ঘণ্টার বক্তৃতায় কোথাও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও তিনি সরাসরি কিছু বলেননি।

সু চি বলেন, “আমরা সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বেআইনি সহিংসতার নিন্দা জানাই। রাখাইন রাজ্যজুড়ে আইনের শাসন, স্থিতিশীলতা ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

তবে তিনি এও বলেছেন, রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ রয়েছে। সবার অভিযোগই শুনতে হবে। প্রমাণের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়ার পরই পদক্ষেপ নিতে হবে।

“জাতি, ধর্ম, রাজনৈতিক অবস্থান যাই হোক না কেন, যারাই এ দেশের আইনের বিরুদ্ধে যাবে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সু চি দাবি করেছেন, ৫ সেপ্টেম্বরের পর কোনো ধরনের সহিংসতা বা নির্মূল অভিযান রাখাইনে হয়নি। অবশ্য বাংলাদেশের টেকনাফে থেকে গত ১৫ সেপ্টেম্বরও সীমান্তের ওপারে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা গেছে।

বাড়িতে আগুন দেওয়ার প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার সারাপাড়ার বাসিন্দা সেতারা বেগম। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

বিবিসি লিখেছে, চলতি সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও সু চি তার বক্তৃতায় বলেছেন, রাখাইনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মিয়ানমার সরকার কী করছে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানুক।

রাখাইন থেকে মুসলমানরা কেন পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে, তা মিয়ানমার সরকার খুঁজে বের করতে চায় জানিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইন পরিদর্শনে যাওয়ার আমন্ত্রণও তিনি জানিয়েছেন।

সুচি বলেছেন, রাখাইনের সঙ্কট নিরসনে কফি আনান কমিশন যে সুপারিশ করেছে, তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে চায় তার সরকার। তবে তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ক্ষমতায় এসেছে মাত্র ১৮ মাস হতে যাচ্ছে। এত অল্প সময়ে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। 

“আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় অঙ্গিকারাবদ্ধ। রাখাইনের সবার দুর্দশার বেদনা আমরা গভীরভাবে অনুভব করছি।”

তিনি দাবি করেন, মিয়ানমার সরকার রাখাইনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে এবং বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।

সু চির ওই ভাষণের পর রাখাইনের ওই অঞ্চলে যাওয়ার পূর্ণ সুযোগ চেয়েছে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল, যাতে নিজেদের চোখে বাস্তবতা দেখে তদন্ত করা যায়।

রোহিঙ্গা সঙ্কট, ১৯৯২ সালের চুক্তি

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের দমন-পীড়নের ইতিহাস কয়েক যুগের পুরনো হলেও সাম্প্রতিক সঙ্কটের সূচনা হয় গত ২৪ অগাস্ট রাতে আড়াই ডজন পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে হামলায় ১২ জন নিহত হওয়ার পর। 

মিয়ানমার সরকার ওই হামলার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামের নতুন এক বিদ্রোহী সংগঠনকে দায়ী করেছে। 

রাখাইনে কয়েকশ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস থাকলেও  ১৯৮২ সালে আইন করে তাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করে আসছেন ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ ও ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে।

রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান এক সময় স্বাধীন রাজ্য থাকলেও অষ্টাদশ শতকের শেষভাবে বার্মার রাজা ওই এলাকা দখল করে নেন; জাতিগত বিভেদ তখন থেকেই।

শাহ পরীর দ্বীপ থেকে টেকনাফে আসতে নৌকার ঘাটে ভিড় করেছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ছবিটি শনিবার সকালে তোলা। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

গত শতকের চল্লিশের দশকের পর আরাকানে বৌদ্ধ মগ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে বহুবার জাতিগত দাঙ্গা লেগেছে। সামরিক শাসনামলে মিয়ানমারে ওই রাজ্যে চলেছে দফায় দফায় দমন অভিযান। রোহিঙ্গাদের বিভিন্নসংগঠন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পথেও হেঁটেছে।

সহিংসতার কারণে গত শতকের আশির দশক থেকে চার লাখের মত রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। আর গত অগাস্ট থেকে তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও অন্তত চার লাখ দশ হাজার। 

বেশ কিছুদিন কূটনৈতিক আলোচনার পর ১৯৯২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে একটি  প্রত্যাবাসন চুক্তি করে, যেখানে রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ওই চুক্তির আওতায় মিয়ানমার সে সময় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। চুক্তি নির্ধারিত যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও ২৪১৫ জন শরণার্থীকে সে সময় মিয়ানমার থেকে আসা বলে নিশ্চিত হওয়া গেলেও মিয়ানমার তাদের আর ফিরিয়ে নেয়নি।  

যা যা বললেন সু চি

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছিলেন, জাতির উদ্দেশে এই ভাষণে সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধ করে রোহিঙ্গা সঙ্কটের অবসানের ‘শেষ একটি সুযোগ’ পাচ্ছেন সু চি।

বিবিসি লিখেছে, মিয়ানমারের গণতন্ত্রের আইকন সু চি সেনাবাহিনী প্রধানের মত রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ বলেননি। খুব মাপা ভঙ্গিতে তিনি বলেছেন, তার সরকার সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন  ও বেআইনি সহিংসতার নিন্দা জানায়।

>> রাখাইনে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের যেসব অভিযোগ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রয়েছে, সেসব প্রসঙ্গ ভাষণে এগিয়ে গেছেন সু চি। তিনি শুধু বলেছেন, ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে ওই অঞ্চলে আর কোনো সহিংসতা বা দমন অভিযান চালানো হয়নি।

>> সু চি দাবি করেছেন, রাখাইন থেকে সবাই পালিয়ে যায়নি, অধিকাংশ মুসলমানই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার ভাষায়, এর অর্থ হল, পরিস্থিতি হয়ত বাস্তবে ততটা খারাপ নয়। 

>> রাখাইনে যারা থেকে গেছেন এবং যারা পালিয়ে গেছেন, তাদের সবার সঙ্গে কথা বলার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন সু চি, যাতে এই সঙ্কটের মূল খুঁজে বের করা যায়।  

>> সু চি বলেছেন, রাখাইনের মুসলমানদের জীবনমানের উন্নয়নে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে তার সরকার। দারিদ্র্যপীড়িত ওই এলাকায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে।   

>> বাংলাদেশে যারা আশ্রয় নিয়েছে, ‘যাচাই বাছাই করে’ তাদের সবাইকেই ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার প্রস্তুত বলেও তিনি জানিয়েছেন।  

প্রতিক্রিয়া

দীর্ঘদিন মিয়ানমারে গৃহবন্দি থেকে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসা অং সান সু চি তার দেশে খুবই জনপ্রিয় একজন রাজনীতিবিদ।  

কিন্তু জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে তার সমালোচনা হচ্ছে।  

রাখাইনে এখন আর কোনো দমন অভিযান চলছে না বলে যে দাবি সু চি করেছেন, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিবিসির সাংবাদিক জোনাথন হেড, যিনি গত ৫ সেপ্টেম্বরের পর নিজের চোখে রোহিঙ্গা প্রাম পুড়তে দেখেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খবর সংগ্রহে এখন তিনি আছেন বাংলাদেশের কক্সবাজারে।    

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রসঙ্গে কিছু না বলে নোবেলবিজয়ী সু চি উট পাখির মত বালির ভেতরে মুখ গুঁজে থাকলেন।

কখনো কখনো তার ভাষণ শুনে ভুক্তভোগীদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা আর মিথ্যার মিশেল বলে মনে হয়েছে অ্যামনেস্টির দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিভাগের পরিচালক জেমস গোমেজের কাছে।

মিয়ানমারে বিবিসির সাংবাদিক জোনাহ ফিশার লিখেছেন, হয় বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সু চি পুরোপুরি অন্ধকারে রয়েছেন, নয়ত সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি স্বেচ্ছায় চোখ বন্ধ করে রেখেছেন।   

“কেন চার লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে গেল তা আমরা জানি না- এমন কথা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। শরণার্থীদের কথাতেই প্রতিদিন তার প্রমাণ আসছে।”