আহত দানিশ সিদ্দিকীকে পেছনে ফেলে এসেছিল আফগান বাহিনী

আবারও আফগানিস্তানের দখল নিতে গত জুনে তালেবান বাহিনী যখন তাদের অগ্রযাত্রা আরও বেগবান করল, যুদ্ধের মধ্যে শত শত মানুষ যখন মরতে লাগল, ঘর বাড়ি হারিয়ে পালাতে লাগল হাজার হাজার মানুষ, দিল্লিতে রয়টার্সের আলোকচিত্র সাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকী ভাবলেন, তারও সেখানে যাওয়া উচিত। ঊর্ধ্বতনকে তিনি বললেন, “আমরা যদি না যাই, তাহলে কে যাবে?”

>>রয়টার্স
Published : 24 August 2021, 06:04 PM
Updated : 24 August 2021, 08:21 PM

৩৮ বছর বয়সী তারকা আলোচিত্র সাংবাদিক ১১ জুলাই কান্দাহারে আফগান স্পেশাল ফোর্সের একটি ঘাঁটিতে পৌঁছান। সেখানে তিনি একটি এলিট কমান্ডো দলের সঙ্গে যুক্ত হন, যাদের কাজ ছিল তালেবান যোদ্ধাদের নির্মূল করা।

দুদিন পর তালেবান ঘেরাও থেকে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্ধারের এক সফল অভিযানে যোগ দেন দানিশ সিদ্দিকী। ফেরার পথে তাদের কনভয়ে রকেটের মাধ্যমে গ্রেনেড হামলা হয়। যে হামভিতে তিনি ছিলেন, সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  

হামভির এক পাশে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ আর ধাক্কার সেই মুহূর্তের ভিডিও নিজের ক্যামেরায় ধারণ করেন দানিশ সিদ্দিকী। সেই ছবি আর প্রতিবেদন রয়টার্সে প্রকাশিত হয়। পরে টুইটারে তিনি নিজেও তা শেয়ার করেন। তার এক বিস্মিত বন্ধুর উত্তর ছিল- “এটা তা পাগলামি”।  

যুদ্ধ, দাঙ্গা আর শরণার্থী সঙ্কটের মত বহু পরিস্থিতিতে কাজ করা দানিশ সিদ্দিকী সেই বন্ধুকে বলেছিলেন, আফগান বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে ছবি তুলতে পাঠানোর আগে রয়টার্স ঝুঁকির মাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখেছে।

রয়টার্সের সম্পাদক আর ব্যবস্থাপকরা এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট অনুমোদন বা নাকচ করতে পারেন। আবার কাউকে অ্যাসাইনমেন্ট থেকে ফিরিয়েও আনতে পারেন। সাংবাদিকরাও পরিস্থিতি বুঝে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে পারেন ওই কাজ থেকে।  

সেই বন্ধুকে দানিশ সিদ্দিকী লিখেছিলেন, “দুঃচিন্তা করো না, কখন ফিরে আসতে হবে সেটা আমি জানি।”

তিন দিন পর ১৬ জুলাই আরেক মিশনে দুই আফগান কমান্ডোর সঙ্গে দানিশ সিদ্দিকী তালেবান হামলায় নিহত হন। সীমান্ত শহর স্পিন  বলদাকের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় আফগান বাহিনীর ওই অভিযানও ব্যর্থ হয়।

তার পরের সপ্তাহগুলোতে একের পর এক এলাকা আফগান বাহিনীর হাতছাড়া হতে থাকে। ১৫ অগাস্ট কাবুলে প্রবেশের মধ্য দিয়ে তালেবানের চূড়ান্ত বিজয় আসে। 

দানিশ সিদ্দিকী

রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সংঘাতের খবর সংগ্রহের জন্য স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের কতটা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়, দানিশ সিদ্দিকীর ঘটনাটি তার একটি উদাহরণ। কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংবাদ মাধ্যমগুলোকেও সব সময় চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। 

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের পর থেকে বিশ্বে ছয়শর বেশি সাংবাদিককে প্রাণ দিতে হয়েছে। এর মধ্যে কেবল আফগানিস্তানেই মারা গেছেন ৩৫ জন, যাতের ২৮ জনই স্থানীয় সাংবাদিক।

দানিশ সিদ্দিকীর লাশের ছবি যখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে গেল, পরিবার আর সহকর্মীদের জন্য তা ছিল বিরাট এক ধাক্কা। কিন্তু তার মৃত্যুর সময় আসলে কী ঘটেছিল, তা তখনও ছিল অস্পষ্ট।

প্রাথমিক খবরে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান সীমান্তের কাছে স্পিন বলদাক বাজারে ছবি তোলার সময় দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যান রয়টার্সের এই আলোকচিত্রী।

কিন্তু রয়টার্সের সঙ্গে তার যোগাযোগগুলো বিশ্লেষণ করে এবং এক আফগান কমান্ডোর বক্তব্য থেকে পরে জানা যায়, তালেবান রকেটের শার্পনেলে আহত হয়েছিলেন সিদ্দিকী। তখন শুশ্রূষার জন্য তাকে স্থানীয় একটি মসজিদে নেওয়া হয়। তার সঙ্গে সেখানে দুজন কমান্ডো।

কিন্তু তাদের সেখানে ফেলে রেখেই সেদিন পিছু হটে যায় আফগান বাহিনী। আর দানিশ সিদ্দিকী এবং তার সঙ্গে থাকা দুই কমান্ডো নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

সে সময় আফগান স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল হাইবাতুল্লাহ আলিজাই। রয়টার্সকে তিনি বলেন, প্রচণ্ড ‍যুদ্ধের পর তার বাহিনীর সৈন্যরা যে সেদিন দানিশ সিদ্দিকী আর দুই কমান্ডোকে ফেলে রেখেই স্পিন বলদাক থেকে পালিয়ে এসেছিল, এর প্রমাণ এখন তার কাছে আছে। আফগান বাহিনী  ভেবেছিল, ওই তিনজন হয়ত তাদের সঙ্গেই ফিরছেন।

তবে দানিশ সিদ্দিকীর মৃত্যু ঘিরে আরও কিছু বিষয় এখনও স্পষ্ট নয়। ছবি, গোয়েন্দ তথ্য আর সিদ্দিকীর লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা রয়টার্সকে বলেছেন, হত্যার পর তালেবান যোদ্ধারা তার লাশ বিকৃত করেছিল। তবে তালেবান তা অস্বীকার করেছে।   

সোশাল মিডিয়ায় আসা দানিশ সিদ্দিকীর ছবি এবং তালেবানের হাত থেকে তার লাশ উদ্ধারের পর করা এক্সরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে ব্রিটিশ ব্যালিস্টিক বিশেষজ্ঞ ফিলিপ বয়েস রয়টার্সকে বলেছেন, মৃত্যুর পরও  এই আলোকচিত্র সাংবাদিককে একাধিকবার গুলি করা হয়েছে।

অবশ্য তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদের দাবি, সিদ্দিকীর লাশে যেসব আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, সেগুলো তালেবান যোদ্ধারা তার লাশ উদ্ধারের আগে থেকেই ছিল।

দানিশ সিদ্দিকীর মৃত্যুর ঘটনা ভারত এবং পুরো বিশ্বের ফটো সাংবাদিক কমিউনিটিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।

দানিশ সিদ্দিকী

২০১৮ সালে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার আইকনিক ছবি তুলে সহকর্মীদের সঙ্গে পুলিৎজার জিতে নিয়েছিলেন দানিশ সিদ্দিকী।

দিল্লিতে গতবছর দাঙ্গার মধ্যে এক মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যার ভয়ঙ্কর দৃশ্য এবং শ্মশানে কোভিডে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ পোড়ানোর সময় স্বজনদের আহাজারির ছবি ক্যামেরায় ধরে আরও খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি, সেই সঙ্গে পাচ্ছিলেন হুমকি।

ম্যাগনামের বিখ্যাত আলোকিচিত্রী রঘু রাই রয়টার্সকে বলেছেন, এসব কাজের মধ্য দিয়ে দানিশ সিদ্দিকী ভারতের একজন গুরুত্বপূর্ণ ফটো সাংবাদিক হয়ে উঠেছিলেন।

তার ভাষায়, দানিশ সিদ্দিকী সেই সব বিরল সাহসী মানুষদের একজন, যারা আজকের পৃথিবীর এসব কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পেত না।  

দুই সন্তানের বাবা দানিশ সিদ্দিকীর এমন মৃত্যু রয়টার্সে তার সহকর্মীদের মনেও দারুণ কষ্টের জন্ম দিয়েছে। আফগানিস্তানে ওই অ্যাসাইনমেন্টে তার নিরাপত্তার দিকটি সঠিকভাবে দেখা হয়েছিল কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন সহকর্মীদের কেউ কেউ। 

দিল্লিতে সিদ্দিকীর সহকর্মী কৃষ্ণ এন দাশ বলেছেন, ১৩ জুলাই আরপিজি হামলায় পড়ে বেঁচে যাওয়ার পরও কেন রয়টার্সের সম্পাদকরা এই ফটো সাংবাদিককে আফগান বাহিনীর সঙ্গে থাকার অনুমতি দিলেন, কেন তাকে ফিরে আসতে বলা হল না, সেই প্রশ্নও সহকর্মীদের মনে রয়েছে।

অবশ্য আরও কেউ কেউ আছেন, যারা মনে করেন, প্রশিক্ষিত আফগান স্পেশাল ফোর্সের সঙ্গে থেকে লড়াইয়ের খবর আর ছবি সংগ্রহ করার যে সুযোগ দানিশ সিদ্দিকী পেয়েছিলেন, সেরকম সুযোগ পেলে অনেকেই তা হাতছাড়া করতে চাইবেন না।

যুদ্ধের ছবি তুলে খ্যাতি পাওয়া রয়টার্সের আরেক আলোকচিত্রী গোরান তোমাসেভিচ বলেন, সিদ্দিক তার শেষ অ্যাসাইনমেন্টে যেভাবে সেনাবাহিনীর সঙ্গী হয়েছিলেন, এ ধরনের কাজে সেটাই সবচেয়ে নিরাপদ বলে ধরা হয়।

ওই সিদ্ধান্ত কীভাবে হয়েছিল, সে বিষয়ে যারা জানেন, তারা বলেছেন, দানিশ সিদ্দিকীর আফগান বাহিনীর সঙ্গে থাকার প্রশ্নে সিনিয়র ফটো এডিররা সমর্থন দিয়েছিলেন। বাইরের কয়েকজন অ্যাডভাইজরও তাতে মতামত দিয়েছিলেন। রয়টার্সের শীর্ষ সম্পাদকরাও তা অনুমোদন করেছিলেন।  

রয়টার্সের প্রধান সম্পাদক আলেসান্দ্রা গ্যালোনি, নির্বাহী সম্পাদক জিনা চুয়া, গ্লোবাল ম্যানেজিং এডিটর (ভিজুয়ালস) জন পুলম্যানও এই সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন।

রয়টার্সের ব্যবস্থাপকদের সাক্ষাৎকার আর ইমেইল যোগাযোগ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ বার্তা সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের সম্পাদকরা ওই সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন না, দানিশ সিদ্দিকীকে স্পিন বলদাকে পাঠানোর বিষয়েও তারা অবগত ছিলেন না।

টমসন রয়টার্স ইনকরপোরেশনের একটি অংশ রয়টার্স এক বিবৃতিতে বলেছে, দানিশ সিদ্দিকীর ওই অ্যাসাইনমেন্ট অনুমোদন করা হয়েছিল ‘সম্মিলিত সিদ্ধান্তে’।

আলেসান্দ্রা গ্যালোনি এক লিখিত বিবৃতিতে বলেছেন, আফগান স্পেশাল ফোর্সের সঙ্গে থেকে দানিশ সিদ্দিকীর কাজ করার সিদ্ধান্তে তিনিও সম্মত হয়েছিলেন এবং সেই সিদ্ধান্তের ‘সম্পূর্ণ দায়’ প্রধান সম্পাদক হিসেবে তিনি নিচ্ছেন।

রয়টার্স বলেছে, সিদ্দিকীর মৃত্যু ঘিরে যা কিছু ঘটেছে, তা ভেতরে এবং বাইরে থেকে আরও পর্যালোচনা করার প্রয়োজন আছে এবং ঘটনাগুলো যাচাই করার জন্য কোম্পানি কাজ করে যাচ্ছে।

প্রধান সম্পাদক গ্যালোনি গত ২৩ জুলাই কর্মীদের উদ্দেশে লেখা এক ইমেইলে দানিশ সিদ্দিকীকে বর্ণনা করেন একজন ‘মেধাবী সহকর্মী এবং নিষ্ঠাবান বন্ধু’ হিসেবে। অপ্রিয় সত্যকে আলোয় আনার জন্য তার যে প্রবল আগ্রহ, তারও প্রশংসা করেন। 

“আমি জানি, আপনাদের অনেকেই কিছু প্রশ্নের উত্তর চান। আমরাও তাই চাই।”

যে পর্যালোচনা এখন চলছে, তার ভেতরে কর্মীদের নিরাপত্তায় রয়টার্সের নীতিমালার বিষয়টিও রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।