দুদকের তদন্তের গতি-প্রকৃতি নিয়ে ‘হতাশ’ তৌফিক ইমরোজ খালিদী

একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ফার্মের সঙ্গে বিনিয়োগ চুক্তির পর দুদকের ‘তদন্ত’ শুরু এবং ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করাসহ যা কিছু গত প্রায় চার মাসে ঘটেছে, তাতে হতাশা প্রকাশ করে কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2020, 06:13 PM
Updated : 24 Jan 2020, 06:47 PM

শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত কলামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি জানতে চেয়েছেন, ‘নৈতিক সাংবাদিকতার’ চর্চা করাই তার এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ‘ভুল’ ছিল কি না।

তিনি প্রশ্ন করেছেন- ‘অনেক প্রথমের জন্ম দেওয়া’ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ‘ক্ষতি করে কার স্বার্থ হাসিল’ করা হচ্ছে? বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং যিনি এর নেতৃত্বে, তার ‘ভাবমূর্তি নষ্ট করে কার কী লাভ’?

“সব মিলিয়ে এ এক হতাশাজনক পরিস্থিতি। কিছু বিতর্কিত লোক, যাদের কাজ সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটা নগ্নভাবে ব্যবহার- এটা আমরা কখনও দেখতে চাই না, যখন আমরা সেরকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, যেটাকে মানুষ অনুকরণ-অনুসরণ করবে, যেটা হবে মানুষের ভরসার জায়গা।… বাস্তবিক অর্থেই আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।”

কোন পরিস্থিতিতে কী পরিকল্পনা নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বিনিয়োগ চুক্তি করেছিল, সেই অর্থ কোথায় কীভাবে আছে বা ব্যয় হয়েছে, কেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী নিজের হাতে থাকা কিছু শেয়ার বিক্রি করেছেন এবং ওই চুক্তির পর কী কী ঘটেছে তার একটি বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে ‘অল ফর জার্নালিজম!’ শিরোনামে ওই নিবন্ধে। ইংরেজি থেকে অনূদিত একটি বাংলা সংস্করণও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রকাশ করেছে।

গত ১৩ অক্টোবর এক প্রতিবেদনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, তাদের কোম্পানিতে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ। ওই বিনিয়োগের একটি বড় অংশ তারা ব্যয় করবে ডিজিটাল সংবাদ সেবার সম্প্রসারণ ও উদ্ভাবনে।

কিন্তু পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তাৎক্ষণিকভাবে ওই ‘বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত’ থাকার নির্দেশ দেয়। তার দুই সপ্তাহের মাথায় দুর্নীতি দমন কমিশন ‘জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অবস্থান গোপনের’ অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিরুদ্ধে ‘অনুসন্ধান’ শুরু করে। 

দুদকের চিঠি পেয়ে গত ২৬ নভেম্বর কমিশনের কার্যালয়ে গিয়ে নিজের বক্তব্য জানিয়ে আসেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী। এরপর তার এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ‘অবরুদ্ধ’ করা হয়, এখনও তা সেই অবস্থাতেই আছে। 

তিনি লিখেছেন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিকাশ, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ নিশ্চিত করতে ওই বিনিয়োগ তাদের প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া দীর্ঘদিনের ‘স্বল্প বিনিয়োগ কিংবা বিনিয়োগ খরার’ কারণে কর্মীদের অনেকের বেতন বকেয়া পড়ছিল, বেড়ে যাচ্ছিল দায়; সে কারণে কোম্পানির ৩৭ হাজার ১০০ টাকা মূল্যমানের প্রতিটি শেয়ার মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকায় ছেড়ে দিতে হয়েছে তাকে।

সেই চুক্তি হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো যে গতিতে তৎপর হয়েছে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদকের ভাষায় তা ছিল ‘অস্বাভাবিক’। সেই সঙ্গে ‘পেশাদারিত্বের নিদারুণ ঘাটতি’ও তিনি দেখেছেন। যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, সেগুলোর প্রাথমিক কোনো প্রমাণ (prima facie evidence) আছে কি না- তা খোঁজার ‘সামান্যতম চেষ্টাও’ তিনি এসব সংস্থার মধ্যে দেখেননি। বরং তথ্য-প্রমাণের ‘ধার না ধেরে’ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলো ‘গুজবের পেছনে’ ছুটেছে। 

তৌফিক ইমরোজ খালিদী লিখেছেন, “দুদকের ওই পদক্ষেপ সম্পর্কে যারা জানেন এবং বিনিয়োগের বিষয়গুলো সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন, সেদিন আমার দেওয়া ব্যাখ্যার পর তাদের কাছে অন্তত এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা যে দুদকের ওই ‘অনুসন্ধান’ আর এগিয়ে নেওয়া ছিল অর্থহীন। আমার একজন সাবেক সহকর্মী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এক পোস্টে পুরো বিষয়টিকে বর্ণনা করেছেন ‘হয়রানি’ হিসেবে।”

তিনি বলেছেন, ওই বিনিয়োগ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে পাওয়া অর্থের ২৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়েছে কোম্পানির পুঞ্জিভূত দায়ের একটি বড় অংশ মেটাতে। আর তার শেয়ার বিক্রির টাকা কোথায় আছে তা এফডিআর অ্যাকাউন্টগুলো দেখলেই ‘বোঝা যায়’।

“পত্রিকার খবর বলছে, ওই টাকা আমি অন্য দেশে পাচার করে দিতে পারি- এই যুক্তি দেখিয়ে দুদকের আইনজীবী আমার অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করার আদেশ চেয়েছিলেন আদালতে। আর সেই আবেদনেই আদালত নাকি ১ ডিসেম্বর আদেশ দিয়েছে, যদিও আজ পর্যন্ত সেই আদেশ সংক্রান্ত কোনো চিঠি আমার হাতে পৌঁছেনি।”

এলআর গ্লোবালের সঙ্গে চুক্তির পর কীভাবে সোশাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ‘গুরুতর অভিযোগ বা গুজব’ ছড়ানো হয়েছে, ‘কুৎসা রটানোর চেষ্টায় কীভাবে সর্বশক্তি নিয়োগ’ করা হয়েছে, তার কিছু নমুনাও ওই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে।  

তৌফিক ইমরোজ খালিদী লিখেছেন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আর্থিক ভিত্তি শক্ত করার জন্য যেসব পরিকল্পনা তারা নিয়েছিলেন, অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ রাখায় সেগুলো আটকে আছে। বিনিয়োগকারী এবং বিনিয়োগগ্রহীতা- দুই পক্ষকেই সুফল থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।

যেভাবে ‘অবরুদ্ধ’ থাকতে হচ্ছে, সেই অনুভূতি ‘সুখকর কিছু নয়’ মন্তব্য করে তিনি লিখেছেন, “বিনিয়োগ চুক্তি সইয়ের পর প্রায় চার মাস হতে চললো, এখনও আমরা তাকিয়ে আছি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ, দুদকও ‘অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের’ অভিযোগের বিষয়ে কোনো ফাইনাল রিপোর্ট দেয়নি।”

তদন্তাধীন বিষয়ে কেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত কলামে লিখতে গেলেন, সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন সংবাদ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সম্পাদক।  

তিনি বলেছেন, “এখানে লিখছি এ কারণে যে, যা কিছু হচ্ছে, ঘটেছে, তার একটি ব্যাখ্যা আমাদের লক্ষ-কোটি পাঠককে দেওয়া উচিৎ বলে আমার মনে হয়েছে।”

২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের পর থেকে গত ১৩ বছরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কীভাবে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও ‘দেশের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য’ সংবাদমাধ্যম হিসেবে পাঠকের আস্থা ধরে রেখেছে, সে কথাও তৌফিক ইমরোজ খালিদী লিখেছেন।   

হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, “এমন এক অস্থিরমতি সমাজে আমরা বাস করি, যা নিঃস্বার্থ একদল সংবাদকর্মীর নিষ্ঠা আর ঐকান্তিকতার কথা ভুলে গেছে দ্রুত; এ বড় বেদনার।”

তার ভাষায়, “এই দীর্ঘ পথযাত্রার কোনো পর্যায়ে কোনো অন্যায় করেননি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাংবাদিক-কর্মীরা। যা কিছু করা হয়েছে, তার নাম সাংবাদিকতা।”