নিজে ভালো থাকতে চাইলে ‘নার্সিসিস্ট’ মানুষদের এড়িয়ে চলাই হবে মঙ্গলজনক।
Published : 16 Oct 2022, 12:01 PM
বিশেষ এক ধরনের ‘নার্সিসিস্ট’ মানুষের কাছ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে।
‘নার্সিসিস্ট’ বলতে অনেকেই হয়ত বোঝেন এমন একজন মানুষকে যে নিজের বড়াই করতে পছন্দ করেন। তবে এর প্রকৃত অর্থের পরিধি আত্মদম্ভের বাইরেও অনেকটা বিস্তৃত।
যেমন- আপনার যে বন্ধুটি আড্ডায় বসে নিজের প্রেমের জীবনের কচকচানি, অফিসের বসের বদনাম কিংবা নিজের জীবনের লক্ষ্য বলতে থাকে অনবরত, তাকেও ‘নার্সিসিস্ট’ বলা যায়। সেই বিবেচনা এই শব্দের অর্থ অনেকটাই অসামাজিকতার সমার্থক।
একজন মানুষের মাঝে ‘নার্সিসিজম’য়ের মাত্রা যেমনই হোক না কেনো তার কেন্দ্রবিন্দু হল- নিজের গুরুত্বকে অপরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া।
সাধারণ ‘নার্সিসিস্ট’য়ের মাঝে এই আচরণ কালেভদ্রে দেখা যায়। আর ‘ক্লিনিকাল কন্ডিশন নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার’য়ের ক্ষেত্রে এই আচরণ হয় সবসময়।
এদের বৈশিষ্ট্য
যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ফোরশে (সাইকডি) বলছেন, “যে মানুষের চাহিদা হল প্রতিনিয়ত আশপাশে মানুষগুলোর মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া এবং যার মাঝে অপরের প্রতি সহমর্মীতার লেশমাত্র নেই তাকে ‘নার্সিসিস্ট’ বলা যায় নির্দ্বিধায়।”
ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের মানুষের সঙ্গে যে কোনো রকমের সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে মত বিরোধ সামাল দেওয়া হয় সব চাইতে বড় ঝামেলার। মিলিতভাবে কোনো সিদ্ধান্তে আসা, সমাধানে আসা সবকিছুই সেখানে জটিল। কারণ ‘নার্সিসিস্ট’ ওই ব্যক্তির মতগুলো হয় আত্মকেন্দ্রিক, অনৈতিক। আর তার মত না মানলেই বিপদ।”
মানসিক সুস্থতা বিষয়ক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘রিয়েল ডটকম’য়ের প্রধান কর্মকর্তা ডা. র্যাচেল হফম্যান বলেন, “সম্পর্কের এমন পরিস্থিতিতে একজন স্বাভাবিক মানুষ সবসময় নিজেকে তুচ্ছ অনুভব করবে, ভুগবে অনিশ্চয়তায়। আর সেটাই তৃপ্তি দেয় ‘নার্সিসিস্ট’কে।”
সামনের মানুষটাকে ছোট করা মানেই হল সে নিজে সর্বোত্তম। সময়ের ফেরে একসময় স্বাভাবিক মানুষটি মনে করবে ওই ‘নার্সিসিস্ট’ ব্যক্তির প্রয়োজনগুলোর সামনে নিজের প্রয়োজনগুলো খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফলে এই দুই মানুষের সম্পর্কের প্রধান বিষয় হবে ওই ‘নার্সিসিস্ট’কেই খুশি রাখা।”
কিন্তু নার্সিসিস্ট’কে চেনা যায় না যে কারণে
নর্থ ক্যারোলাইনার নিবন্ধিত ‘ম্যারেড অ্যান্ড ফ্যামিলি থেরাপিস্ট’ লেসলি দোয়ারেস বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন স্বাভাবিক মানুষ বিশ্বাসই করতে পারেন না যে, একটা মানুষ এতটা আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে। ‘নার্সিসিস্ট’ অপরের সঙ্গে যত্নশীল আচরণ করতে পারে ঠিক, তবে তার পেছনে প্রায় সবক্ষেত্রেই কোনো না কোনো স্বার্থ থাকেই।”
এখন সেই আচরণগুলো স্বাভাবিক মানুষকে একটা ভুল ধারণা দেয়, যার প্রেক্ষিতেই মুলত তার আত্মকেন্দ্রিকতার প্রতি অবিশ্বাসটা জন্মায়। আশার কথা হল খুব দ্রুতই সেই আচরণ রূপ বদলায়, প্রকৃত চেহারা সামনে আসে।
ডা. হফম্যান বলেন, “এই মানুষগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার শুরুতে তারা আপনার জন্য ভালোবাসা বর্ষণ করবে। আপনার গালভরা প্রশংসা করবে, যা আপনার আত্মদম্ভ বাড়াবে। আপনি মনে করবেন এই মানুষটা আমাকে কতইনা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।”
তবে এর পেছনে প্রধান উদ্দেশ্যটা আসলে একটাই, আপনি যাতে তাকেই বেছে নেন। এরপর তারা আপনাকে তাদের জীবনে সেই দিকগুলোই দেখাবে যা থেকে তাদের ক্ষমতা, মেধা, সৌন্দর্য ইত্যাদিই শুধু প্রকাশ পায়।
“আপনি যদি তাদের ‘নার্সিসিস্টিক’ আচরণ ধরে ফেলতে পারেন আর তখনও যদি ওই মানুষটার আপনাকে প্রয়োজন থাকে তবে সে আচরণ বদলাবে, আবারও যত্নবান হয়ে উঠবে।”
নানান ধরনের ‘নার্সিসিস্ট’
ডা. হফম্যান এই বিশেষ আচরণের মানুষগুলোকে দুই দলে ভাগ করেন, ‘দ্য ওভার্ট’ এবং ‘দ্য কোভার্ট’।
তিনি বলেন, “‘দ্য ওভার্ট’ ধাঁচের ‘নার্সিসিস্ট’কে আপনি দূর থেকেই চিনে যাবেন। তারা প্রত্যক্ষভাবে প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক, আত্মদম্ভে ভরা, প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব তাদের মাঝে প্রকট। তাদের সঙ্গে আলোচনা তখনই সামনে এগোবে যদি তা ওই ব্যক্তি সম্পর্কে হয়, এছাড়া নয়। আবার আপনার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করে ফেলতে তাদের একটুও বাধে না।”
“আর কোভার্ট’ ধাঁচের ‘নার্সিসিস্ট’কে চেনাই হল মুশকিলের। এদের আত্মমর্যাদাবোধ থাকে খুবই কম, আর তাদের সেই অনুভুতিটাই ‘নার্সিসিজম’ হিসেবে প্রকাশ পায়। এর প্রধান কারণ হল- এরা নিজের সম্পর্কে কোনো সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। ফলে কোনো কাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দিয়ে তারা সেখান থেকে সরে পড়বে নির্দ্বিধায়, তার আচরণের দায়ভার নেবে না।”
‘দ্য ওভার্ট’ এবং ‘দ্য কোভার্ট’কে আরও কয়েকভাগে ভেঙেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট’ জন মেয়ার।
‘দ্য ওভার্ট’য়ের রকমগুলো হল
টক্সিক নার্সিসিস্ট: ডা. মেয়ার বলেন, “এই ধাঁচের নার্সিসিস্ট নুন্যতম মাত্রায় অন্যের জীবনে বিভিন্ন নাটকীয়তার জন্ম দেয়। আর অতি তীব্রতায় মানুষের মানসিক কষ্ট এমনকি তার জীবন ধ্বংষ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
ধরা যাক, আপনার একজন বন্ধু আছে যে প্রতিনিয়ত সময় ও মনযোগ প্রত্যাশা করে। আর তা যদি আপনি পূরণ করতে না পারেন তবে খারাপ ব্যবহার করে। এরাই ‘টক্সিক নার্সিসিস্ট। এদের মধ্যে বিশেষ একটি ধরণ হলো ‘সাইকোপ্যাথিক নার্সিসিস্ট’। এরা অপরকে আক্রমণ করে, শারীরিক আঘাত করে এবং সেই কাজের জন্য তাদের মধ্যে নুন্যতম অপরাধবোধ থাকে না।
‘সিরিয়াল কিলার’দের অধিকাংশই এই ধারার মধ্যে পড়ে।
দ্য এক্সিবিশনিস্ট নার্সিসিস্ট: এরা নিজের ‘নার্সিসিজম’ অকপটে স্বীকার করে। আশপাশের মানুষকে এরা ব্যবহার করে। প্রচণ্ড উদ্ধত প্রকৃতির, অহংকারী। তাদেরকে মনযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেই হবে, নইলে তারা অস্বস্তি বোধ করে।
বুলিইং নার্সিসিস্ট: অনদের আক্রমণ করা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা- দুটি ভয়ানক বৈশিষ্ট্যই এদের মধ্যে বিদ্যমান। অন্যদের আক্রমণ করার জন্যই তারা নিজেদের গড়ে তোলে, যেভাবেই হোক তাকে জিততেই হবে সবখানে।
অন্যদের অপমান করে, হেয় করে, ছোট করে তারা তৃপ্তি পায়। অন্য কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা এমনটা করে না, বরং এমনটা করাই হল তাদের স্বার্থ।
‘দ্য কোভার্ট’য়ের রকমগুল হল
দ্য ক্লোজেট নার্সিসিস্ট: এই ধাঁচের ‘নার্সিসিস্ট’ চেনা অত্যন্ত জটিল। এরা মানুষ বা সমাজের কাছে তাদের মনোভাব প্রকাশ করে না ঠিক কিন্তু ‘নার্সিসিজম’য়ের ধারণাকে তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন।
এরা অপরকে হিংসা করে, মানুষের কাছ থেকে হুজুর হুজুর ব্যবহার আশা করে, সহানুভূতি তাদের মাঝে কম। এরা বাইরে বোঝায় যে তারা নিঃস্বার্থ কিন্তু মনে মনে আশা করে যে মানুষ তাদের বড় চোখে দেখুক।
দ্য সিডিউসার নার্সিসিস্ট: এরা প্রচণ্ড ভালোবাসায় সিক্ত করে শুরুতে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য। কারও সঙ্গে ভালোবাসার কিংবা শুধুই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এরা প্রাথমিকভাবে যত্নবান হয়।
কিন্তু সেই সম্পর্কটা তৈরি করাটাই শুধু তার উদ্দেশ্য, সম্পর্ক বজায় রাখা নয়। একবার মন জয় করা হয়ে গেলে পরক্ষণেই তা ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
দ্য ভালনারেবল নার্সিসিস্ট: এরা মনে করে সবাই তাকে পেতে চায়। অন্যান্য সবার মতো এরাও কারও কাছ থেকে নিজের সমালোচনা শুনতে পারে না।
তবে এক্ষেত্রে বিশেষ ব্যাপার হলো- তারা মনে করে সবক্ষেত্রে তারা ভুক্তভোগী, জগত সংসারে সকল অনৈতিকতা, অবহেলা তাদের প্রতিই হয়েছে। ফলে আপনার সহমর্মীতা, সহানুভুতি, সাহায্য তাদের প্রয়োজন।
তবে সমস্যা হল, আপনি যতই তা দেন না কেনো, তাদের চাহিদা কখনই যেন কমতে চায় না।
আরও পড়ুন