পুরান ঢাকার হালুয়া রুটি

মাছ, কুমির কিংবা বড় আকারের গোল রুটি সঙ্গে বাহারি পদের হালুয়া আর মিষ্টি।

মামুনুর রশীদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2022, 12:20 PM
Updated : 18 March 2022, 12:20 PM

আর এসবই মিলছে শবে বরাত উপলক্ষ্যে চক বাজারসহ পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে।

এই দিনে হালুয়া রুটির ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন সুপার শপ, মিষ্টির দোকানেও বসেছে বিভিন্ন ধরনের হালুয়া রুটির পসরা। তবে পুরান ঢাকার কথা আলাদা।

চক বাজারে গিয়ে দেখা মিলেছে বিশেষ সেই রুটির আয়োজন। রাস্তার পাশে চৌকি নিয়ে আর প্যান্ডেল খাটিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসেছে রুটির দোকান। সঙ্গে আছে বিভিন্ন পদের হালুয়া।

তবে হালুয়া কম রুটির জৌলুশই যেন বেশি। গোল, চারকোনো রুটিতে অসংখ্য নকশার সমাহার। কেউ আবার রুটি বানিয়েছেন মাছ কুমির ইত্যাদির আদলে।

অথচ একসময় ঘরে ঘরেই তৈরি হত হালুয়া রুটি। সেটা আবার ঘটা করে বিলানো হত পড়শীদের বাড়ি বাড়ি।

সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ব্যাংক এশিয়ার সাত মসজিদ রোড শাখা প্রধান স্বরূপ জাহিদ তার ফেইসবুকের পাতায় লেখেন, “এই শহরে আশি বা নব্বই দশকে কোনো প্যাকেজ ছিল না। ছিল উৎসব। সেটা হোক ধর্মীয় বা অন্য কোনো পার্বণ। চার দশক আগেও শবেবরাতে আমার মা ঘরে হালুয়া বানাতেন। বুটের হালুয়াটারই বেশি চল ছিল তখন। এছাড়াও ছিল সুজির হালুয়া, পেঁপের হালুয়া আর গাজরের হালুয়া। নেশেস্তার হালুয়াও ছিলো। কিন্তু তা ঢাকায় অনেক পরে জনপ্রিয় হয়।”

“এসব হালুয়া বানিয়ে এক ধরনের বিশেষ ডিজাইনের ছাঁচে ফেলে হালুয়াটা কাটা হত। তখন এর নতুন নাম হতো বরফি। আমি জানি না, আজও ঢাকা শহরে বাসাগুলোতে বরফির চল আছে কিনা?”

তিনি আরও লিখেছেন, “গোসল করে মাগরিবের নামাজ পড়ে রেডি হতাম আমরা। তারপর হালুয়া রুটি খেয়ে মসজিদে এশার নামাজ। আর ঠিক এই সময়টায় চলতো বাসায় বাসায় হালুয়া রুটির আদান প্রদান। সিলভারের বড় থালায় প্রতিটা বাসার মা-খালারা হালুয়া আর চালের রুটি সাজিয়ে দিতেন। পাড়ার ছোট মেয়েদের মধ্যে সে কি উৎসবের আমেজ, এই হালুয়া রুটি বিতরণের। সিলভারের থালায় হালুয়া সাজিয়ে তার ওপর লাল ওড়না দিয়ে ঢেকে পাড়ার মেয়েরা বেড়িয়ে পড়ত। আর ওদিকে মসজিদে মসজিদে ছেলেদের ভীড় বাড়তে থাকতো প্রার্থণার জন্যে।”

আর এই ঐতিহ্য একদিনে আসেনি। এসেছে পরম্পরায় মোগল আমল থেকে।

বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছিলেন, “সে সময়ে হিন্দুদের আধিপত্য থাকার কারণে সেটিকে মোকাবেলা করার জন্য ঢাকার নবাবরা শবে বরাতে অনেক বড় আয়োজন করতেন। এতে ঢাকার নবাবদের মুসলমান পরিচয় এবং আধিপত্য- এ দুটো বিষয় একসঙ্গে তুলে ধরার প্রয়াস দেখা যেত।”

তিনি আরও জানান, “নবাবরা যেহেতু মুসলিম ছিলেন এবং ঢাকাকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেজন্য উৎসবগুলোকে তারা গুরুত্ব দিতেন। এর মাধ্যমে নবাবদের আধিপত্য, মুসলমানদের আধিপত্য এবং ধর্ম পালন- এ তিন বিষয় একসঙ্গে প্রকাশ হতো। ১৯শ শতকের শেষের দিকে ঢাকায় শবে বরাত পালন মুসলিম পরিচয় প্রকাশের বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।”

তবে মানুষের ব্যস্ততায় এখন ঘরে ঘরে হালুয়া রুটির প্রচলনও কমেছে। হয়ত এই কারণেই চলছে বিভিন্ন দোকানে হালুয়া রুটির প্যাকেজ।

পুরান ঢাকার চক বাজারের জামাল বেকারির বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ হাসান বলেন, “শবে বরাত উপলক্ষ্যেই এই বিশেষ আকৃতির রুটি এত বেশি পরিমাণে তৈরি করা হয়। রুটি বিক্রি হয় কেজি দরে, তিনশ থেকে চারশ টাকা কেজি।”

“এই রুটিতে যোগ করা হয় বিভিন্ন ফলের টুকরা, কিশমিশ, মোরব্বা ইত্যাদি। সঙ্গে থাকে হালুয়া।”

সশরীরে ঘুরে দেখা গেছে বিক্রি হচ্ছে বুট, গাজর, নেশেস্তা ও সুজির হালুয়া। বুটের হালুয়া ৪শ’ টাকা কেজি। গাজরের হালুয়া ৬শ’ টাকা ও আর নেশেস্তাসহ অন্যান্য হালুয়ার কেজি ৮শ’ টাকার মধ্যে।

চক বাজারে রুটি হালুয়ার দোকান সবচাইতে বেশি দেখা গেছে। শহরের অন্যান্য অংশের মিষ্টির দোকান ও বেকারিগুলোতেও এই নকশি পাউরুটির পসরা বসেছে।

আরও পড়ুন: