অঞ্জন দত্তে সুরে যখন গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হয় ‘বন্ধুত্বের হয়না পদাবী, বন্ধু তুমি কেঁদো না’- তখন বলা যেতেই পারে বন্ধুত্বের বন্ধন অন্য কোনো বন্ধনে বাঁধাই যায় না।
তাই প্রতিবছর অগাস্ট মাসের প্রথম রবিবার পালিত হওয়া বন্ধু দিবসে হাজারও ব্যস্ততার ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটানো যেতেই পারে।
তবে সব বয়সের বন্ধুত্ব কি একরকম হয়! তাতো হওয়ারও নয়।
একদম ছোট শিশুর যেমন খেলার সঙ্গে লাগে তেমন বুড়ো খুনখুনে মানুষটারও মনের পাখনা মেলতে একজন বন্ধু লাগে। নানান বয়সের বন্ধুত্বের সম্পর্কে থাকে নানান রকমের দিক।
বাল্যবন্ধু যেখানে শুধুই খেলার সাথী, বার্ধক্যের বন্ধুকে পালন করতে হয় অসুস্থ বন্ধুর সেবা।
জীবন যখন জটিল হয়ে ওঠে তখন কেমন হয় বন্ধুত্বের ধরণ এটাই জানতে চাওয়া হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে—
এসএনটি বাংলাদেশ লিমিটেড’য়ের জ্যেষ্ঠ সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার মেহেদী হাসান বলেন, “বন্ধু মানে আত্মার সঙ্গে সংযোগকারী কেউ। ছোটবেলায় বন্ধু মানে ছিল খেলাধুলার, লেখাপড়ার এমনকি বকুনি বা পিট্টি খাওয়ারও সাথী। বড় বেলায় এসে এখনও তারা আনন্দের সবচেয়ে বড় উৎস।”
মেহেদীর মতে, বড় বয়সে এসে সর্বক্ষণের সাথী বলতে যে বন্ধু তারা আসলে পেশাগত জীবনে সহকর্মী। তবে সেটা শুধুই অফিসের কাজ আর মিটিং-এই। যেহেতু এখন বেশিরভাগ সময় তাদের সঙ্গেই থাকা হয় তারাই সব সুখ দুঃখের সঙ্গী। অফিস শেষেও তাই কথা ফুরায় না, আড্ডাও জমে থাকে অনেকক্ষণ। মাঝে মাঝে সেই আড্ডা থেকেই ‘হারে রে রে’ করতে করতে বেড়িয়ে পরা হয় কোনো অভিযানে। কাজ শেষে দিব্যি একটা সময় কেটে যায়।
তিনি আরও বলেন, “স্কুলে কলেজের বন্ধুদের থেকে সহকর্মী বন্ধুদের গুরুত্ব কোনো অংশ কম তো নয়ই, উল্টা বেশি। সহকর্মী বন্ধুরা আপনার কাজটাকে ঠিক আপনার মতো করেই বুঝবে। এর সুবিধা অসুবিধা, কী করলে আপনি উন্নতি করতে পারেন, কোন কাজ করলে আপনার ক্ষতি হতে পারে এগুলো বিষয়ে সুন্দর একটা নির্দেশনা শুধু মাত্র সহকর্মী বন্ধুদের থেকেই পাওয়া সম্ভব।”
জিনায়দা ইরফাতের একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা। কাজ করতেন পরিকল্পনা কমিশনে। তার কাছে বন্ধুত্ব বিষয়টা আরও একটু অন্য রকম।
তিনি বলেন, “আমাদের সময়টা এখনকার তুলনায় একটু সহজ ছিল। আর খুব আন্তরিকও। ফলে সহজেই আমরা একে অপরের বন্ধু হয়ে যেতে পারতাম। সেটা পরিবারের মানুষ হোক, হলের রুমমেট হোক অথবা অফিসের কলিগ বা জুনিয়ার।”
তিনি আরও বলেন, “এখন কাজ ছেড়ে বসে আছি তাও আমাদের বন্ধুত্ব বা আলাপ শেষ হয়নি। এখনও পরিকল্পনা কমিশনের প্রাঙ্গণে আমাদের আড্ডা বসে। কখনও কখনও কাজ ছাড়াও নিছক গল্প করতেও পুরানো সহকর্মীরা একসঙ্গে হই। আবার মন চাইলেই বেড়িয়ে পড়া হয় কোনো ভ্রমণে। হতে পারে সেটা কোনো পর্যটনের জন্য বিখ্যাত জায়গা অথবা আমাদেরই কোনো একজনের গ্রামের বাড়ি।”
“শুধু যে অফিসের বন্ধুরাই এখনও টিকে আছে তাই নয়। বিশ্ববিদ্যালয় বা হলের বন্ধুদের সঙ্গেও সম্পর্ক এখন নতুন করে চাঙ্গা হয়েছে। আগে কাজের ফাঁকে দেখা করার সময় বের করতে হত, এখন দিনভর ফোনে, ফেইসবুকে, চ্যাটিং এ আমরাও বেশ জুড়ে থাকতে পারি।”
আগের যুগের সঙ্গে এখনকার সময়ে কেমন তফাত জানতে চাইলে জিনায়দা জানান, “আমাদের সময় তেমন ফটোকপি বা প্রিন্টিং-মেইলিং এর বিষয় ছিল না। আমরা ছয় বান্ধবী ছিলাম, এক এক বিষয়ে একেক জন নোট বানাতাম। যে, যে বিষয়ে নোট করতাম নিজের নোটের নিচে আর পাঁচটা কার্বন পেপার রেখে লিখতে থাকতাম। যেন বাকি পাঁচজনের আর কপি করার প্রয়োজন না হয়।”
“এখন আমাদের জীবন অনেক বদলে গিয়েছে, তাই চাহিদা এবং সাহায্যের ধরনও বদলেছে। এখন কারও সন্তানের বিয়েতে অথবা কারও অসুস্থতার মতো কাজগুলোতে আমরা একে অপরের পাশে থাকার চেষ্টা করি। একক পরিবারের জীবনে এসেও বন্ধুদের সহায়তাও যৌথ পরিবারের মতো সাহায্যের হাত পেয়েই যাই। তাই আমার কাছে বন্ধু মানে হল কখনও একা না হওয়া।” এভাবেই শেষ করেন জিনায়দা।
নূর-এ-নাজিয়া একটি কনসালটেন্সি ফার্মে অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। তার কাছে বন্ধু মানেই সব। মজার কথা হচ্ছে নাজিয়ার বন্ধুরা কেউ তার সমবয়সি নয়। এমনকি তারা কখনও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মক্ষেত্রেও একসঙ্গে ছিলেন না।
নাজিয়ার ভাষায়, “প্রতিটা বয়সই অন্যকে নতুন নতুন প্রকরণে সমৃদ্ধ করে। তাই বয়সে কেউ ছোট বা বড় হলে তেমন কিছুই যায় আসে না।”
তার বন্ধুর দলে যেমন কে বড় বা ছোট কোনো বিষয় নয়, তেমনি কে নারী বা পুরুষ এটাও বড় বিষয় না।
নাজিয়ার মতে, “হ্যাঁ, এইখানে অবশ্যই নারী বা পুরুষের প্রয়োজন বা সুবিধা অসুবিধা বোঝা হয় এবং সে অনুযায়ী চলাও হয়। তবে একজনের অসুবিধাটা অতিক্রম করতেই কেবল লিঙ্গের বিষয়টা সামনে আসে, কারও যোগ্যতা মাপতে নয়।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন এভাবে, “আমাদের দলে ভিন্ন ভিন্ন রকমের মানুষ আছে। তাদের পেশা আলাদা, লেখাপড়ার বিষয় আলাদা, কাজের ক্ষেত্রও আলাদা। এতে লাভের লাভ যেটা হয়, যে কোনো বিষয় নিয়ে আমরা যখন আলাপ করি তখন আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীটাকে দেখার একটা সুযোগ আমাদের হয়। কখনও হয়ত নিজের অবস্থান থেকে কোনো কিছুকে আমাদের ভীষণ অন্যায় বা গর্হিত কাজ বলে মনে হয়। কিন্তু অন্য একটা অবস্থান থেকে যখন সেটার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তখন সমালোচনা না করে অন্যের সমস্যাটাও বোঝার মতো একটা মন তৈরি হয়।”
“বন্ধুদের থেকে আমি যেমন সহায় পাই, তেমন শাসনও পাই। মাঝে মাঝে এমন করে বন্ধুরা ভেঙে ভেঙে দোষটা বুঝিয়ে বলে, যেমন- ছোটবেলায় মা বলত। বকুক বা শাসন করুক বন্ধুরা আমার খুবই প্রিয়।” যোগ করলেন নাজিয়া।
আবার সন্তানের সূত্রেও অভিভাবকদের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠতে পারে। যেমন হয়েছে নাজিয়ার মা রাশিদা আহমেদের ক্ষেত্রে।
বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে মনোমালিন্য হলে কী হয় এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সম্পর্কে চলতে চলতে খানিকটা মনমালিন্য হতেই পারে। এগুলো সম্পর্কের অংশ। দাবী যেমন বেশি থাকে রাগও বেশিই থাকি। কখনও কখনও আমার সঙ্গে অন্য কারও বা অন্যদের মধ্যেও লেগে যায়। আবার সবাই মিলে তার অভিমান ভাঙানো হয়। তবে রাগ করুক আর যাই করুক। কিছু বিষয় থাকে যেটা সমাজ স্বীকৃত খারাপ কাজ। সেই পথে কেউ গেলে তাকে যেভাবেই হোক ফিরিয়ে আনতেই হবে।”
তাই তো বন্ধু দিবসে অঞ্জন দত্তের সুরে সুর মেলাতে চাইলে গেয়ে ওঠা যায়,
“হয়তো তোমার আলনায়
থাকবে না আমার জামা
ঝুলবে না তোমার বারান্দায়
আমার পাঞ্জাববি পাজামা
তবু মনের জানালায়
অবাধ আনাগোনা
দুজনা!”
এই বন্ধু দিবসে বিভিন্ন বয়সি বন্ধুরা নানানভাবে উৎযাপন করবে তাদের বন্ধুত্ব। তবে দিবস একদিনের হলেও প্রাণের সখার সঙ্গে মন উজাড় করা চলবে সারা জীবন।