হয়ত গোসল করার সময় দেহের সবচেয়ে নোংরা অংশগুলোই পরিষ্কার করা হচ্ছে না ঠিক মতো।
Published : 18 Nov 2023, 03:16 PM
পরিচ্ছন্ন থাকার সবচেয়ে সহজ ও সঠিক উপায় হল প্রতিদিন গোসল করা। তবে আদৌ গোসল সঠিক উপায় করা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে অনেকেই জানিনা।
টুডে-ডটকম’য়ের আয়োজনে ২০১৯ সালের এক ইন্টারনেট ভিত্তি বিতর্কে উঠে আসে যে, গোসলের সময় পা ভালো মতো ধোয়াও গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া প্রতিনিয়ত সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়ার কথা মনে থাকলেও গোসলের সময় কানের পেছনে, পায়ের আঙুল অথবা নাভির অংশ যে ভালোমতো পরিষ্কার করার প্রয়োজন আছে- সে বিষয়ে বড়দের দেওয়া পরামর্শ অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ভুলে যাই।
পূর্ববর্তী প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা পরামর্শ আমাদের ওপর প্রভাব ফেলে কিনা তা নিয়ে কৌতুহলি হয়ে ‘জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি (জিডব্লিউ)’র গবেষকরা পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক এক গবেষণা চালান। যেটা ‘দ্য গ্র্যান্ডমাদার হাইপোথিসিস’ নামে পরিচিত।
গ্র্যান্ডমাদার হাইপো থিসিস- বলতে যা বোঝায়
জিডব্লিউ’র ‘বায়োস্ট্যাটিস্টিকস অ্যান্ড বায়োইনফরমেটিকস’য়ের অধ্যাপক কেইথ ক্র্যান্ডাল বলেন, “শিশুকালে দাদী-নানীরা আমাকে গোসলের সময় কানের পেছনে, আঙুলের মাঝে এবং নাভির অংশ ভালোমতো পরিষ্কার করা পরামর্শ দিতেন।”
এই নির্দেশাবলির ভিত্তিতেই ক্র্যান্ডাল এবং ‘জিডব্লিউ কম্পিউট্যাশনাল বায়োলজি ইন্সটিটিউট’য়ের গবেষকরা ‘গ্র্যান্ডমাদার হাইপোথিসিস’ উল্লেখ করেন।
এখানে বলা হয় যে, লোকেরা সাধাণত শরীরের তিনটি অংশ সঠিকভাবে পরিষ্কার করেন না; সেগুলো হল- হাত, পা ও নাভি।
যে কারণে এসব জায়গায় বিভিন্ন রকমের ব্যাক্টেরিয়া জন্ম নেয়, ফলে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১২৯ জন স্নাতক ও কম বয়সি ছাত্রদের থেকে সংগ্রহ করা তথ্যে দেখা যায়, নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় এমন স্থান যেমন- বাহুর সামনের অংশ ও গোড়ালিতে যেসব মাইক্রোবায়োম পাওয়া যায় তা সচরাচর পরিষ্কার করা হয় না এমন স্থান যেমন- কানের পেছনের অংশ, আঙ্গুলের মাঝের অংশ এবং নাভিতে থাকা মাইক্রোবায়োমের তুলনায় অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যকর।
‘ফ্রনিটিয়ার্স ইন মাইক্রোবায়োলজি’ জার্নালের সেপ্টেম্বরের পাতায় প্রকাশিত গবেষণায় ক্র্যান্ডাল এবং তার সহকর্মীরা ব্যাখ্যা করেন যে, “ত্বকের আর্দ্র ও তৈলাক্ত অঞ্চল- যেগুলো সাধারণত খুব বেশি পরিষ্কার করা হয় না সেখানে নির্দিষ্ট কিছু অবাঞ্ছিত মাইক্রোবায়োম জন্মে। যা সামগ্রিক মাইক্রোবায়োমকে প্রভাবিত করে। ফলে ত্বকে নানান সমস্যা যেমন- একজিমা ও ব্রণ দেখা দেয়।”
গবেষণা লেখক বলেন, “এখানে যেহেতু ক্ষুদ্র পরিসরে এবং সীমিত অংশের ত্বকে ভিত্তিতে গবেষণা করা হয়েছে তাই এর প্রকৃত চিত্র জানতে, কীভাবে তা পরিষ্কার করতে হবে এবং এর ফলে অন্যান্য স্থান কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে তা জানতে আরও বিষদ গবেষণার প্রয়োজন আছে।”
মিয়ামি ভিত্তিক পারিবারিক মেডিসিন চিকিৎসক লরা পার্ডে গবেষণার ওপর ভিত্তি করে রিয়েলসিম্পল ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “এই গবেষণায় ‘পৌঁছানো কঠিন’ এবং ‘সহজেই ভুলে যায়’ এমন স্থান যেমন- কানের পেছনের অংশ, আঙ্গুলের মাঝের অংশ এবং পেটের নিচের নাভির অংশ পরিষ্কার করার প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “ধোয়ার মাধ্যমে দেহের সারা দিনের ময়লা, দুর্গন্ধ ও এলার্জেন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আর সাথে ত্বকের মৃতকোষ, ঘাম এবং প্রাকৃতিক তেল দূর হয়।”
“এছাড়াও ত্বকে থাকা ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস এবং ফাঙ্গাসও দূর হয় যা শরীর ও ত্বক পরিষ্কার রাখার জন্য জরুরি।”
তাই গোসলের সময় এই তিন বঞ্চিত স্থানের প্রতি নজর দেওয়া এবং কীভাবে পরিষ্কার করতে হবে সে বিষয়ে সঠিক ধারণা রাখা প্রয়োজন।
কানের পেছনের অংশ
“দেহের ভাঁজ যুক্ত স্থানে প্রাকৃতিকভাবেই তেল ও মৃতকোষ জমাট বাঁধে। এছাড়াও বাইরের ময়লা ধুলাবালি ইত্যাদি জমা বেঁধে ত্বকে অস্বস্তি সৃষ্টি করে”- বলে জানায় দুবার বোর্ড নিবন্ধিত ত্বক বিশেষজ্ঞ এবং মিশৌরির কোটেলভিল ভিত্তিক মাইক্রোগ্রাফিক ডার্মাটোলজিক্যাল সার্জেন্ট স্ট্যাসি টুল।
তিনি বলেন, “এর ফলে ত্বকে প্রদাহ ও জটিলতা দেখা দিতে পারে যা ‘সেবোরোইক ডার্মাটাইটিস’ নামে পরিচিত।”
“সেবোরোহিক ডার্মাটাইটিসের ফলে সাদা বা হলুদ রংয়ের দানাদার অংশ মাথার ত্বক ও কানের কাছে দেখা দেয়” বলেন ডা. পার্ডি।
এসব জায়গায় তখন চুলকানো এবং চামড়া ওঠার মাধ্যমে সমস্যার সূচনা দেখা দেয়।
ডা. টুল আরও যোগ করেন, “যে কোনো প্রদাহজনক অবস্থা ত্বকের প্রাকৃতিক সুরক্ষার স্তরকে ভেঙে দেয়। ফলে ব্যাক্টেরিয়া দেহে প্রবেশ করে সংক্রমণ সৃষ্টি করে।”
ডা. পার্ডি বলেন, “একইভাবে যদি কানের পেছনে পরিষ্কার করার না হয় তাহলে এই স্থানও সংবেদনশীল বা জ্বলুনির সৃষ্টি হতে পারে যা পরবর্তীতে একজিমাতে রূপ নেয়।”
কানে দুল পরার ছিদ্র থাকলে তার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। অন্যথায় এসকল স্থানে সংক্রমণ ও দুর্গন্ধ দেখা দিতে পারে। কানে থাকা ঘামগ্রন্থি ঘাম নিঃসরণ করে যা ব্যাক্টেরিয়ার সংস্পর্শে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে।
ডা. পার্ডি বলেন, “কানের পেছনের অংশ পরিষ্কার করতে যে কোনো সাবান বা পাতলা কাপড় ব্যবহার করা যায়। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে হাতে সাবান নিয়ে কানের পেছনের অংশ ঘষে পরিষ্কার করে থাকি। এটা খুবই সাধারণ সহজ প্রক্রিয়া।”
পায়ের আঙুলের মাঝের অংশ
গোসলের সময় পা বেয়ে সাবান পানি গড়ালেও সেটা আঙ্গুলের ফাঁকগুলো প্রকাশ করতে পারে না।
কারণ এই অংশে তেল উৎপাদন ও মৃত কোষ তৈরি না হলেও নখের ফাঙ্গাস থেকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ডা. পার্ডি বলেন, “আমাদের পায়ে অনেক বেশি ঘাম হয়। কারণ আমরা জুতা পরে থাকি। ফলে ব্যাক্টেরিয়া ও ফাঙ্গাস জন্ম নেয়। অনেকের ‘অ্যাথলেট’স ফুট’ নামক সংক্রমণ দেখা দেয় যা এক ধরনের ত্বকের সংক্রমণ। এটা মূলত আঙ্গুলের মাঝের অংশে দেখা যায়। এছাড়াও পায়ে চুলকানি, চামড়া ওঠা, খসখসে ভাব ও পা ফাটার মতো সমস্যাতো হয়েই থাকে।”
ডা. টুল বলেন, “পায়ের আঙ্গুল পরিষ্কার করাও বেশ সহজ। গোসলের সময় বা প্রতি দুয়েক দিন পরপর পায়ের আঙ্গুল ঘষে পরিষ্কার করে নিতে হবে। পায়ের জন্য আলাদা করে ফুটবাথের সুযোগ না থাকলেও গোসলের সময় সারা শরীর ঘষার জন্য যা ব্যবহার করা হয় পায়ের আঙ্গুলের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ব্যবহার করে পরিষ্কার করা যায়।”
ডা. পার্ডি একইভাবে পরিষ্কার করার পাশাপাশি নিয়মিত মোজা পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। কারণ মোজাতে অনেক বেশি ব্যাক্টেরিয়া জন্মে। তাই পরিষ্কার রাখা জরুরি।
নাভির ভেতরে অংশ পরিস্কার রাখা
গোসলের সময় নাভির ভেতরের অংশ পরিষ্কারের কথা অনেকেই ভুলে যান। অন্ধকার, আর্দ্র এবং এই স্থান অনেক বেশি ভাঁজ যুক্ত হওয়াতে মৃত কোষ, ঘাম ও অন্যান্য অনুজীব যেমন- ব্যাক্টেরিয়া ও ফাঙ্গাস জন্মানোর আদর্শ স্থান, বলে জানান ডা. পার্ডি।
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এস্থানে কেবল দুর্গন্ধ সৃষ্টি নয় বরং নানান রকম সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে যেমন- ‘স্ট্যাফ’ ও ইস্ট সংক্রমণ।
এই স্থানে মারাত্মক অস্বস্তি, প্রদাহ, লালচেভাব, চুলকানি এমন-কি ক্ষত দেখা দিতে পারে যা হলুদেটে শক্ত চামড়ার মতো দেখা যায়।
প্রতিদিন বা দুয়েকদিন পরপর নাভি পরিষ্কার করা যথেষ্ট।
ডা. টুলের পরামর্শ হল, “এসব স্থান পরিষ্কার করার জন্য বিশেষ কোনো সাবানের প্রয়োজন নেই। যদি ত্বক সংবেদনশীল হয় বা একজিমার সমস্যা দেখা দেয় অথবা গয়না পরার জন্য ছিদ্র করা থাকে- সেক্ষেত্রে সাবান বা বডি ওয়াশ ত্বকের ধরন অনুযায়ী বাছাই করতে হয়। না হলে সাধারণ পরিষ্কারক দিয়েই পরিষ্কার করা যাবে।”
হাতের আঙ্গুলে সাবান মেখে আলতোভাবে নাভির ভেতরের ও বাইয়ের অংশ পরিষ্কার করে নিতে হবে। চাইলে তুলার সাহায্য নিতে পারেন।
তবে ডা. টুল বলেন, “এস্থানে কোনো রকমের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে।”
পরিষ্কারের সময় খুব বেশি জোর প্রয়োগ না করার পরামর্শ দেন। এখানে ‘কিউটিপ’ অঞ্চলে আঘাতের ফলে বাড়তি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
আরও পড়ুন