'ফুলের বুকের সুবাস মরে গেছে/ তবুও তুমি কেঁদো না, কারণ জীবন মানে হাসি।'
Published : 18 Oct 2023, 12:58 PM
কামাল নাসের (১৯২৪-১৯৭৩) ছিলেন ফিলিস্তিনি কবি, লেখক ও নেতা। তার কবিতায় ফিলিস্তিনিদের আশা ও বেদনার কথা পাওয়া যায়।
তিনি ১৯২৪ সালে পশ্চিম তীরের রামাল্লার বিরজাই শহরে জন্ম নেন। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুত থেকে কলা ও বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি পান এবং ১৯৪৫ সালে ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন। তিনি জেরুজালেমের জিয়ান স্কুলে আরবি সাহিত্য ও ইনস্টিটিউট অব ল’তে আইনশাস্ত্র পড়াতেন। পরে ১৯৪৭ সালে রামাল্লার আল-আহলিয়া কলেজে আরবি সাহিত্যের শিক্ষক হন।
কামাল নাসের ১৯৫২ সালে আরব সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের এক বিশেষ বাহিনীর অভিযানে মারা যান এ কবি।
স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি তার ব্যাকুলতা ধরা দিয়েছে এই দুটো কবিতায়-
আমি তোমাদের একটি গল্প বলবো...
আমাদের স্বপ্নে বেঁচে থাকার গল্প
তাঁবুর ভেতর থেকে আসা একটি গল্প
ক্ষুধার যন্ত্রণায় অনুপ্রাণিত ও অন্ধকার রাতের আতঙ্কে অলঙ্কৃত গল্প।
এটা আমার দেশের গল্প, মুষ্টিমেয় শরণার্থীর গল্প
তাদের বিশজনের জন্য মাত্র এক পাউন্ড ময়দা বরাদ্দ
আর আছে একটুখানি ত্রাণের প্রতিশ্রুতি... উপহার ও পার্সেল।
এই গল্পটি দুর্দশাগ্রস্তদের
যারা দশ বছর ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল,
ক্ষুধায়
কান্না ও বেদনায়
কষ্ট ও কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়।
এটি এমন মানুষের গল্প যারা বিভ্রান্ত হয়েছিল
যাদের বছরের পর বছর ভুল বুঝিয়ে রাখা হয়েছিল।
তবুও তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে
তারা বিচ্ছিন্ন কিন্তু ঐক্যবদ্ধ
তারপর আলো থেকে যখন তাঁবুর দিকে অগ্রসর হয়-
প্রত্যাবর্তনের সেই বিপ্লব
তাদের জায়গা করে দিলো তাঁবুর অন্ধকারে।
তাকে বলো, আমি একদিন ফিরে আসব স্বাধীন ভূমির পতাকার কাপড় হয়ে।কবি কামাল নাসের
প্রিয়, যদি আমার মৃত্যুর খবর তোমার কাছে পৌঁছায়
জানি তুমি একা হয়ে যাবে
তবুও আমার একমাত্র সন্তানকে ভালোবেসো,
সে আমার ফেরার অপেক্ষায় আছে
আমার জন্য তার চোখে অশ্রু ঝরতে দিও না
জানোইতো আমার প্রিয় মাতৃভূমিতে
জীবন ক্ষত-বিক্ষত, এখানে জীবন মানে মৃত্যু
আমার চোখে সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে।
প্রিয়, যদি আমার মৃত্যুর খবর তোমার কাছে পৌঁছায়
আর প্রিয়জনরা যদি চিৎকার করে বলে
বিশ্বস্ত মানুষটি চলে গেছে, চিরতরে হারিয়ে গেছে,
ফুলের বুকের সুবাস মরে গেছে
তবুও তুমি কেঁদো না... কারণ জীবন মানে হাসি,
আমার একমাত্র সন্তানকে বলো
তোমার বাবার সত্তা এই ভূমিতে মিশে আছে
মানুষ এই মাটি ছুঁয়ে তার আদর্শকে স্পর্শ করে
তার চিন্তা পথ দেখিয়েছে,
কারণ তিনি নিপীড়িত মানুষের কষ্ট দেখেছেন
সেই পথে বিদ্রোহে করেছেন, শহীদ হয়েছেন
কিন্তু নিজের সত্তাকে বিসর্জন দেননি,
এমনকি নিজের প্রার্থনা পরিবর্তন করেছেন
তার সংগ্রাম রক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে
তার সাহস ভাগ্যকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে।
যদি আমার মৃত্যুর খবর পৌঁছায়
আর আমার বন্ধুরা তোমার কাছে আসে
তাদের চোখে যদি ভয় মিশে থাকে
দয়া করে তাদের সামনে হাসবে
কারণ আমার মৃত্যু সবার জন্য জীবন বয়ে আনবে।
আমার কবর হবে নিপীড়িতদের স্বপ্ন
যে স্বপ্নের জন্য আমি প্রার্থনা করি, বেঁচে থাকি।
আমার মৃত্যুতে তাদের স্বপ্ন আবার সৃষ্টি হবে
আমি সেই সৃষ্টির উচ্ছ্বাসে আন্দোলিত
পরের দিন, এই ভূমির পবিত্র মাটিতে
আমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিও
আমার সংগ্রামী আত্মা ও শরীর ঢেকে দিও
বন্ধুদের হৃদয়ে আমি অমর
আমি তাদের স্বপ্ন ও স্মৃতিতে বেঁচে থাকব।
প্রিয়, যদি তোমার কাছে মৃত্যুর কথা পৌঁছায়
আর তোমার যদি ভয় করে
যদি কাঁপতে শুরু করো, মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়
তাহলে যেন চাঁদের মতো ফ্যাকাসে হয়
যেন চাঁদ তোমার দিকে তাকাতে না পারে
তোমার মুখ যেন হয় সৌন্দর্যের বাগান
কারণ আমি চাঁদের আলোকে হিংসা করি।
আমার একমাত্র সন্তানকে বলো
আমি তাকে খুব ভালোবাসি
এই জীবন দান করার চেয়েও ভালোবাসি
সে যেন আমার ত্যাগের আনন্দকে উপভোগ করে।
তার জন্য কিছুই অবশিষ্ট নেই
সে যেন এসব নিয়ে দীর্ঘশ্বাস না ফেলে...
বরং যা আছে সেগুলো আঁকড়ে ধরে।
আমার প্রিয় সন্তানকে বলো
যদি সে কখনো আমার কবর জিয়ারত করে
যেন আমার স্মৃতিকে আঁকড়ে রাখে,
তাকে বলো, আমি একদিন ফিরে আসব
স্বাধীন ভূমির পতাকার কাপড় হয়ে।