৪৬৩ বছর আগে এ মসজিদ নির্মাণ করেন মোগল বাদশাহ আকবরের ধাত্রী মাহাম আঙ্গা।
Published : 03 Apr 2024, 01:38 AM
‘এই মসজিদে জিন আছে।’ শুনে আমি এমন ভাব দেখালাম যে ভীষণ অবাক হয়েছি আর একটু ভয়ও পেয়েছি। ছোটবেলা থেকেই আমার এক ফোঁটাও ভয়ডর নেই। মাঝরাতে ছাদে চলে যেতাম ছোটবেলায় একা একা, দেখার জন্য কী আছে অন্ধকারে!
আর এখানে দিল্লির এই মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেব আমাকে জিনের কথা বলছেন। বিশেষ সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। আমি একটুও ভয় পাচ্ছি না, উল্টো মজা লাগছে। আশপাশে কেউ নেই। বাদশাহ আকবরের আমলের এই মসজিদ পাহারা দিচ্ছেন এক নারী। নীল রঙের শাড়ি পরে বেশ আরামসে চেয়ারে হেলান দিয়ে, পায়ের উপর পা তুলে সদর দরজার কাছে বসে আছেন। সাকুল্যে এই মাঝারি আকারের মসজিদে আছি আমরা তিনজন। এর মাঝে কতজন জিন ঘোরাঘুরি করছেন আমার জানা নেই।
ছোটবেলায় নানির কাছে জিনের গল্প শুনতাম। ভালো জিন যেমন আছে, তেমনি আছে খারাপ জিন। ভালো জিন মানুষের ক্ষতি করে না, অবশ্য মাঝে মাঝে নাকি মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে খেয়ে ফেলে। তখন মনে হত জিনেদের প্রধান খাদ্য হল মিষ্টি। জিনেরা নাকি দুষ্ট লোক বুঝে চড়-থাপ্পড়ও মারত। কী মজার কথা! যে লোকটা অসাধু উপায়ে বেশি দামে জিনিস বিক্রি করছে, খাবারে ভেজাল দিচ্ছে, ঘুষ নিচ্ছে বা দুর্নীতি করছে তার গালে যদি অশরীরী কারো কাছ থেকে কয়েকটা চড় পড়ে তাহলে কেমন মজাই না হবে! সে আর কোনোদিন দেশের বা কারো ক্ষতি করবে না।
কিন্তু আমার ধারণা, এরকম জিন শুধু ব্রিটিশ আমলেই দেখা যেত, মানে আমার নানির কৈশোর বেলায়। এখন বোধহয় জিনেরা দেখাও দেয় না, চড়ও মারে না। জিনরা নাকি চলার পথে আতর, গোলাপপানির সুবাস রেখে যেত। আমি তো ধরেই নিয়েছি যে জিনরা আমাদের মতো পথেঘাটে হেঁটে বেড়াতো না। তারা ঠিক উড়ে উড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেত। খোলা আকাশ তাদের খুব পছন্দ।
আমার কল্পনার জিনদের সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই উচ্চ পর্যায়ের। যেহেতু অনেক চেষ্টা করেও এখন অবধি কোনো জিনের দেখা পাইনি, তাই মুয়াজ্জিন সাহেবের কথা শুনে যদি তেনাদের দেখা পাওয়া যায় তাহলে তো কপাল খুলেই গেল।
মুয়াজ্জিন সাহেবের নাম তাবরিজ। বেশ কয়েক বছর ধরে এই মসজিদে দায়িত্বে আছেন। তিনি যখন জিনদের গল্প বলা শুরু করলেন তখন আমি ‘খায়রুল মঞ্জিল’ নামের এই মসজিদটির ভেতরের মূল কক্ষ মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলাম। পাথর আর সিমেন্টের আস্তরণে নির্মিত এই মসজিদের তেমন যত্ন হয় বলে মনে হয় না। কিছু কিছু জায়গার স্যান্ড স্টোন বা বেলে পাথরের উপর খোদাই করা ছিল। সেগুলোও বিলুপ্ত প্রায়, দেখাই যাচ্ছে না।
দিল্লির পুরনো কেল্লার সামনে দিয়ে যতবারই গিয়েছি, সবসময়ই চোখ পড়েছে এর উল্টো দিকের মসজিদের দিকে। এটিই তাবরিজ সাহেবের দাবি করা ‘জিনের মসজিদ’। ১৫৬১ সালে বাদশাহ আকবরের ধাত্রী মাহাম আঙ্গা এই মসজিদটি নির্মাণ করেন, আর নাম দেন ‘খায়রুল মঞ্জিল’। মানে সমস্ত ঘরের মাঝে শ্রেষ্ঠ। মাহাম আঙ্গা নিজেও সে আমলে খুব প্রভাবশালী নারী ছিলেন। বাদশাহ আকবর তার কথার মান্য করতেন। তবে মাহাম আঙ্গার পুত্রের আখের গোছানোর জন্য তার নেওয়া বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে বাদশাহ নাখোশ হন তার উপর। মসজিদটি নির্মাণের পরই তার ইন্তেকাল হয়। তাকে সমাহিত করা হয় দিল্লিতেই, এই মসজিদের অদূরে, কুতুব মিনার প্রাঙ্গণে।
বড় বড় পাথরে নির্মিত প্রাচীরঘেরা এই মসজিদের বিশাল সদর দরজা কাঠের তৈরি। দরজা খোলাই ছিল। ভেতরের প্রাঙ্গণ মাঝারি আকারের। উঠোনের মাঝখানে একটি পানির কুয়া। তবে দেখে মনে হচ্ছে পানির অফুরন্ত উৎস এক বিশাল পুকুর। পানি তোলা আছে বালতিতে আর ফুলগাছে পানি দেওয়ার মতো নলওয়ালা পাত্রে। পানি তোলার জন্য দড়ি আর বালতি ব্যবহার করা হয়, আগেকার দিনে যেমন হত।
সদর দরজার উপরের তোরণে স্যান্ডস্টোনের উপর আরবিতে ক্যালিগ্রাফি খোদাই করা। প্রায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মোগল আর্ট সুস্পষ্টভাবে খোদাই করা মূল মসজিদের একমাত্র গম্বুজ ও তিন মূল মিহরাব আকারের প্রবেশদ্বারে। মসজিদের দু'পাশে সদর দরজা অবধি সারি সারি কক্ষ, যেগুলো একসময় মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহৃত হত। এখন দোতলা সেসব কক্ষের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। পলেস্তারা খসে বড় বড় পাথরের গাঁথনি দেখা যাচ্ছে।
মাঝারি আকারের মসজিদের মেঝেতে একটা শতরঞ্জি বিছানো। সেখানে আমি এখন তাবরিজ সাহেবের মুখোমুখি বসে আছি। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবির উপর দিল্লির এই এপ্রিল মাসের গরমে তিনি একটা কালো কটি চাপিয়ে বসে আছেন। আধ কাঁচা-পাকা দাড়ি আর অসম্ভব ভালো মানুষের মতো নূরানী চেহারা। আমার সামনে মসজিদের মূল মিহরাব। একসময় নানা রঙের মোজাইক ও টাইলসের কাজ করা ছিল মিহরাবজুড়ে। এখন বেশিরভাগ খসে পড়েছে। উপরের দিকের খানিক সবুজ, নীল টাইলসের জ্যামিতিক নকশা আর খোদাই করা ক্যালিগ্রাফির আরবি আয়াত লালচে দেয়াল আলো করে জানান দিচ্ছে।
মিহরাবের সামনে ইমাম সাহেবের জায়নামাজ বিছানো। মিহরাবের দুপাশে ছোট দুটি কুলুঙ্গিতে গিলাফে মোড়া কয়েকটি কোরআন শরীফ রাখা। আজকাল তো কোরআন শরীফে গিলাফ (কাপড়ের কভার, অনেকটা বালিশের কভারের মত) দেখাই যায় না। এছাড়া এই মসজিদের আর কোনো অলংকরণ নেই। ভেতরের সিলিং-এ গম্বুজের অংশে এবং ছাদজুড়ে একসময় হয়তোবা খোদাই করা নকশা ছিল, কিন্তু এখন এসবের কিছুই নজরে আসছে না, সব মুছে গিয়েছে। ভেতরের দেয়ালের অনেক জায়গার পলেস্তারা খসে যাচ্ছে। রঙ করা হয়নি দেয়াল বহুবছর। মেঝের চুনসুরকি তো প্রায়ই দেখা যাচ্ছে।
পশ্চিম দিক ছাড়া অন্যসব দিকেই দরজা আছে ঢোকা এবং বের হওয়ার জন্য। আলো-হাওয়াও বেশ খেলে যাচ্ছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, এই একুশ শতকে এসেও এই মসজিদে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। উত্তর দক্ষিণ এবং পশ্চিমের দেয়ালের কুলুঙ্গিতে কয়েকটি হারিকেন রাখা। যে মসজিদে বিদ্যুৎ নেই সেখানে জিনেরা তো আসবেই!
তাবরিজ সাহেব বলেই চলছেন, ‘আসরের নামাজের পর এখানে মানুষজন প্রায় আসে না বললেই চলে। তখন জিনেরা নামাজ পড়তে আসে। মাগরিব আর এশার জামাত জিনেদের দখলেই থাকে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি জিন দেখেছেন?’
‘আলবত দেখেছি। মাগরিবের ওয়াক্তে অন্ধকার হতে শুরু করলে তখন জিনেরা ঘোরাঘুরি করে, কথা বলে। বাইরের কুয়ার পানিতে ওজুও করে।’
‘আমি কি দেখতে পাব তাদের?’
‘সন্ধ্যার পর পুরুষ মুসল্লি ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ। তবে আসরের পর আর কোনো মুসল্লি আসে না। তখন শুধু জিনেরা থাকে।’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। আশপাশে কোনো মুসলমান বসতি নেই যে কেউ নামাজ পড়তে আসবে। যারা পুরনো কেল্লা দেখতে আসেন তারাই শুধু এখানে প্রয়োজনে নামাজ পড়েন। অন্য মুসল্লি আসবে কোথা থেকে? তবুও আমার তাবরিজ সাহেবের বিশ্বাস ভাঙতে ইচ্ছে করলো না। জিনরা যদি নীরবে নামাজ পড়ে চলে যায়, তা যাক না!
আমি জিন দেখতে না পেয়ে খানিকটা আশাহত। সেই ছোটবেলা থেকে আশা নিয়ে বসে আছি। একটা জিনের দেখা তো পাওয়া যাবে, না হলে বন্ধুবান্ধবের কাছে মুখ দেখানো যাবে না। হে জিন, আপনারা দেখা দিন।