উড়িতেছে সোনার ঘোড়া, তৃতীয় কিস্তি

একটু সামনে এগুতেই দেখলাম ঘূর্ণায়মান এক টেবিল। সেই টেবিলের উপর ছোট বড় আটটি সোনার ঘোড়া, কোনোটা অর্ধেক বানানো হয়েছে, কোনোটা কেবল চারটে পা খাড়া করা। কোনোটার পেটের মধ্য থেকে প্রচুর যন্ত্রপাতির তার আর যন্ত্রাংশ বের হয়ে আছে। উপর থেকে আলো পড়ে চিকচিক করছে বিচিত্র ঘোড়াগুলো।

মনি হায়দারমনি হায়দার
Published : 2 Sept 2022, 00:26 AM
Updated : 2 Sept 2022, 00:26 AM

গরিলা মামা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে মিচকি মিচকি হাসে। গরিলার মুখে মিচকি হাসি দেখে আমাদের রাগ আরও চরমে।

সাগরের রাগ বেশি, ও বরিশাইল্লাতো, আমাদের পেছনে ফেলে ঠেলে সামনের দিকে যায়। দাঁড়ায় গরিলার মুখোমুখি, গরিলা তখনও হাসে। সাগরের দেখাদেখি আমরাও সামনে যাই।

কী ঘটনা গরিলা মামা? বাজখাই গলা সাগরের। পেটমোটা দারোগা আর পাতলা গেলো কই? আর তুমি পিটিপিটি হাসছো কেনো? গরিলা লম্বা জিহ্বা বের করে আবার হাসে, ভেতরে অনেক খানাদানা চলতেছে। আমরা খাবো না? লোভে চকচক করছে পাতলাদার ভাগ্নে আকুল। তুমি মামাকে বলো, আমরাও খেতে চাই।

খাও, খেতে কে মানা করছে! কিন্তু ভেতরে যাওয়া নিষেধ।

কেনো ভেতরে যাওয়া নিষেধ? টিয়া ওড়না গলায় পেঁচিয়ে কোমরে হাত রেখে রুখে দাঁড়ায়, আমরা কি আমড়াকাঠের! নাকি ভাইসা আসা গামছা? আমাদের বাইরে রেখে পাতলাদা ভেতরে মেহমান নিয়ে খাচ্ছে? মজার গন্ধ নাকে আসছে!

আমাদের ভেতরে যেতে না দিলে মিছিল করবো, তাকায় আমাদের দিকে, তোরা মিছিল করবি আমার সঙ্গে?

দেয়ালের ওপর বিশাল একটা ফাঁকা জায়গা। সেই জায়গায় কয়েকটা ঘোড়া ঘুড়ি ওড়াচ্ছে আর বাদাম খাচ্ছে। ঘোড়াদের ঘিরে কয়েকটা মুরগি কুটকুট ঘাস চিবুচ্ছে।

আমরা হাত তুলি, অবশ্যই মিছিল করবো। টিয়া সঙ্গে সঙ্গে দুই হাতে ধাক্কা দেয় গরিলা মামাকে। গরিলা মামা দুই হাতে গেটের দরজা আলতো ধরে দাঁড়িয়েছিল, হঠাৎ ধাক্কায় দরজা ছেড়ে গরিলা মামা চিৎপটাং। খোলা দরজা পেয়ে আমরা ভেতেরে ঢুকে অবাক, কোথায় কি! কিচ্ছু নেই, সব চিচিং ফাঁক। দেয়ালের ওপর বিশাল একটা ফাঁকা জায়গা। সেই জায়গায় কয়েকটা ঘোড়া ঘুড়ি ওড়াচ্ছে আর বাদাম খাচ্ছে। ঘোড়াদের ঘিরে কয়েকটা মুরগি কুটকুট ঘাস চিবুচ্ছে। ঘোড়া ও মুরগির পর আরেকটা দেয়াল দেখা যাচ্ছে। দেয়ালের গায়ে হরেক রঙের ছবি আঁকা। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, ছবিগুলো আমাদের।

আমরা একে অপরের দিকে তাকাই, প্রশ্ন একটাই- এই অচিনপুরে আমাদের এমন বাজখাই সুন্দর রঙিন ছবি কে আঁকলো? কিন্তু কেউ কোনো শব্দ উচ্চারণ করার আগেই শুনতে পেলাম গরিলা মামার গলা, এসব তোমাগো ছবি পাতলা সাহেব আঁকছেন।

পেছনে তাকাতেই দেখি গরিলা মামা, শরীরের ময়লা মুছতে মুছতে আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে মিচকি মিচকি হাসছে। অবাক ঘটনা, বইতে পড়েছি, টিভি চ্যানেলে ও চিড়িয়াখানায় দেখেছি, মাথায় বাজ পড়ার যোগাড়- পাতলাদা আবার ছবি আঁকা শিখলো কবে? না, এই মহাপ্রতিভাধর লোকটাকে জুরাইনের মতো ওয়ার্ড এলাকার ছোট জায়গায় আটকে রাখা ঠিক না।

কতোবার পাতলাদাকে বলেছি আমরা, পাতলাদা, তোমাকে জুরাইনের এতো পচা গলিতে মানায় না। আনমনে বাদামের খোসা চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করে, মানে?

দেশে-বিদেশে তোমার যে বিস্ময়কর খ্যাতি, মাঝে মধ্যে নানা দেশের রাষ্ট্রদূত হাই-কমিশনাররা তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এই জুরাইনে আসে, টিভি চ্যানেলে তোমার তামাম খবর প্রচার হয়, তোমাকে কি এখানে মানায়? একটানা বলে থামে ঈগল।

তোরা আমাকে কী করতে বলিস?

তুমি ধানমণ্ডি-গুলশান বা উত্তরা চলে যাও। সরকার তো তোমাকে বাড়ি-গাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, শুধু তুমি একবার বললেই হয়।

তাই নাকি? শ্লেষ পাতলাদার গলায়।

আমরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি, পাতলাদার সঙ্গে সেই যে কবে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল, তার সাগরেদ কীভাবে হয়েছি, আজ আর মনে পড়ছে না। আমরাও পাতলাদার জন্য নিঃশব্দে কাঁদতে থাকি বাসার ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

ঘাবড়ে যায় তিতলি, তাইতো পাতলাদা! কতোবার সরকার তোমাকে প্রস্তাব দিয়েছে জুরাইন থেকে চলে যাবার জন্য। তুমিইতো যাও না, পড়ে আছো নোংরা কাঁদার এদো গলিতে।

কেনো পড়ে আছি?

তুমি জানো, কেনো পড়ে আছো?

যদি বলি আমি পড়ে আছি তোদের জন্য।

মানে? আমি ভোম্বল, বুঝি কম সমসময়ে, ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলি, নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না, প্রশ্নটা করেই ফেললাম। তুমি কী বলতে চাও?

পাতলাদা হাতলভাঙ্গা বিখ্যাত চেয়ারে বসে আনমনে পা নাড়াতে নাড়াতে বলে, জুরাইন তোদের কাছে এদো কাদা ময়লার এলাকা? নোংরা মশা মাছি ওড়ে, কানের কাছে ভ্যানভ্যান করে, তাই না? গলিটাও ছোট, একটা গাড়ি ঢুকলো আর একটা গাড়ির চলতে সমস্যা। কিন্তু আমিতো এখানেই জন্মেছি, এই এদো গলিতে বড় হয়েছি, এই এদো গলির নোংরা ময়লা পচা পানির গন্ধ তো আমি টাকাঅলাদের এলাকায় গেলে পাবো না। পাবো?

আমরা হতবাক, বলে কী লোকটা? কোনো উত্তর দিতে পারি না।

জানি পাবো না। না পেলে আমিতো ওখানে থাকতে পারবো না। এটা আমার জন্মস্থান, যতো নোংরা আর গন্ধময় হোক আমি জুরাইন ছেড়ে কোথাও যাবো না, সেটা যদি স্বর্গও হয়।

পাতলাদা! অস্ফুট শব্দ করে টিয়া।

আজ আমি যে পাতলাদা হয়েছি, দেশে-বিদেশে অনেকে আমাকে একটু আধটুকু চেনে- জুরাইনের আলো হাওয়ায় থেকেইতো আমার সেই পরিচিতি, নাকি?

জি, আমরা ঘাড় নাড়ি।

সেই জুরাইন ছেড়ে আমি কোথায় যাবো?

আমরা ভেবেছি- হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয় পাতলাদা আমাদের ঈগলকে- তোরা কী ভেবেছিলি সেটা আমি জানি, কিন্তু আমি প্রশ্ন করি তোদের, আমি চলে গেলে তোরা খুশি হবি?

আমরা একেবারে বোবা হয়ে যাই। পাতলাদা আমাদের সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা মারমার কাটকাট হাঁকডাক চর-চাপ্পরে থাকে। যখন তখন খরজি মার্কা লম্বা হাতের বিরাশি শিক্কা খাইয়ে মাথার তালু উঁচু করে রাখে, কথাতো বলে বাজখাই গলায়, যেন বজ্রপাত! সেই পাতলাদা আমাদের...

আমি জানি, আমি চলে গেলে তোরা জুরাইনে থাকতে পারবি না। আর আমার পক্ষে তোদের ছেড়ে থাকাও কখনও সম্ভব না। সুতরাং....। পাতলাদা বিখ্যাত হাতলভাঙ্গা চেয়ার ছেড়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। আমরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি, পাতলাদার সঙ্গে সেই যে কবে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল, তার সাগরেদ কীভাবে হয়েছি, আজ আর মনে পড়ছে না। আমরাও পাতলাদার জন্য নিঃশব্দে কাঁদতে থাকি বাসার ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সেই পাতলাদা আমাদের না জানিয়ে, গোপনে শ্যামপুর থানার পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ মিয়া আর চিকন এসআই মাখন মিয়াকে নিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো? পাতলাদা এটা পারে না।

মনে হলো মাটি ফুঁড়ে বিরাট একটা লিফট এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনে। লিফটের দরজা খুলে যায়, ভেতরে দাঁড়িয়ে পাতলাদা। মুখে মিটিমিটি হাসি, যা খুব দুর্লভ। হাত ইশারায় আমাদের ডাকে পাতলাদা। আমরা হুড়মুড় করে সেই লিফটে উঠি, লিফট চলতে শুরু করে, মাটির নিচে, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।

কিন্তু কোথাও দেখতেও পাচ্ছি না পাতলাদাসহ দারোগাকে! কী করবো? মাথার চুল ছিঁড়বো না পায়ের জুতো ছিঁড়বো? আমাদের ভাবনার মধ্যে হঠাৎ ছবির দেয়াল অনেকটা ম্যাজিকের সূত্রে খুলে যায়। মনে হলো মাটি ফুঁড়ে বিরাট একটা লিফট এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনে। লিফটের দরজা খুলে যায়, ভেতরে দাঁড়িয়ে পাতলাদা। মুখে মিটিমিটি হাসি, যা খুব দুর্লভ। হাত ইশারায় আমাদের ডাকে পাতলাদা। আমরা হুড়মুড় করে সেই লিফটে উঠি, লিফট চলতে শুরু করে, মাটির নিচে, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।

প্রায় সাড়ে আট মিনিট লিফট চলার পর থামে। দরজা খুলে যায়, আমরা নামি। নেমেই অবাক, বিশাল একটা কারখানা। কী নেই কারখানায়? কতো ধরনের যে যন্ত্র দেয়ালে, আলমারিতে ঝুলছে, গুণে সব শেষ করা যাবে না। একটু সামনে এগুতেই দেখলাম ঘূর্ণায়মান এক টেবিল। সেই টেবিলের উপর ছোট বড় আটটি সোনার ঘোড়া, কোনোটা অর্ধেক বানানো হয়েছে, কোনোটা কেবল চারটে পা খাড়া করা। কোনোটার পেটের মধ্য থেকে প্রচুর যন্ত্রপাতির তার আর যন্ত্রাংশ বের হয়ে আছে। উপর থেকে আলো পড়ে চিকচিক করছে বিচিত্র ঘোড়াগুলো।

আর সেই ঘোড়াগুলোর সামনে শ্যামপুর থানার দারোগা পেটমোটা সর্বনাশ আলী আর এসআই চিকন মাখন মিয়া মুখ হা করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাতলাদার অবাক রাজ্যের অবাক কাণ্ডকারখানা দেখতে থাকি।

তাইলে এই আপনার ঘোড়া কারখানা? প্রশ্ন করে দারোগা পেটমোটা।

জি, আপনার তো অনেক সন্দেহ, বিশ্বাসই করতে চাইলেন না আমি সোনার ঘোড়া বানিয়েছি! এখন নিজের চোখে দেখুন, বাংলাদেশের মানুষ কী বানাতে পারে আর পারে না?

আপনার এই সোনার ঘোড়া বানানোর লাইসেন্স আছে? পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ আলীর ঘাড়ের উপর থেকে চিকন এসআই মাখন মিয়া প্রশ্ন করে।

হাসে পাতলাদা, আপনার বস পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ আলীকে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলেছে, শোনেন নাই?

রেগে তাকায় পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ আলী, তুমি চুপ থাকো বেয়াদব!

লম্বা মুখটা গোলআলুর সাইজে গোল করে দাঁড়িয়ে থাকে মাখন মিয়া। আমরা দেখি আর মজা কুড়াই, ভেতরে ভেতরে রেগেও আছি পাতলাদার উপর, বিস্ময়কর ঘোড়া তৈরির কারখানা বানিয়েছে জুরাইনে গোপনে, মাটির নিচে! আমরা জানি না কেনো? অন্যদিকে দারোগাকে আগে কেনো আনলো? কোন পথে আনলো? এই ঘোড়া কারখানায় কী অনেকগুলো পথ?

ভাবনার মধ্যে দেখতে পেলাম মাথার উপর থেকে বিমানের মতো বিশাল একটা টেবিল নেমে এসে আমাদের পেছনে থামলো। টেবিল বোঝাই আনারস, কাঁঠাল, কামরাঙ্গা, পেয়ারা, নাশপতি, লেবু, বরই, কোরমা-পোলাউ, বিরিয়ানি, হাঁস-গরু-মুরগির মাংশ, পিঠা আর চানাচুর... কতো ধরনের খাবার! গুণে শেষ করা যাবে না। দেখেই জিবে জল এসে ফুটবল খেলতে শুরু করে।

আসুন, সবাই খাওয়া-দাওয়া করি চলুন, পরে আমার কারখানা ঘুরিয়ে দেখাবো আপনাদের, পাতলাদা বলে। আমরা পাতলাদার আদেশ মেনে টেবিল ঘিরে চেয়ারে বসে পড়ি। কেউ কেউ মাত্র খাবারে হাত দিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে গোটা কারখানা ভয়াবহ ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে।

চলবে…

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!