উড়িতেছে সোনার ঘোড়া, প্রথম কিস্তি

জি, আমার ঘোড়াটা খাঁটি সোনায় তৈরি। অনেক খেটে, গবেষণা করে আমি নিজে আমার কারখানায় ঘোড়াটাকে বানিয়েছি।

মনি হায়দারমনি হায়দার
Published : 5 August 2022, 04:44 AM
Updated : 5 August 2022, 05:08 AM

কী! কী বললেন? আপনার ঘোড়াটা সোনার তৈরি? জি, আমার ঘোড়াটা খাঁটি সোনায় তৈরি। অনেক খেটে, গবেষণা করে আমি নিজে আমার কারখানায় ঘোড়াটাকে বানিয়েছি।

ঘোড়াটা তৈরিতে মোট সোনা লেগেছে তিন টন। সব সোনা আমি আফ্রিকার সেরা খনি থেকে সরাসরি আনিয়েছি। যন্ত্রপাতি, কাটা কম্পাস, হাতুড়ি বাটালি, স্প্রিং-এর তো শেষ নেই। ঘোড়াটা আমার ছুটতে পারে প্রতি ঘণ্টায় তিনশো কিলোমিটার। পৃথিবীর যেকোনো ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে..., বিমর্ষ পাতলাদা ডান হাতল ভাঙ্গা বিখ্যাত চেয়ারে বসে হাত পা ছড়িয়ে গভীর দুঃখের সঙ্গে বলেন।

কিন্তু আমরা বুঝতে পারছিলাম, পাতলাদার সামনে চেয়ারে বসা জুরাইন থানার দারোগা পেটমোটা সর্বনাশ মিয়া কিছুই বিশ্বাস করছে না। বরং পাতলাদার মুখে সোনার তৈরি ঘোড়া শুনেই চোখে মুখে অবিশ্বাসের ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে আছেন জানালা দিয়ে বাইরে।

দুনিয়ার সব রাজা-বাদশা-রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীদের ডেকে আমার বানানো আকাশচড়ুই দেখিয়ে অবাক করে দেবো। ওরা আকাশচড়ুই দেখে পাগল হয়ে আমাকে বলবে, আমাকে একটা দিন। অমুক দেশের বাদশা বলবে আমাকে দশটা বানিয়ে দিন, এই নিন নগদ তিন লাখ টাকা। ভেবে দেখেছেন!

স্যার? থানার দারোগা সর্বনাশ মিয়ার সঙ্গে আসা এস আই মাখন মিয়া কাছে এগিয়ে যায়। বলো, কী বলবে? গোঁফহীন গোঁফে তা দিয়ে ফিরে তাকান দারোগা সর্বনাশ মিয়া। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন মাখন মিয়া, স্যার আপনে জিজ্ঞাসা করেন, মিস্টার মোটেরাজ পাতলা খান সোনার ঘোড়া কোথায় বানালো?

দারোগা সর্বনাশ মিয়া মোটা ঘাড় নাড়িয়ে হেলেদুলে আবার তাকান বিমর্ষ পাতলাদার দিকে, আপনার সোনার ঘোড়া কোথায় পাওয়া গেলো?

পাওয়া গেলো মানে? বারবার বলছি আপনাদের, সোনার ঘোড়া আমি আমার কারখানায় তৈরি করেছি। নিজের হাতে। জানেন কতো সময় লেগেছে? সাড়ে তিন বছর। সেই ঘোড়া বানানোর সাড়ে তিন বছরে আমি গোসল করিনি, কোথাও যাইনি, কেবল সোনার ঘোড়াটাকে বানিয়েছি।

কারখানায় ঘোড়া বানিয়েছেন? জুরাইন থানার দারোগা সর্বনাশ মিয়া নড়েচড়ে বসে সাড়ে তিনটা কাশি দেন, কারখানায় ঘোড়া বানানো যায়? ঘোড়া তো ঘোড়ার পেটে জন্ম নেয়, যেভাবে নেয় মানুষ, অন্যান্য প্রাণী। অথচ আপনি বলছেন...।

আসলে আপনারা জানেন না, দুনিয়া বিজ্ঞানে কতো এগিয়েছে, কতো ধরনের কাজ করেছে বিজ্ঞান মানব কল্যাণে? মানুষের ক্লোন তৈরিতো সেদিনের ঘটনা। গত একশো বছরে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা কিছুই করতে পারছে না, আমি ভাবলাম, নতুন একটা কিছু আবিষ্কার করে বিশ্ব বিজ্ঞানীদের তাক লাগিয়ে দেবো।

পাতলাদা আপন মনে জীবনের সব আবেগ দিয়ে বলে যাচ্ছেন, আমরা পাশে দাঁড়িয়ে শুনছি, মশা কামড়ে রক্ত খেলেও টুশব্দটি করছি না। অথচ জুরাইন থানার নতুন দারোগা পেটমোটা সর্বনাশ মিয়া মুখ হা করে ঘুমুচ্ছে।

তাই আপনি সোনা দিয়ে সোনার ঘোড়া বানিয়েছেন?

সামনে রাখা টেবিলের উপর চাপড় দেয় পাতলাদা, জি আমি বিজ্ঞানের প্রকৌশলে সোনার ঘোড়া বানিয়েছি। আমার বানানো ঘোড়া আকাশচড়ুই ক্ষিপ্র গতিতে আকাশে উড়তে পারে ডানা মেলে। আবার মাটিতে নেমে এলে ডানা গুটিয়ে চার পায়ে গাড়ির চেয়ে বেশি গতিতে দৌড়াতে পারে। মজার ঘটনা কী জানেন? আমি যদি ইচ্ছে করি আকাশচড়ুইকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে পারি। তখন কেবল আমাকে দেখা যায়, আমি শূন্যে উড়ছি। ব্যাপারটা ভেবে দেখেছেন? এমন রহস্যময় সোনার ঘোড়া দুনিয়ায় আর কোনো দেশে তৈরি করতে পেরেছে?

পাতলাদার দিকে হা মুখে তাকিয়ে থাকেন জুরাইন থানার পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ মিয়া। বোঝাই যাচ্ছে, পেটমোটা দারোগা সাহেব পাতলাদাকে বিশ্বাস করেননি। এই ঘোড়া নিয়ে আমার কতো স্বপ্ন, দুনিয়ার সব রাজা-বাদশা-রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীদের ডেকে আমার বানানো আকাশচড়ুই দেখিয়ে অবাক করে দেবো। ওরা আকাশচড়ুই দেখে পাগল হয়ে আমাকে বলবে, আমাকে একটা দিন। অমুক দেশের বাদশা বলবে আমাকে দশটা বানিয়ে দিন, এই নিন নগদ তিন লাখ টাকা। ভেবে দেখেছেন! আমার দেশটা কতো ডলার পাউন্ড আয় করতে পারতো? সব সাড়ে সর্বনাশ করে দিল চোর। চোরের এতো সাহস আমার কারখানায় ঢোকে!

পাতলাদা আপন মনে জীবনের সব আবেগ দিয়ে বলে যাচ্ছেন, আমরা পাশে দাঁড়িয়ে শুনছি, মশা কামড়ে রক্ত খেলেও টুশব্দটি করছি না। অথচ জুরাইন থানার নতুন দারোগা পেটমোটা সর্বনাশ মিয়া মুখ হা করে ঘুমুচ্ছে। মুখের মধ্যে মাছি আসা যাওয়া শুরু হতে পারে যে কেনো সময়ে!

জুরাইন থানার দারোগা পেটমোটা সর্বনাশ খানের নাক ডেকে ঘুমানোর ব্যাপারটা আমরা মেনে নিতে পারি না। রীতিমতো বিশ্ববিখ্যাত পাতলাদাকে অপমান? আমি টিয়ার দিকে তাকাই, লোকটাকে মজা দেখানো দরকার। আমাদের সামনে মহান পাতলাদাকে অপমান? একটু অপেক্ষা কর, টিয়া সামনে থেকে চলে যায়। রুমের মধ্যে নীরবতা। আমরা হাসফাঁস করি, পাতলাদার এতো সাধের সোনার ঘোড়া চুরি করলো কে? শুনেছি ফাঁকিস্তানের এক সিঁধেল চোর আমীর আবদুল্লাহ পিয়াজী বাংলাদেশে ঢুকেছে। নিশ্চয়ই এই কাজ বদমাশটাই করেছে। মুশকিল হলো, এই দেশের কিছু মোনাফেক চোরও সিঁধেল চোর পিয়াজীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। সবই শোনা, কোনো প্রমাণ নেই।

কী হলো! কী হলো! চিৎকারে সামনে হা মুখে নাক টেনে ঘুমানো পেটমোটা দারোগা সর্বনাশ মিয়া লাফিয়ে উঠে, পাতলাদার হাতভাঙ্গা চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে দাঁড়িয়ে যান। দাঁড়িয়ে একই সঙ্গে হাচ্ছো দিচ্ছেন আর কাশছেন। পাতলাদাও ঘটনার কিছু বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে যান ভ্যাবলাকান্তের ঢংয়ে, কী হলোরে? টিয়া আমাদের সামনে আসে, কিছু না পাতলাদা। আমার মনে হয় দারোগা সাহেবের মাথায় বৃষ্টির পানি পড়েছে।

আমি সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত দিই মোবাইলের জন্য। কিন্তু পকেটে মোবাইল নেই। হাত দিই প্যান্টের পেছনের পকেটে। মাঝে মধ্যে প্যান্টের পেছনের পকেটেও মোবাইল রাখি, নেই।

মাথার ভেজা চুল নাড়াতে নাড়াতে বলেন দারোগা, আপনার বাসায় বৃষ্টির পানি পড়ে?

পাতলাদা দাঁত কড়মড় করে বলে, মাঝে মাঝে। টিয়ার সঙ্গে আমরা মুচকি হাসছি। পানিটা মাচায় উঠে দারোগার মাথায় ফেলেছে টিয়া। সঙ্গে সঙ্গে ফল দিয়েছে, বেচারার ঘুমাতে চলেই গেছে, কাশছেও। মনে হয়, ঠান্ডাও লেগেছে। হাচ্ছো দিতে দিতে জুরাইন থানার দারোগা পেটমোটা সর্বনাশ মিয়া চেয়ারে বসে তাকান পাতলাদার দিকে, কী যেন বলছিলেন আপনি?

পাতলাদাও বিখ্যাত হাতভাঙ্গা চেয়ারে বসে সরাসরি তাকায় দারোগার দিকে, ঘাড় নাড়েন, আমি আমার কারখানায় বানিয়েছি। আপনি বিশ্বাস করছেন না? এই ভোমলা? ভোমলা? আমরা পাশেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি পাতলাদার ডাকের জন্য। আর দেখো আমাকে ডাকছে ভোমলা, মানে বিকৃত শব্দে। কতোবার পাতলাদাকে বলেছি, আমার নাম মিস্টার ভোম্বল খান বাহাদুর। কিন্তু যতোবারই পাতলাদা ডাকেন আমাকে, ওই ভোমলা! আবার বিকৃত নাম ডাকলে খুব খুশি সাগর, টিয়া, আকুল আর ব্যাকুল। কারণ ওরা আমার সঙ্গে পারে না। আমি নাটক লিখি, আমি...।

ভোমলা? পাতলাদার আবার বাজখাঁই ধরনের ডাক। দৌড়ে সামনে আসি, এইতো পাতলাদা- বলেন!

তোর মোবাইল কই?

এইতো আমার পকেটে।

মোবাইল পকেটে থাকলে হবে? বের কর।

আমি সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত দিই মোবাইলের জন্য। কিন্তু পকেটে মোবাইল নেই। হাত দিই প্যান্টের পেছনের পকেটে। মাঝে মধ্যে প্যান্টের পেছনের পকেটেও মোবাইল রাখি, নেই। কি ধরনের আলতু ফালতু অবস্থা। আমাদের মহামান্য পাতলাদার সামনে জুরাইন থানার দারোগা সর্বনাশ মিয়া বসে আছেন, পাতলাদা হুকুম করেছেন, মোবাইল বের করতে, অথচ!

টিয়া আবার মুড়ির সঙ্গে চানাচুর খেতে পছন্দ করে। যখনই আমার সঙ্গে দেখা হয়, মোবাইলটা নিয়ে চানাচুর মুড়ি ভাজার অ্যাপসটা খুলে একবাটি চানাচুর আর মুড়ি বের করে খায়।

মোবাইল বের করতে এতোক্ষণ লাগে? পাতলাদার শান্ত নিরীহ চোখে মুখে ক্রোধ দৌড়াদৌড়ি করছে, আমি মোবাইল খুঁজে পাচ্ছি না।

পেছনের দরজার পাল দিয়ে আমার পিঠে বন্দুকের একটা নল এসে গুতো দিচ্ছে। কী করবো আমি? পাতলাদার আদেশে সারা শরীরে মোবাইল খুঁজবো? নাকি দারোগা সর্বনাশ মিয়ার টকটকে লাল চোখের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে পালাবো, আবার পিঠে রাম গুতো। বুঝতে পারছি এই গুতো দিচ্ছে বরিশাইল্ল্যা সাগর। ইচ্ছে করে ওকে ধরে কাঁচা ভাজা করে...।

ভোমলা, পেছনে তোর মোবাইল। গলা টিয়ার। তাহলে, মোবাইল সাগর নেয়নি। নিয়েছে টিয়া। টিয়া আবার মুড়ির সঙ্গে চানাচুর খেতে পছন্দ করে। যখনই আমার সঙ্গে দেখা হয়, মোবাইলটা নিয়ে চানাচুর মুড়ি ভাজার অ্যাপসটা খুলে একবাটি চানাচুর আর মুড়ি বের করে খায়। কখন যে মোবাইলটা নিয়েছে টেরই পাইনি। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে মোবাইলটা হাতে নিই, পাতলাদা এইতো মোবাইল।

তোদেরকে আমার সাড়ে বত্রিশভাজা করতে ইচ্ছে করছে। এমনিতে আমার সোনার ঘোড়া হারিয়ে যাওয়ায় আমি অস্থির, শোকাতুর। আর তোরা একটা মোবাইল...। পাতলাদা দাঁত কটমট করে তাকায় আমার দিকে। আমি হাসবো না কাঁদবো, বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারছি, আমার দুর্দশায় ভীষণ মজা পাচ্ছে দরজার ওপাশে সাগর, আকুল, টিয়া আর ব্যাকুল। ওরা দাঁত বের করে, মুখে হাত চাপা দিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। রাগে, বেদনায় আমার মাথার চুল উড়ে যেতে চাইছে। আমি চুলগুলোকে আদর করছি আর বলছি, যায় না সোনার চুল যায় না। গেলেই আমি ন্যাড়া হয়ে যাবো। ন্যাড়া হলে বেলতলায় গেলে...।

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!