নদী কত দূর?

নদীটিকে নিজের চোখে কখনও দেখিনি। গ্রামের মানুষের মুখে কেবল অনেক গল্প শুনেছি।

রবিউল কমলরবিউল কমল
Published : 28 Dec 2022, 01:39 PM
Updated : 28 Dec 2022, 01:39 PM

আমার ও নদীর মাঝে একটি পাহাড়। ঘন জঙ্গলে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে নদী।

নদীটিকে নিজের চোখে কখনও দেখিনি। গ্রামের মানুষের মুখে অনেক গল্প শুনেছি। আমি জানি নদীতে পানি আছে, মাছ মাছে, পাথর আছে, ঝরনা আছে। নদীটি নিয়ে এতো গল্প শুনেছি যে, আমার চোখের সামনে সব ভেসে ওঠে। শুধু এর পানি ছুঁয়ে দেখা হয়নি।

পাহাড়ের উল্টোদিকে টিলার ওপর আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছি, নদীর কথা ভাবছি। আমার পায়ে জুতো নেই। এর মানে এই নয়- আমার জুতো কেনার টাকা নেই। আসলে খালি পায়ে নিজেকে স্বাধীন লাগে। আর পাথরের উষ্ণতা ও শীতল ঘাসের স্পর্শ খুব ভালো লাগে। কেবল জুতো না পরলেই এগুলো উপভোগ করতে পারি।

সকাল এগারোটা বেজে গেছে। বাবা-মা সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়িতে থাকবেন না। ঘরে একটি রুটি আছে। চাইলে রুটিটা পকেটে পুরতে পারি। যাওয়ার পথে পাহাড়ি গাছ থেকে কিছু ফলও নিতে পারবো।

আমি যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, আজ সেই সুযোগ। এমন সুযোগ সহজে আর আসবে না। কারণ, বাবা-মা তাদের বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। সন্ধ্যার আগে ফিরতে পারলে তারা বুঝতেও পারবে না আমি কোথায় ছিলাম।

ঝোপের মধ্যে থাকা গাছের শেকড়গুলো সুচের মতো সোজা হয়ে আছে। মাঝে মাঝে আমার পায়ে ফুটছে। পাহাড়টি সবুজ ফার্ন দিয়ে ভরে গেছে, গাছগুলো লতায় জড়িয়ে আছে।

ঘরে ঢুকে খবরের কাগজে রুটিটা মুড়িয়ে নিলাম। তারপর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করলাম। নদীর পথটি খাড়া পাহাড়র ওপর উঠে গেছে। তারপর বড় পর্বতের চারপাশ দিয়ে চলে গেছে। গ্রামবাসী, কাঠমিস্ত্রি, দুধওয়ালা, মেষপালক, খচ্চর-চালকরা প্রায়ই পথটি ব্যবহার করত। কিন্তু, পাহাড়ের বাইরে বা নদীর কাছাকাছি কোনো গ্রাম নেই।

পথে একজন কাঠমিস্ত্রির দেখা হলো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম-

নদী কত দূর?

সাত মাইল। কিন্তু, তুমি জানতে চাইছ কেন?

আমি সেখানে যাচ্ছি।

একা?

হ্যাঁ।

সেখানে যেতে ৩ ঘণ্টা সময় লাগবে। তারপর ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আর পথটি মোটেও সহজ নয়।

আমি ভালো হাঁটতে পারি।

যদিও আমি বাড়ি ও স্কুলের মধ্যে দুই মাইলের বেশি দূরে কখনও যাইনি। কাঠমিস্ত্রিকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে রওনা হলাম। হাঁটতে হাঁটতে আবার পাহাড়ের নিচের দিকে নামতে লাগলাম।

রাস্তাটি উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা ও গোলাকার ছিল। একবার বা দুইবার পিছলেও গেলাম। ঝোপের মধ্যে থাকা গাছের শেকড়গুলো সুচের মতো সোজা হয়ে আছে। মাঝে মাঝে আমার পায়ে ফুটছে। পাহাড়টি সবুজ ফার্ন দিয়ে ভরে গেছে, গাছগুলো লতায় জড়িয়ে আছে।

আবার আমি উপত্যকায় উঠলাম। এবার রাস্তা সোজা হয়ে গেলো এবং ওপরের দিকে উঠে গেছে। বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হলো। তার হাতে লম্বা একটি কাঁচি। কাঁচি দিয়ে সে ঘাস কাটছিল।

তার নাক ও কানে দুল পরা। হাত দুটি ভারি চুড়িতে ভরা। যখন সে হাত নাড়ছে চুড়ি থেকে ঝিনঝিন শব্দ হচ্ছে। আমার মনে হলো তার হাত দুটি নিজস্ব ভাষাতে কথা বলছে। আমি তাকে বললাম, নদী কত দূর?

মেয়েটি সম্ভবত কখনও নদীতে যায়নি। কিংবা সে হয়তো অন্য কারো কথা ভাবছিল। তাই কোনো দ্বিধা ছাড়াই উত্তর দিলো, বিশ মাইল।

আমি হাঁটছি। গরম ধুলোময় পাথরের পথ ধরে হাঁটছি। আশপাশে কোনো কুঁড়েঘরও চোখে পড়ল না। চারদিকে কেবল বন আর মাথার ওপর সূর্য।

আমি হাসলাম এবং দৌড় দিলাম। হঠাৎ একটি টিয়েপাখি ডেকে উঠল। আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলো। সবুজ টিয়ে, লাল ঠোঁট। আমি পাখিটির পিছু পিছু দৌড়ালাম। তার ডানার মতো আমিও হাত দুটি দুইদিকে মেলে দৌড়াচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে আমি উড়ছি। পাখিটিকে যত সময় দেখতে পেলাম ততসময় দৌড়ালাম।

একসময় পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। সেখানে ছোট্ট গর্ত থেকে পানি পান করলাম। এখানকার পানি খুব ঠান্ডা। তবে বিশুদ্ধ। খুব দ্রুত আমার আবার তৃষ্ণা পেলো। সূর্যের কড়া রোদ সরাসরি পাহাড়ে এসে পড়ছে। ধুলোময় পথটি উত্তপ্ত হয়ে আছে। পায়ে পাথরের টুকরো লেগে জ্বালা করছে। আমি নিশ্চিত অর্ধেক পথ চলে এসেছি। কারণ এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে হাঁটছি।

একটি ছেলে পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তার সঙ্গে কয়েকটি ছাগল আছে। তার কাছে জানতে চাইলাম, নদী কত দূর?

গ্রামের ছেলেটি হাসতে হাসতে বলল, খুব বেশি দূরে নয়। পরের পাহাড়ে, সোজা নিচে।

আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। কাগজে মোড়ানো রুটিটা বের করলাম। তারপর সেটা দুই টুকরো করলাম। ছেলেটিকে এক টুকরো দিলাম। তারপর পাহাড়ে বসে চুপচাপ রুটি খেলাম।

খাওয়া শেষে একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করি। কিছুদূর গিয়ে সে আলাদা পথে চলে গেলো। আমি আবারও একা হয়ে গেলাম।

আমি গ্রামের ছেলেটিকে হারালাম। পাহাড়ের ওপরে ও নিচে তাকালাম। কিন্তু আর কাউকে চোখে পড়েনি। আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেলছি। আমার সঙ্গে কেউ থাকলে হয়তো এতটা বিচলিত হতাম না। কিন্তু আমি একা, আর হাঁটতে হাঁটতে বেশ ক্লান্ত।

কিন্তু আমি অর্ধেকেরও বেশি পথ এসে গেছি। তাই না ফিরে নদীটি দেখতে হবে। যদি না পারি হয়তো খারাপ লাগবে। কিন্তু নদীর কাছে যেতেই হবে।

আমি হাঁটছি। গরম ধুলোময় পাথরের পথ ধরে হাঁটছি। আশপাশে কোনো কুঁড়েঘরও চোখে পড়ল না। চারদিকে কেবল বন আর মাথার ওপর সূর্য। আর আমি একা। সেখানে কোনো মানুষ নেই। মানুষ থাকতে পারে এমন কোনো চিহ্নও চোখে পড়ল না। শুধু গাছ, পাথর, ঘাস এবং ছোট ছোট ফুল। আর নীরবতা। পাহাড়ের নীরবতা ভয়ঙ্কর। আমার পায়ের নিচে ঘাস নড়ছে। আমি শুধু সেই শব্দই শুনতে পাচ্ছি। আকাশে একটি বাজপাখি চক্কর দিচ্ছে।

অবশেষে আমি গোলাকার বাঁকা পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছলাম। ঠিক তখন জলের শব্দ শুনলাম। আমি অবাক, আনন্দিত। দৌড়াতে শুরু করি। পিছলে গিয়ে হোঁচটও খেলাম। তবু দৌড়াতে থাকলাম যতক্ষণ না আমি তুষার-শীতল পাহাড়ের পানিতে ডুব দিতে পারলাম, দৌড়ালাম।

সেই নদীটির পানি ছিল নীল-সাদা এবং বিস্ময়কর। আমি আগে কখনও এমন নদী দেখিনি।

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!