সংস্কৃতে কথাটি হলো, ‘নিশীথে বরদা লক্ষ্মী কোজাগর্তিভাষিণী’, অর্থাৎ রাত্রিবেলা লক্ষ্মী দেবী জিজ্ঞেস করেন, ‘কে, জেগে আছো আমার জন্য?’
Published : 01 Jul 2023, 11:13 AM
অভিধান হলো ভাষার শব্দ সংগ্রহমূলক গ্রন্থ। আমরা অভিধানে শব্দের একটি অর্থ যেমন পাই তেমন একটি শব্দের একাধিক অর্থও পাই। শব্দের অর্থ সবসময় একইরকম থাকে না। কালের পরিক্রমায় একটি শব্দ একাধিক নতুন নতুন অর্থ পরিগ্রহ করে।
ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থের সবসময় যে মিল থাকে এমনটিও নয়। এ জন্যই অভিধান হলো শব্দের রহস্যঘেরা এক বিস্ময়কর জগৎ। এতে অবগাহন করে নিরবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে শব্দের মণিমুক্তা কুড়াতে হয়। ভুক্তিশব্দের সঙ্গে অর্থ গঠনের যে বোঝাপড়া তার পেছনে কাজ করে মানুষের বহুবিচিত্র সব চিন্তাভাবনা। এ সূত্র ধরেই আমরা জানবো এমনই কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধের অর্থের গল্প।
দীপাবলি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি বিশেষ উৎসব। এক কথায় দীপাবলি মানে আলোর উৎসব।
প্রতি বছরই দুর্গাপূজার আনন্দ-উচ্ছ্বাস মিইয়ে যাওয়ার আগেই দীপাবলি আসে। বিজয়ার ভাসানে পাঁচদিনের আনন্দ-বিদায়ে অবচেতনে হলেও যে বিয়োগবিধুর চেতনায় আবিষ্ট হয় মন সেই মন দীপাবলিকে সামনে রেখেই আবার আনন্দের স্বপ্নে বিভোর হয়। বিশদভাবে বললে বলতে হয়, দীপাবলি শুধু সনাতনধর্মীদের নয়, শিখ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীদেরও অনুষ্ঠান। আর এখন এই অনুষ্ঠান সর্বজনীন।
দীপাবলি একইসঙ্গে দেওয়ালি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, দীপালি, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও পরিচিত। মহালয়ায় শ্রাদ্ধগ্রহণের জন্য যমলোক ছেড়ে যে পিতৃপুরুষগণ মর্ত্যে আগমন করেন, তাদের পথ প্রদর্শনার্থে উল্কা জ্বালানো হয়। এ কারণে ওইদিন আলোকসজ্জা ও বাজি পোড়ানো হয়ে থাকে। কেউ কেউ রাতে নিজগৃহে দরজা-জানালায় সলতে-প্রদীপ, মোমবাতি জ্বালায়; কেউবা লম্বা বাঁশের মাথায় কাগজের তৈরি ছোটো ঘরে প্রদীপ জ্বালায়। অনেকে এটি পুরো কার্তিক মাসজুড়ে করে থাকেন। একে বলা হয় আকাশপ্রদীপ প্রজ্বালন।
বাংলাদেশে দীপাবলির দিনে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়, তাই দীপাবলি আর কালীপূজা একইসূত্রে গাঁথা। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, নেপাল, ত্রিনিদাদ-টব্যাগো, মারিশাস, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ফিজি এবং সুরিনামে দীপাবলির দিন সরকারি ছুটি থাকে। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে দীপাবলিতে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে এই দিনে গণেশ পূজা এবং লক্ষ্মী পূজাও করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে দীপাবলি মূলত পাঁচদিনব্যাপী উৎসব। দীপাবলির আগের দিনের চতুর্দশীকে (এই দিনকে দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিন বলা হয়) বলা হয় ‘নরকা চতুর্দশী’; এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করেছিলেন।
জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর ৫২৭ অব্দে দীপাবলির দিনে মোক্ষ (নির্বাণ) লাভ করেন। দীপাবলির দিনে শিখ ধর্মগুরু গুরু হরগোবিন্দজি অমৃতসরে ফিরে আসেন; সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করে গোয়ালিওর দুর্গ থেকে বাহান্ন হিন্দু রাজাকে মুক্ত করে তার এই প্রত্যাবর্তনকে শিখগণ পালন করেন; তারা এই দিনকে ‘বন্দি ছোড় দিবস’ও বলে থাকেন।
রামায়ণ অনুসারে দীপাবলির দিনে ত্রেতা যুগে শ্রীরাম রাবণ বধ করে চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। শ্রীরামের চৌদ্দ বছর পরের প্রত্যাবর্তনে সারা রাজ্যজুড়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রজারা খুশিতে আতশবাজি ফোটায়। অনেকে মনে করেন দীপাবলির আলোকসজ্জা এবং আতশবাজি ত্রেতাযুগে রাম-রাজ্যে ঘটে যাওয়া সেই অধ্যায়কে সামনে রেখেই অপরাপর সব অঞ্চলে প্রচলিত-পরিচিত-বিস্তৃত হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে দীপাবলি মূলত পাঁচদিনব্যাপী উৎসব। দীপাবলির আগের দিনের চতুর্দশীকে (এই দিনকে দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিন বলা হয়) বলা হয় ‘নরকা চতুর্দশী’; এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করেছিলেন। চতুর্দশীর পরের অমাবস্যা তিথি দীপাবলি উৎসবের দ্বিতীয় দিন, এই দিনই মূল দীপাবলি উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়। এ দিন রাতে শাক্ত ধর্মের অনুসারীগণ শক্তির দেবী কালীর পূজা করে থাকেন।
বিষ্ণুপুরাণ মতে, বিষ্ণুর বামন অবতার অসুর বলিকে পাতালে পাঠান; দীপাবলির দিনে পৃথিবীতে এসে অন্ধকার ও অজ্ঞতা বিদূরিত করতে, ভালোবাসা ও জ্ঞানের শিখা প্রজ্বালন করতে অসুর বলিকে পৃথিবীতে এসে অযুত অযুত প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। দীপাবলির তৃতীয় দিন কার্তিকা শুদ্ধ; এই দিন অসুর বলি নরক থেকে বেরিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে বিষ্ণুর বরে পৃথিবী শাসন করে। চতুর্থ দিন হচ্ছে ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া; একে যম দ্বিতীয়াও বলা হয়; এই দিন বোনেরা ভাইকে নিমন্ত্রণ করে, কপালে ফোঁটা দেয়, হাতে রাখি বেঁধে দেয়। আর পঞ্চম দিনই দীপাবলি উৎসবের মধ্য দিয়ে তিথির পরিসমাপ্তি ঘটে।
প্রত্যেক সর্বজনীন আনন্দের উৎসব মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর জয়কে উদযাপন করে। আলোকসজ্জার এই দিবস অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো প্রজ্বালনের দিন। নিজের ভেতর-বাহিরের সব অজ্ঞতা ও অন্ধকারকে দীপশিখায় বিদূরিত করার দিন। দেশ থেকে দেশে এই দিনের মাহাত্ম্য ভিন্ন ভিন্ন তবুও মূল কথা এক। প্রকৃতপক্ষে দিপাবলি প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার চিরন্তন শিখা প্রজ্বালনের দিন; আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে সেই পরমব্রহ্মে লীন হওয়ার দিন।
প্রথমেই চলো জেনে নিই কোজাগর বা কোজাগরি বলতে কী বোঝায়? কোজাগর বা কোজাগরি মানে হলো সারা রাত জেগে থাকা। আক্ষরিক অর্থে, কোজাগর বা কোজাগরি মানে, ‘কে জেগে আছে’? ‘কো জাগর্তি’ শব্দবন্ধ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ‘কোজাগরি’ শব্দটি।
এবার চলো জানি এর ব্যুৎপত্তি প্রসঙ্গে। ‘কোজাগর’ একটি সন্ধিবদ্ধ সংস্কৃত শব্দ। কিন্তু ‘কোজাগরি’ বাংলা শব্দ। কোজাগর+বাংলা ই-প্রত্যয় সহযোগে গঠিত হয়েছে কোজাগরি শব্দটি। এখানে কঃ (কে) + জাগর (জেগে আছ?)। এটা আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি। একে লক্ষ্মীপূর্ণিমা বা আশ্বিনী পূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়। এই সময় তুলনামূলক অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করে। দাশরথি রায়ের পাঁচালিতে আছে: ‘ঘুমে লক্ষ্মী হন বিরূপা, জাগরণে লক্ষ্মীর কৃপা, নৈলে কেন জাগে কোজাগরে?’ দেবী লক্ষ্মী বলেন, ‘এই পূর্ণিমায় যে জাগে, তাকে ধনসম্পদ প্রদান করবো।’
প্রচলিত বিশ্বাস অনুয়ায়ী, আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে, লক্ষ্মী দেবী, বিষ্ণুলোক থেকে নেমে আসেন মর্ত্যধামে এবং সারারাত ধরে, গৃহস্থের দ্বারে দ্বারে ঘুরে দেখতে চান, কে তার অপেক্ষায় রাত জেগে বসে আছে। সংস্কৃতে কথাটি হলো, ‘নিশীথে বরদা লক্ষ্মী কোজাগর্তিভাষিণী’, অর্থাৎ রাত্রিবেলা লক্ষ্মী দেবী জিজ্ঞেস করেন, ‘কে, জেগে আছো আমার জন্য?’। যিনি জেগে থাকেন, তাকে লক্ষ্মী দেবী, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ধনসম্পদ প্রদান করেন। এরকম ধারণা থেকেই কোজাগরি লক্ষ্মী পুজো নামকরণ হয়।
ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর স্বামী হলেন নারায়ণ। তাই একই তিথিতে অনেকে যৌথভাবে লক্ষ্মী-নারায়ণের পূজাও করে থাকেন। সে হিসেবে অনেকে নারায়ণী-লক্ষ্মীও বলে থাকেন। তবে কোজাগরি লক্ষ্মী পূজাই বেশি পরিচিত শব্দবন্ধ।
ইন্টারনেটের দুনিয়ায় আমরা প্রায়ই নতুন নতুন শব্দের সম্মুখীন হই। তেমনি বর্তমান সময়ের একটি চালু শব্দ হলো ‘নেটিজেন’। এর অর্থ ইন্টারনেটের নাগরিক অর্থাৎ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। তোমরা যারা সারাক্ষণ ইন্টারনেট নিয়ে মেতে থাকো, তথা যারা ইন্টারনেট-প্রদত্ত সুবিধার মাধ্যমে তোমাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকো তারাই ‘নেটিজেন’।
ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেটিজেন শব্দটি ব্লেন্ডিং প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছে। শব্দটি Internet শব্দের ‘Net’ এবং Citizen শব্দের ‘Izen’ শব্দাংশ নিয়ে গঠিত একটি শব্দ।