নগরজীবন, চিত্রকলা, সংগীত ও বন্ধুত্ব— এসবই ছিল তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ।
Published : 09 Mar 2025, 12:59 AM
ফ্রাঙ্ক ও’হারা (১৯২৬–১৯৬৬) ছিলেন নিউ ইয়র্ক স্কুল কবিতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন জন অ্যাশবেরি, কেনেথ কচ, জেমস স্কুইলার ও বারবারা গেস্টের মতো কবিরা। তারা কবিতায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেন— স্বতঃস্ফূর্ততা, দৈনন্দিন ভাষার ব্যবহার ও অনিয়ন্ত্রিত বিষয়বস্তুর বিন্যাস।
ও’হারা নিজেও ছিলেন নিউ ইয়র্ক নগরজীবনের এক নিবেদিত অনুরাগী। এই শহরের গতি, বিশৃঙ্খলা, কোলাহল ও সংস্কৃতির ভেতরেই খুঁজে নিয়েছিলেন কবিতার উপাদান। রাস্তার দৃশ্য, শিল্পজগতের ব্যস্ততা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা— সবকিছুই তার কবিতার অংশ হয়ে উঠেছিল।
তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কথোপকথনের ঢং, যেন নগরজীবনের এক মুহূর্তের ফ্রেমবন্দী চিত্রকল্প। হাস্যরস, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও শিল্পবোধের সমন্বয়ে তার কবিতাগুলো হয়ে ওঠে অনন্য। গবেষকদের মতে, ও’হারার কবিতা যেন বাস্তবতার ক্ষণস্থায়ী স্ন্যাপশট— যেখানে মিশে থাকে অনুভূতি, সংলাপ ও এলোমেলো অভিজ্ঞতার সুতোগুলো।
নগরজীবন, চিত্রকলা, সংগীত ও বন্ধুত্ব— এসবই ছিল তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। ১৯৫০-এর দশকে তিনি কাজ করতেন মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে, যা তার শিল্পবোধকে আরও গভীর করেছিল। তার গুরুত্বপূর্ণ কবিতার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে— ‘লাঞ্চ পোয়েমস’ (১৯৬৪), ‘মেডিটেশনস ইন অ্যান ইমার্জেন্সি’ (১৯৫৭) এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘দ্য কালেক্টেড পোয়েমস অব ফ্রাঙ্ক ও’হারা’ (১৯৭১)।
মাত্র ৪০ বছর বয়সে, ১৯৬৬ সালে এক দুর্ঘটনায় তার জীবন শেষ হয়। তবে তার কবিতা আজও উত্তরাধুনিক কবিতার জগতে গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হয়। অলপোয়েট্রি পোর্টালের র্যাংকিং অনুযায়ী, বিশ্বের ৫০০ সেরা কবির মধ্যে ফ্রাঙ্ক ও’হারা রয়েছেন ১৪৩তম স্থানে। এখানে তার পাঁচটি কবিতার ভাবানুবাদ থেকে তাকে অনেকটা জানার চেষ্টা করা যায়-
আমার প্রয়াত পিতার প্রতি
ডাক দিও না আমাকে বাবা
যেখানেই তুমি আছো আমি আজও
তোমার সেই ছোট্ট ছেলে দৌড়ে
বেড়াচ্ছি অন্ধকারের ভেতর।
তোমার কথা শুনতে পারিনি আমি
শুনতে পারলেও শুনতাম
তোমার গোলাপ বেড়ে ওঠে না আর,
আমার হৃদয়ও ওদের বীজতলার
মতো কালো ছিমছাম কাঁটারা ওদের
হয়ে গেছে আমার মুখের খোঁচা খোঁচা খড়।
ফুল নিয়ে চিন্তা করা উচিত নয় তোমার।
আমার চোখের নীলাভে রেখো না ভয়
সেখানে লুকিয়ে থাকে বাদামি দাগ
আর ঠোঁট পুষ্ট করো না আমার
যখন তাকাই আমি আমার আয়নায়।
অন্য কিছু হতে বলো না
তোমার অদ্ভুত ছেলেটা ছাড়া
যে বোঝে ক্ষুদ্র সব অলৌকিকতা, মৃত্যুকে নয়
বাবা, আমি বেঁচে আছি! বাবা
গোলাপদের আর আমায় ক্ষমা করো।
আত্মজৈবনিক সাহিত্য
যখন আমি শিশু ছিলাম
স্কুলমাঠের এক কোণায়
নিজে নিজেই খেলতাম
একদম একা একা।
আমি ঘৃণা করতাম পুতুল
আর ঘৃণা করতাম খেলাধুলা,
প্রাণীদের সঙ্গে বন্ধুভাব ছিল না
আর পাখিরা উড়ে চলে যেত।
যদি কেউ আমাকে খুঁজত
লুকিয়ে পড়তাম গাছের আড়ালে
চিৎকার করে বলতাম, “আমি
একজন এতিম।”
আর এখন আমি এখানে,
সব সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দু!
এই কবিতাদের লিখছি!
ভাবতে পারো!
জন অ্যাশবেরিকে
আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে
আরেকটা পৃথিবী নেই যেখানে আমরা বসবো
আর একে অপরকে পড়ে শোনাবো নতুন কবিতা
উঁচু পাহাড়ের চূড়ায়, বাতাস বইছে চারদিক।
তুমি হবে তু ফু, আমি হব পো চু-ই*
আর মঙ্কি-লেডি থাকবে চাঁদে
হাসবে আমাদের বেখাপ্পা মাথার দিকে চেয়ে
যখন আমরা দেখছি একটা ডালে জমছে বরফ।
নাকি সত্যিই আমরা চলে যাব?
এটা তো সেই ঘাস নয়
যাকে যৌবনে দেখেছি আমি!
আর যদি চাঁদ, আজ রাতে উঠবে যখন,
থাকবে শূন্য— এ এক খারাপ ইঙ্গিত,
যার অর্থ, ‘ফুলের মতো, তুমি চলে যাও’।
নীরব একটি কবিতা
যখন সুর সরে যায় অনেক দূরে
চোখের পাতাও নড়ে না মুহুর্মুহু,
বস্তুরা স্থির— ল্যাভেন্ডারের মতো
নেই নিঃশ্বাস, প্রতিবাদও না।
তখন মেঘ
একটু একটু সরে যায়
রুপালি কোনো উড়ুক্কু যন্ত্রের টানে।
শুধু তার কথা ভাবলেই
উটকো ঝঙ্কার জাগে মনে।
ইঞ্জিনের শব্দরা খসে পড়ে মুদ্রার মতো
সমুদ্রের গহীন দেশে,
কেঁপে ওঠে না চোখ
যেমন কাঁপত অহরহ।
সোচ্চার রোদ্দুরে জেগে ওঠা মুদ্রা
খাঁজ কাটে কাছের
ঘন বাতাসের বুকে।
এখন, ধীরে ধীরে,
হৃদয় শ্বাস নেয় সঙ্গীতে
আর হলুদ ভেজা বালিতে
ছিটিয়ে থাকে মুদ্রারা।
আজ
ওহ! ক্যাঙারু, সিকুইন, চকলেট সোডা!
সত্যিই কি সুন্দর তোমরা! মুক্তো,
হারমোনিকা, জুজুব, অ্যাসপিরিন!
এইসব নিয়েই তো তারা
কথা বলে চলে সারাদিন।
তারপরও কবিতা আসে
আসে চূড়ান্ত সারপ্রাইজ নিয়ে!
আর
আমাদের সঙ্গেই ওরা থাকে প্রতিদিন
সৈকতঘাঁটি, শববেদি বাখাটিয়ার মধ্যেও।
ওদেরও অর্থ আছে।
পোক্ত তারা পাথরের মতো।
* চাইনিজ কবি- তু ফু ও পো চু-ই