তুমুল জনপ্রিয় অনেক ছড়া-কবিতার কবি জসীম উদ্দীন।
Published : 12 Jul 2024, 10:46 AM
‘ডালিমকুমার’ গল্প কে শোনেনি! রূপকথার গল্পটির লেখক কবি জসীম উদ্দীন। তিনি আমাদের বেশকিছু শিশুতোষ লেখা উপহার দিয়েছেন। কিছু ছড়া ও কিশোর কবিতা তো এখনও আমরা মুখে মুখে বলে থাকি।
আবার আমাদের অনেকে তুমুল জনপ্রিয় ছড়া-কবিতাটি যে জসীম উদ্দীন তা জানি না! আজ শিশুতোষ এমন কিছু ছড়া ও কবিতা নিয়ে আলোচনা করবো।
‘হাসু’ ও ‘এক পয়সার বাঁশি’ দুটি শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতাই তোমাদের মতো করে লেখা। একটু না হয় পড়েই দেখো-
১. ‘এই খুকীটির সঙ্গে আমার আলাপ যদি হয়,/ সাগর-পারের ঝিনুক হয়ে ভাসবো সাগরময়;/ রঙিন পাখির পালক হয়ে ঝরবো বালুর চরে,/ শঙ্খমোতির মালা হয়ে দুলব ঢেউ এর পরে।/ তবে আমি ছড়ার সুরে ছড়িয়ে যাব বায়,/ তবে আমি মালা হয়ে জড়াব তার গায়।’ (আলাপ, হাসু)
২. ‘এই খুকীটির সঙ্গে তোমার আলাপ যদি থাকে,/ বলো যেন আসমানীরে বারেক কাছে ডাকে’- (খোসমানী, এক পয়সার বাঁশী)
৩. ‘খুকুমণি! লক্ষ্মীমণি! তোমায় আমি চাঁদ বলিব,/ সন্ধ্যা মেঘের টুকরো ছিঁড়ে তোমার দুটো পায় দলিব।’ (কবি ও চাষার মেয়ে, এক পয়সার বাঁশী)
৪. ‘এত হাসি কোথায় পেলে/ এত কথার খলখলানি/ কে দিয়েছে মুখটি ভরে/ কোন বা গাঙের কলকলানি।/ কে দিয়েছে রঙিন ঠোঁটে/ কলমী ফুলের গুলগুলানি।/ কে দিয়েছে চলন বলন/ কোন সে লতার দোল দুলানী।’ (এত হাসি কোথায় পেলে)
ফুটবল খেলোয়াড় ইমদাদ হকের কথা কিন্তু ছোট্টবেলাতেই শুনেছি। কবি জসীম উদ্দীনের ‘ফুটবল খেলোয়াড়’ কবিতা থেকে- ‘আমাদের মেসে ইমদাদ হক ফুটবল খেলোয়াড়,/ হাতে পায়ে মুখে শত আঘাতের ক্ষতে খ্যাতি লেখা তার।/ সন্ধ্যা বেলায় দেখিবে তাহারে পটি বাঁধি পায়ে হাতে,/ মালিশ মাখিছে প্রতি গিঠে গিঠে কাত হয়ে বিছানাতে।/ মেসের চাকর হয় লবেজান সেঁক দিতে ভাঙা হাড়ে,/ সারা রাত শুধু ছটফট করে কেঁদে কেঁদে ডাক ছাড়ে।/...বাম পায়ে বল ড্রিবলিং করে ডান পায়ে মারে ঠেলা,/ ভাঙা কয়খানা হাতে পায়ে তার বজ্র করিছে খেলা।/ চালাও চালাও আরও আগে যাও বাতাসের মতো ধাও,/ মারো জোরে মারো-গোলের ভেতরে বলেরে ছুঁড়িয়া দাও।’
বিন্নি ও শালি ধানের নাম আমরা শুনেছি, তাই না! নবান্নের সময় এসবের কদর ছিল আগেরকার সময়। এসবের খবর কিন্তু কবি জসীম উদ্দীনের কবিতা থেকেই বেশি শুনেছি আমরা। আরও শুনেছি মৌরীখেতে লুটোপুটি খেলা-
১. ‘আমার বাড়ি যাইও ভোমর,/ বসতে দেব পিঁড়ে,/ জলপান যে করতে দেব/শালি ধানের চিঁড়ে।/শালি ধানের চিঁড়ে দেব,/ বিন্নি ধানের খই,/ বাড়ির গাছের কবরী কলা/গামছা বাঁধা দই।’ (আমার বাড়ি)
২. ‘চির বিরিঞ্চির গাছে রে ভাই লাল টুকটুক টিয়া,/ বসে আছে মৌরী ফুলের ছাতি মাথায় দিয়া।’ (আবল তাবল, এক পয়সার বাঁশী)
কবি জসীম উদ্দীনের মানবিক সত্তাও ফুটে উঠেছে শিশুতোষ ছড়া ও কবিতায়। আবার ব্যথাতুর হয়েছে এতিম শিশুর শোকে-
১. ‘সবার সুখে হাসব আমি/ কাঁদব সবার দুখে,/ নিজের খাবার বিলিয়ে দেব/ অনাহারীর মুখে।’ (সবার সুখে)
২. ‘কোথায় আমার রাজার কুমার, শুয়ে মায়ের কোলে/ তোমার কি ঘুম ভাঙবে না এই শিশুর চোখের জলে।’ (পূর্ণিমা)। এতিম শিশুর জন্য ব্যথাতুর কবি। হৃদয়ে শোক এনে দাগ কেটে দেয় কবিতাটি।
৩. ‘রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও,/ বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?/ ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ/ কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা;/ সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,/...সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা/ সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না!’ (রাখাল ছেলে)
৫. ‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,/ রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।/ বাড়িতো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,/ একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।/ একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,/ তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।/... পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,/ বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।’ (আসমানী)
এ কবিতায় গ্রামের গরিব ও হতভাগ্যের কথা তুলে ধরেছেন কবি। এ কবিতাটিও আমরা প্রায়ই পড়ে থাকি এখনও।
তোমাদের মতোই ছোট্ট মেয়ে হাসু। এই হাসু নিয়েই কবি লিখলেন ‘হাসু’ কবিতা। ‘হাসু একটি ছোট্ট মেয়ে/ এদের মতো- তাদের মতো,/ হেথায় সেথায় ছড়িয়ে আছে খোকা-খুকু যেমনি শত।/ নয় তো সে চাঁদের চাঁদকুমারী/ তারার মালা গলায় পরে/ চালায় না সে চাঁদের তরী/ সারাটি রাগ গগন ভরে.../ তবু তারে ভালোই লাগে চাঁদের দেশের চাঁদের মেয়ে/ শঙ্খমালা, রঙ্গমালা, কঙ্কাবতী, সবার চেয়ে।’