সাক্ষাৎকার
‘আমি সবসময় ভালো নম্বর পেতাম। কিন্তু আমার বাবা বলতেন, তার কারণ ক্লাসে অন্য কেউ বেশি মেধাবী ছিল না।’
Published : 06 Jan 2025, 03:46 PM
আমেরিকান অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই. স্টিগলিৎজ, তিনি নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। দেশটিতে অর্থনীতি বিষয়ক বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ‘অ্যাসিমেট্রিক ইনফরমেশন’ বিশ্লেষণের জন্য স্টিগলিৎজ ২০০১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ।
স্টিগলিৎজ ১৯৪৩ সালে ইন্ডিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন। অ্যামহার্স্ট কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৬৭ সালে ম্যাসাচুসেট্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে পিএইচডি নেন। স্টিগলিৎজ অর্থনীতিতে একটি নতুন শাখা সৃষ্টি করেছেন, যা ‘ইকোনমিক্স অফ ইনফরমেশন’ বা ‘তথ্যের অর্থনীতি’ নামে পরিচিত। তার কাজ বাজারের ব্যর্থতার কারণ এবং কীভাবে সরকারি হস্তক্ষেপ তা উন্নত করতে পারে, তা ব্যাখ্যা করে।
স্টিগলিৎজের লেখা বই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। তার ‘গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিজকন্টেন্ট’ বইটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অন্যান্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে: ‘দ্য রোয়ারিং নাইনটিজ’ (২০০৩), ‘ফেয়ার ট্রেড ফর অল’ (২০০৫), ‘স্ট্যাবিলিটি অ্যান্ড গ্রোথ’ (২০০৬), ‘ফ্রিফল’ (২০১০), ‘দ্য প্রাইজ অফ ইনইকুয়ালিটি’ (২০১২), ‘দ্য রোড টু ফ্রিডম’ (২০২৪) ইত্যাদি।
স্টিগলিৎজের কাজ ও চিন্তাভাবনা তাকে সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ হিসেবে গড়ে তুলেছে। ২০০৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নিজের বাড়িতে কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুলকে একটি সাক্ষাৎকার দেন তিনি, যেখানে তার ব্যক্তিগত বেশকিছু দিক উঠে এসেছে। জেমি কার্নকে দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে পেশাগত জীবনের বাইরের গল্পগুলো নতুন প্রজন্মের আগ্রহকে উসকে দেবে। তাদের উপযোগী করে পুরো সাক্ষাৎকারের বাছাই করা অংশ এখানে অনূদিত হলো-
আমি সবসময় ভালো নম্বর পেতাম। কিন্তু আমার বাবা বলতেন, তার কারণ ক্লাসে অন্য কেউ বেশি মেধাবী ছিল না।
জেমি: বাহ! আপনার বাড়ি তো খুব সুন্দর।
স্টিগলিৎজ: ধন্যবাদ। এই দৃশ্যটা সত্যিই চমৎকার, তাই না? (হাডসন নদীর দিকে তাকিয়ে।)
জেমি: এই ছবিগুলোও খুব সুন্দর। (বিল ক্লিনটন, আল গোর আর সুইডিশ রাজ পরিবারের সঙ্গে তার বিভিন্ন ছবি দেওয়ালে টাঙানো।)
জেমি: জো, সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমার লক্ষ্য হলো আপনার এমন কিছু জানা, যা ক্লাসে বসে বা সিভি পড়ে জানা যায় না।
স্টিগলিৎজ: ঠিক আছে। (জুতো খুলে ফেলেন।)
জেমি: আপনি কি সবসময় জুতো খুলে রাখেন?
স্টিগলিৎজ: হ্যাঁ, এটা বেশ আরামদায়ক।
জেমি: ক্লাসেও কি জুতো খুলে পড়ান?
স্টিগলিৎজ: (হেসে) না।
জেমি: আপনার শৈশব নিয়ে কিছু বলুন।
স্টিগলিৎজ: আমি ইন্ডিয়ানার গ্যারি শহরে বড় হয়েছি। এটি একটি পুরোনো ইস্পাতের শহর। আমাদের পরিবারে আমি, আমার এক ভাই ও এক বোন। আমার বাবা বীমা ব্যবসা করতেন, আর মা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। তিনি ৬৭ বছর বয়সে অবসর নেন, কিন্তু পরে পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং ৮৪ বছর বয়স পর্যন্ত পড়িয়েছেন।
জেমি: আপনি কি সবসময় জানতেন যে আপনি এত মেধাবী?
স্টিগলিৎজ: (হেসে) এটি কঠিন প্রশ্ন। আমি জানি না। আমি সবসময় ভালো নম্বর পেতাম। কিন্তু আমার বাবা বলতেন, তার কারণ ক্লাসে অন্য কেউ বেশি মেধাবী ছিল না। আমার বাবা-মা সবসময় পড়াশোনা আর রাজনীতির ওপর জোর দিতেন। আমরা ছোটবেলা থেকেই অনেক গভীর রাজনৈতিক আলোচনা করতাম।
জেমি: আপনার পরিবার কি আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল?
স্টিগলিৎজ: না। তারা সবসময় বলতেন, টাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে আমাদের যথেষ্ট ছিল। আমাদের এক ধনী চাচা ছিলেন, যিনি বিলাসিতার খরচ দিতেন। আমার বাবা-মা এসব সামলাতে পারতেন না।
কিছু সমালোচনা গঠনমূলক, যেমন কোনো লেখা বা ধারণায় ত্রুটি দেখানো। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এটা অহংকারের বশে করা হয়, অন্যকে নিচে নামিয়ে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা।
জেমি: আপনি হাই স্কুলে কেমন ছিলেন?
স্টিগলিৎজ: খুব পড়াশোনা করতাম, বিতর্ক দলের সদস্য ছিলাম।
জেমি: আপনি কি অহংকারী?
স্টিগলিৎজ: আমার তা মনে হয় না।
জেমি: সত্যি? তবে আপনি আত্মবিশ্বাসী?
স্টিগলিৎজ: হ্যাঁ।
জেমি: সমালোচনা কীভাবে সামলান?
স্টিগলিৎজ: সমালোচনা পছন্দ করি না। আমি খুবই সংবেদনশীল। কেউ আমাকে অপছন্দ করে তা সহ্য করা কঠিন। ছোটবেলাতেও এটা পারতাম না। তবে, জনজীবনে ও একাডেমিক ক্ষেত্রে এটি মেনে নিতে হয়। তবে কিছু সমালোচনা গঠনমূলক, যেমন কোনো লেখা বা ধারণায় ত্রুটি দেখানো। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এটা অহংকারের বশে করা হয়, অন্যকে নিচে নামিয়ে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা। এটা একদম পছন্দ করি না।
জেমি: আপনার আদর্শ কে?
স্টিগলিৎজ: কেন অ্যারো (মার্কিন অর্থনীতিবিদ কেনেথ জোসেফ অ্যারো)। তিনি অসাধারণ মেধাবী এবং আশির দশকেও খুব সজাগ ও উদার মনের।
জেমি: আপনার ১৮টি সম্মানসূচক পিএইচডি আছে এবং আরও তিনটি পেতে যাচ্ছেন। কেমন লাগে?
স্টিগলিৎজ: ভালো লাগে। আমি অনেক পরিশ্রম করেছি এবং কখনো কখনো বিতর্কিত অবস্থান নিয়েছি। তাই এমন স্বীকৃতি পাওয়া আনন্দের।
জেমি: আপনি কি কখনো ভেবে দেখেন, ‘ওহ, আমি তো বেশ মেধাবী’?
স্টিগলিৎজ: (হেসে) না, না। তবে মাঝে মাঝে নিজের জীবনের বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবি।
জেমি: অনেকে বলে, বিজ্ঞানমনস্করা ধর্মে বিশ্বাস করে না। আপনি কি ধর্মে বিশ্বাসী?
স্টিগলিৎজ: আমি এ বিষয়ে বেশ সংশয়ী। তবে আমি নৈতিকতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে অনেক ভাবি। আমার ধর্মীয় শিক্ষা ছিল খুব শক্তিশালী।
অনেক বুদ্ধিমান মানুষ আছেন, যারা নিজেদের পূর্ণ সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করেন না। আবার অনেক মানুষ আছেন যারা কঠোর পরিশ্রম করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, কিন্তু তারা মেধাবী নন...
জেমি: রেস্তোরাঁয় গিয়ে যদি দেখেন বসায় জায়গা নেই, কখনও কি বলার প্রয়োজন হয়, ‘এই শোন! আমি কিন্তু নোবেল পুরস্কার পেয়েছি’?
স্টিগলিৎজ: (হেসে) না।
জেমি: নোবেল পুরস্কারটা দেখতে কেমন? কখনও কি এটা পরে বসে থাকেন?
স্টিগলিৎজ: এটি একটি স্বর্ণপদক, ভল্টে রাখা হয়। এর কয়েকটি রেপ্লিকা ও একটি শংসাপত্রও পাওয়া যায়। দারুণ জিনিস।
জেমি: আপনার সিভি (জীবনবৃত্তান্ত) ৪৮ পৃষ্ঠার (বর্তমানে ১৫৩ পৃষ্ঠা)। এত কিছু করার পরও আপনি কি আরও কিছু করার কথা ভাবেন?
স্টিগলিৎজ: আমি লিখতে ভালোবাসি। কোনো সমস্যা এলে লিখে তা সমাধানের চেষ্টা করি। কিছু কিছু লেখা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও করি।
জেমি: টিভি দেখেন?
স্টিগলিৎজ: না। প্রায় কখনই না।
জেমি: আপনার গিলটি প্লেজার কী?
স্টিগলিৎজ: (হাসি) খাওয়া। আমি বাইরের খাবার পছন্দ করি।
জেমি: রান্না করেন?
স্টিগলিৎজ: একসময় করতাম। এখন আরও চেষ্টা করছি, কিন্তু এত ব্যস্ত আছি। সম্প্রতি আমি এক ধরনের স্যুপ তৈরি করেছি।
জেমি: হ্যাঁ, আপনি সত্যিই ব্যস্ত। আমি দেখছিলাম, আপনি যখন আপনার অফিসে ঢুকছিলেন এবং আপনার সহকর্মীদের সঙ্গে অসীম গতিতে যোগাযোগ করছেন... আমি কিছু বলার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু একটা শব্দও বলতে পারছিলাম না। সত্যিই অবিশ্বাস্য।
স্টিগলিৎজ: হ্যাঁ।
জেমি: আপনি কীভাবে বিশ্রাম নেন?
স্টিগলিৎজ: কোথাও যেতে যেতে, গাড়িতে, খুব শান্তিপূর্ণ।
জেমি: আপনাকে প্রথমবার বসে থাকা দেখলাম।
স্টিগলিৎজ: (হাসি) হ্যাঁ।
জেমি: আপনি কী মনে করেন, মেধাবীরা জন্ম নেয়, নাকি গড়ে ওঠে?
স্টিগলিৎজ: আমি মনে করি এটা উভয়ের মিশ্রণ। অনেক বুদ্ধিমান মানুষ আছেন, যারা নিজেদের পূর্ণ সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করেন না। আবার অনেক মানুষ আছেন যারা কঠোর পরিশ্রম করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, কিন্তু তারা মেধাবী নন... তাই আমি মনে করি এটা সম্ভবত উভয়ের একটি সমন্বয়।
জেমি: ‘অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড’ চলচ্চিত্রটা দেখেছেন?
স্টিগলিৎজ: হ্যাঁ, আমি জন ন্যাশকে চিনি। নোবেল কনফারেন্সে তিনি আমাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছিলেন।
জেমি: নোবেল পুরস্কারের টাকাগুলো কী করলেন?
স্টিগলিৎজ: এটা তিনজনের মধ্যে ভাগ হয়, তারপর সরকার অর্ধেক নিয়ে নেয়। আসলে খুব বেশি থাকে না।
জেমি: আপনি খুব প্রতিভাবান। আপনি কি মনে করেন, আপনার জীবন সার্থক?
স্টিগলিৎজ: হ্যাঁ, মনে করি। আর আনিয়া (বান্ধবী) এটাকে আরও ভালোভাবে ভাবতে সাহায্য করেছে।
টাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্তর্নিহিত পুরস্কার, সহজাত প্রাপ্তির দিকে মনোযোগ দিন।
জেমি: রাস্তায় যদি কোনো পয়সা পড়ে থাকতে দেখেন, কুড়াবেন? আপনি কি কোনোভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন?
স্টিগলিৎজ: কখনো কখনো আমি ফোয়ারায় পয়সা ছুড়ে ফেলি বা কাঠে টোকা দিই। তবে সেটা সামাজিক রীতি হিসেবে, কুসংস্কারের জন্য নয়।
জেমি: আপনার সবচেয়ে অপছন্দের বিষয় কী?
স্টিগলিৎজ: অদক্ষতা। আর যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের বা বিশেষ স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, বরং তাদের সুযোগ ছিল পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু করার।
জেমি: কখনো কি এমন কারো সঙ্গে দেখা করেছেন যিনি আপনার মতো মেধাবী?
স্টিগলিৎজ: (একটু থেমে) হ্যাঁ।
জেমি:সত্যি বলছেন?
স্টিগলিৎজ: হ্যাঁ, কেন অ্যারো (মার্কিন অর্থনীতিবিদ কেনেথ জোসেফ অ্যারো)। আমার বেশ কয়েকজন শিক্ষক খুব মেধাবী ছিলেন। ব্রুস গ্রিনওয়াল্ডও প্রকৃত প্রতিভাবান।
জেমি: আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী?
স্টিগলিৎজ: বিশৃঙ্খলা।
জেমি: আপনার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাহীনতা কী?
স্টিগলিৎজ: (একটু থেমে) আমি উদ্বিগ্ন যে মানুষ আমাকে বুঝতে পারে না।
জেমি: আপনার তত্ত্বগুলো নাকি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে বুঝতে পারে না?
স্টিগলিটজ: উভয়ই।
জেমি: কী আপনাকে প্রেরণা দেয়?
স্টিগলিৎজ: বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণাগুলো আমি ভালোবাসি, আর আমি সত্যিই শেখাতে ভালোবাসি।
জেমি: এখন আপনার জীবনের যেসব জিনিস জানেন, সেগুলো যদি ২৭ বছর বয়সে জানতেন, তাহলে?
স্টিগলিৎজ: অনেক কিছু এখন জানি, যা ২৭ বছর বয়সে না জানাই ভালো ছিল। তখন মনে করতাম, ভালো ও নতুন ধারণা থাকলেই মানুষকে প্রভাবিত করা যাবে। এখন বুঝি, বিশেষ স্বার্থ, আমলাতন্ত্র এবং রাজনীতি অনেক বড় ভূমিকা রাখে।
জেমি: আপনি কি কখনো গালি দিয়েছেন?
স্টিগলিৎজ: একবার দিয়েছিলাম, তখন মা আমার মুখ ধুয়ে দিয়েছিলেন সাবান দিয়ে।
জেমি: বড় হয়ে কখনো?
স্টিগলিৎজ: না।
জেমি: আপনি কি সহজেই কাঁদেন?
স্টিগলিৎজ: হ্যাঁ, দুঃখজনক কিছুতে, অন্যায় দেখে, এমনকি ইতিবাচক কিছুতেও।
জেমি: স্কুলের ছাত্রদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
স্টিগলিৎজ: টাকা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্তর্নিহিত পুরস্কার, সহজাত প্রাপ্তির দিকে মনোযোগ দাও।