‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কবি আসাদ চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।
Published : 22 Feb 2023, 03:31 PM
বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রণী কবি আসাদ চৌধুরী [১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩]। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে শুরু করে আজও তার আঙুল ছড়ায় বাংলা কবিতার সুবাস। বাংলাদেশ নামে স্বাধীন এ ভূখণ্ড সৃষ্টির যে দীর্ঘ ইতিহাস, সেই ইতিহাসের পৃষ্ঠার ভেতরই যেন তার শব্দচাষ। কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণা, শিশুসাহিত্য ও অনুবাদসহ তার বইয়ের সংখ্যা শতাধিক।
অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশব–কৈশোরের গল্প শুনিয়েছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এ কবি।
জীবনের ৮০ বছরে পা দিয়েছেন আপনি, কবিতা লিখছেন প্রায় ৬০ বছর ধরে। কবিতাচর্চার শুরুটা কীভাবে?
লেখালেখির ঝোঁক ছিল না আমার। পড়ার ঝোঁকটাই বড় ছিল। প্রচুর বই পড়তাম। আজাদ সুলতান নামে আমার মুরুব্বি ছিলেন একজন, বামঘেঁষা লোক। তার একটা লাইব্রেরি ছিল বরিশাল শহরে, ‘এমদাদিয়া লাইব্রেরি’। সেখান থেকে আমি বইটই নিয়ে পড়তাম, বই কিনতাম। বিশেষ করে উনি আমাকে দিতেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর সুকান্তের বই। উনি জানতেন যে আমি কবিতা পড়ি পাগলের মতো। ১৯৬১ সালে কঙ্গোর বিপ্লবী নেতা পাত্রিস লুমুম্বা মারা যান, আমি তখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। আজাদ সুলতান একটা সংকলনের জন্য আমাকে বললেন, একটা কবিতা দাও। আমি বললাম, ঠিক আছে। তিন কি চার তা কাগজ কিনলাম। পকেটে একটা রাইটার কলম ছিল। ওই সময় ঢাকার নবাবপুরে একটা রেস্টুরেন্টে চা খেতে যেতাম। তাজউদ্দীন আহমদ সাহেব আসতেন মাঝে মাঝে, আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তো ওই রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতে পাত্রিস লুমুম্বাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলি। কবিতাটা নিয়ে আজাদ সুলতানকে দিলাম। তিনি রেখে দিলেন, মন্তব্য করলেন না। এক ভদ্রলোক এলেন, তিনি পড়লেন। পড়ে কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে গেলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে উনি? বললেন, রণেশ দাশগুপ্ত। আমার তো বুক কেঁপে উঠলো। সাহিত্য পাতা নয়, তিনি ওইটা এডিটোরিয়াল পৃষ্ঠায় ছেপে দিলেন। এটা আমার জন্য বিরাট পাওয়া ছিল, আর ওই কবিতা আমাকে যথেষ্ট পরিচিতি এনে দিলো।
আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কীভাবে কেটেছে?
শৈশবটা আমার দুই জায়গায় কেটেছে, বরিশাল আর পুরান ঢাকায়। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায় আমার জন্ম। তখন এতো বড় বন্দর ছিল না, আমাদের জমিদার বাড়িটাই বড় ছিল। আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি। গ্রামে কেটেছে অনেক সময়। ক্লাশ ওয়ানে পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় চলে যাই। জ্বর হয়েছিল, আমাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ৪৭ সালের কথা, কলকাতা দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। সেখানে মাস দেড়েকের মতো ছিলাম। ৪৭-এর দাঙ্গা দেখলাম। তারপরই তো পাকিস্তান হয়ে গেলো। আব্বা মোঃ আরিফ চৌধুরী এমএলএ ছিলেন। বাবাকে ছোট্টবেলায় আমি খুব কমই দেখেছি। তিনি কংগ্রেস করতেন, যুক্তবঙ্গের জন্য বহু চেষ্টা করেছিলেন। আমার দাদি খদ্দরের শাড়ি পরতেন। ক্লাস টুতে আমি কোনো স্কুলে পড়িনি। ঢাকায় আসতে হলো। আব্বা চেয়েছিলেন সেন্ট গ্রেগরিতে পড়াতে। আমার কাজিনরা ছিলেন ওই স্কুলের ছাত্র। কিন্তু গিয়ে দেখলাম ইংরেজ সাহেবরা পড়ায়। সাহেবদের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা আমার আগাগোড়াই ছিল। তো আমি ওই স্কুলে পড়লাম না। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় আমি ওল্ড ঢাকা পুরোটাই চষে বেড়িয়েছি। এখনকার বাবা-মায়েদের মতো নয় যে বাসা থেকে বের হতে দেবে না, বা এটা সেটা। স্বাধীনতা ছিল। তবে প্রায়ই গ্রামে যাওয়ার জন্য মনটা কেমন করত। গ্রামে কিছুদিন থাকার পর আবার শহরে ফিরতে পাগল হয়ে যেতাম।
তখনকার ঢাকা কেমন ছিল? কিশোর-তরুণরা সিনেমা দেখা বা ক্রিকেট-ফুটবল খেলতো?
হ্যাঁ। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি, কুর্মিটোলা গভর্মেন্ট হাই স্কুলে। এর মধ্যে আমি গ্রামে গিয়েছি। গ্রাম থেকে সিক্স পাশ করলাম। তারপর স্কলারশিপ পেলাম, গভর্মেন্ট স্কুলে ভর্তি হলাম। প্রচুর সিনেমা দেখতাম। বইপত্র বেচে দিয়েও সিনেমা-হলে যেতাম। ওই সময়ের হলের অনেক টিকিট বিক্রেতাও আমাকে চিনত। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে মারামারিও করেছি একসময়। ধনু গুণ্ডা ছিল শাঁখারীপট্টিতে। ওখানকার লোকেরা চাইত না আমরা খেলি। আমাদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি মুসলমান- পশ্চিমবঙ্গ, বিহার কিংবা কলকাতা থেকে আসা। একদিন আমরা ক্রিকেট খেলছিলাম, ধনু এসে ডিস্টার্ব শুরু করলো। আমার সাহসটা বরাবরই বেশি ছিল। একটা স্টাম্প নিয়ে তার হাঁটুতে এমন জোরে মারলাম সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল। পিটমোড়া দিয়ে বাঁধলাম। তারপর আস্তে চলে গেলো আর সে কখনও আসেনি। গ্রামের আনন্দটা আমি পেয়েছি, শহরের আনন্দটাও পেয়েছি। আর ঢাকা বড় হয়েছে চোখের সামনে। সদরঘাট থেকে মগবাজার গিয়েছি ছয় আনা রিকশা ভাড়া দিয়ে। তখন ভালো রেস্টুরেন্ট ছিল না। আব্বা খুব কষ্ট পেতেন- কলকাতা থেকে আসা লোক, চিরটাকাল কলকাতায় রাজনীতি করেছেন। শিক কাবাব, টিকিয়া ওই বিহারিরা বানাতো। ‘বেবি আইসক্রিম’ যখন এলো হইচই পড়ে গেলো ঢাকায়। তারপর ফুচকা এলো। এইতো কলকাতার মজা পাওয়া গেলো! তখন কলকাতার সঙ্গে পার্থক্য অনুভব করতাম না, যাক এসে গেছে।
আপনি বইপোকা ছিলেন, বই পড়া কীভাবে শুরু হলো?
আমি ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড হতাম। ক্লাস ফোর পর্যন্ত সবসময় ফার্স্ট হয়েছি। তখন বই উপহার পেতাম। আব্বা প্রচুর বই কিনে দিতেন। ক্লাস টুতে আমি প্রথম নিজে বানান করে বই পড়তাম, খান মোহাম্মদ মইদুলের ‘আমাদের নবী’ বইটা পড়তাম। তারপর অ্যাডভেঞ্চার, ডিটেকটিভ বই পড়তাম। ক্লাস সিক্স-সেভেনে মোটামুটি শরৎচন্দ্র আমার খুব প্রিয় লেখক হয়ে গেলেন। প্রিয় হলেন সুকুমার রায়। রবীন্দ্রনাথ পড়েছি পরে, নজরুল প্রিয় হয়েছেন ক্লাস ফোরে। ১৯৫৪ সালের আগে নজরুলের সব বই নিষিদ্ধ ছিল পাকিস্তানে, সে ‘হিন্দু বিয়ে করেছে’ এমন অভিযোগে।
আপনার প্রথম কবিতাবই ‘তবক দেওয়া পান’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। পানের কথা কীভাবে এলো আপনার কবিতায়? তখনও কি আপনি পান খেতেন?
তখন আমি বিয়ে-বাড়িতে পান খেতাম। বইয়ের নামের বেলায় আমি চাচ্ছিলাম এমনকিছু একটা যা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান প্রতিটি বাঙালির কাছে প্রিয়। তো বাঙালির কাছে প্রিয় হচ্ছে- দুধ, মাছ আর পান-সুপারি। বিয়ে-বাড়িতে এ তিনটা জিনিসই দেখলাম। ‘সব খাওয়ালো পান দিল না… তামাক দিল না…’, এমন কথা হতো। পান হলো সমাদরের চিত্র। বাঙালির মাঙ্গলিক উৎসবে-আনন্দে পানের কদর আছে। গরিব আর বড়লোক সবাই কিন্তু সমাদর করতে ভালোবাসে। পানের মর্যাদা এতটাই। তো শুধু পান তো আর রাখা যায় না, তাই ‘তবক দেওয়া পান’ রাখলাম বইয়ের নাম।
আপনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হওয়ার স্মৃতি বলবেন?
মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটা আমি নিশ্চিত ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য। ১৯৬৬-তে ৬ দফা, তারপর ৬৯-এর মুভমেন্টে ১১ দফা আসলো। তখনই আমাদের কাছে ১ দফা এসে গেলো। সেটা হলো- বাংলাদেশ স্বাধীন হতেই হবে, কোন উপায় নেই। একটা মানসিক প্রস্তুতি ছিল। ১৯৭১ সালে ভাবলাম যে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবো। আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাকে বললেন যে চলো আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। আমার একটা লোক দরকার, তুমি আমার সঙ্গে চলো। তো আমি আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে আগরতলায় চলে যাই মে মাসে। তারপর কলকাতায় যাই। আমি গাফফার ভাইয়ের সঙ্গেই ছিলাম তার বাসায়। আমার মনে আছে ১৪ অগাস্ট আমি ‘জয়বাংলা' পত্রিকায় যোগদান করি। তারপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনেক কবিতা পড়েছি। তখন আমাকে ‘আকাশবাণী’ থেকে অনুরোধ করা হলো। আমি বললাম, বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ‘আকাশবাণীতে’ আমি কবিতা পড়বো না। আমি পড়িনি, তবে আমাদের মধ্যে অনেকে পড়েছে। হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় যে ১৫ খণ্ডে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র’ প্রকাশিত হয়েছে তার চর্তুথ খণ্ডে আমার বেশকিছু লেখা ছাপা হয়েছে।
‘শহীদের প্রতি’ কবিতায় আপনি লিখেছেন ‘তোমাদের যা বলার ছিল/ বলছে কি তা বাংলাদেশ?’। এই ‘তোমরা’ আসলে কারা? তারা কেন বলতে পারেনি?
এটা সব শহীদদের প্রতি আমার এক ধরণের শ্রদ্ধা। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম, আমরা সমস্ত শরীরটা দিতে চেয়েছিলাম স্বাধীনতার জন্য। যারা শহীদ হলেন তাদের তো একটা স্বপ্ন ছিল, আর কিছু নয়- বাংলাদেশ স্বাধীন হউক। পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশ ভূতের মতো উল্টোদিকে যাত্রা শুরু করেছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্টাইলে। পাকিস্তানের স্টাইলে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' নাম পাল্টে রাখা হলো ‘রেডিও বাংলাদেশ’। তখনই আমার এই কবিতা। বুদ্ধিজীবীদের ছেলেমেয়েরা তাদের পোস্টারে এটা ব্যবহার করলেন। ওই আবেগটাতো হৃদয়ভাঙ্গা, একদম টগবগে। আমরা রাজনৈতিকভাবে জিতেছি এতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু পাকিস্তানি মনোভাবপূর্ণ মানুষগুলোকে আমরা পরাজিত করতে পারিনি। বরং তাদের মানসিকতা আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে ঢুকে বসে আছে, এটা অস্বীকার করার জো নেই।
শিশু-কিশোরদের জন্য আপনার সব লেখা তিন খণ্ডে প্রকাশ করেছে ‘অনিন্দ্য’ প্রকাশনী। আপনার লেখালেখির বড় একটা অংশ জুড়েই আছে শিশু-কিশোররা। এখনকার শিশুরা গেজেট নির্ভর, এ পরিবর্তনটা আপনি কীভাবে দেখেন?
এ পরিবর্তন অনিবার্য, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা হবে। তাদের চিন্তা যে বাড়ছে, টেকনিক্যালি যে যোগাযোগটা হচ্ছে- এটা কিন্তু খুব বড় ব্যাপার। এই টেকনোলজি অ্যাভয়েড করার কোন কারণ নেই। শিশু-কিশোর কিংবা তরুণরা টেকনোলজির সঠিক ব্যবহার করুক- এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
এখন লিখছেন নতুন কিছু?
আমি গত তিন বছরে খুব একটা লিখতে পারছি না। একটা কাজ করেছি, ‘বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু' নামে একটা সংকলন। রাশিয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদ, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদ আর এখানকার এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্যোগে বইটা বের হয়েছে। আমাকে করা হয়েছে প্রধান সম্পাদক, উপদেষ্টা করা হয়েছে আবদুল গাফফার চৌধুরীকে। আমার চাইতে ড. নুরুন নবী, ড. আমিনুর রহমান সুলতান এবং এনআরবিসি ব্যাংকের যে প্রধান কর্তা অনেক বেশি খেটেছেন। এ কাজটা করতে পেরে অনেক ভালো লেগেছে। আব্বাকে যখন কবরে নামালাম আমাকে কবর থেকে তোলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হননি। ১৯৬৫ সালে, এগুলো আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব না। আমরা একসঙ্গে ভাত খেয়েছি বহু রাত। তিনি আমাদের বাসায় ছিলেন অনেক দিন। আমার একটা কথা বলার আছে কিশোর-তরুণদের প্রতি, আত্মসম্মানবোধ থাকলে নিজের ভাষাকে শ্রদ্ধা করবেই। এ আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে গেলে অনেককিছু হারিয়ে যায়। পঁচাত্তরের পর বাঙালি তার আত্মসম্মানবোধটা হারিয়ে ফেলেছে, এটা ফিরিয়ে আনতে হবে।