বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম কবির নাম ফররুখ আহমদ। তার ছড়া বা কিশোর কবিতা সুখপাঠ্য ও জনপ্রিয়। এখনো মুখে মুখে তার দুটো ছড়া কাটে শিশুরা, আমরাও আওড়াই।
Published : 18 Oct 2021, 02:51 PM
“ঝুমকো জবা বনের দুল /উঠল ফুটে বনের ফুল। /সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে, /ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে। /সেই দুলুনির তালে তালে, /মন উড়ে যায় ডালে ডালে।” -ঝুমকো জবা
“বৃষ্টি এল কাশ বনে/ জাগল সাড়া ঘাস বনে, /বকের সারি কোথা রে/ লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে। /নদীতে নাই খেয়া যে, /ডাকল দূরে দেয়া যে, /কোন সে বনের আড়ালে /ফুটল আবার কেয়া যে। /গাঁয়ের নামটি হাটখোলা, /বৃষ্টি বাদল দেয় দোলা, /রাখাল ছেলে মেঘ দেখে, /যায় দাঁড়িয়ে পথ-ভোলা। /মেঘের আঁধার মন টানে, /যায় সে ছুটে কোনখানে, /আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে /আমন ধানের দেশ পানে।” -বৃষ্টির ছড়া
কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিশু-কিশোর কবিতা লিখেছেন, তবে তার লেখা অন্যান্য কবিতার তুলনায় শিশু-কিশোর ছড়া-কবিতার ওপর খুব কম আলোচনা হয়েছে। তার লেখা শিশু-কিশোর কবিতার সংখ্যা মোট ২১। প্রকাশিত শিশুতোষ বই সাতটি।
কবি বেঁচে থাকতে প্রকাশ হয়েছে চারটি ছড়ার বই। অন্যান্যগুলো অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে। তার উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ বই- পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৭০), চাঁদের আসর (১৯৭০), ছড়ার আসর (১৯৭০) ও ফুলের জলসা (১৯৮৫)।
কবির প্রথম শিশুতোষ বই ‘পাখির বাসা’। এখানে সাতটি অনুচ্ছেদে ভাগ করে মোট পয়ত্রিশটি ছড়া-কবিতা আছে। ভাগগুলো হচ্ছে- পাখির বাসা, মজার ব্যাপার, পাখ-পাখালি, পাঁচ মিশালী, রূপ-কাহিনী, সিতারা ও চলার গান। ‘পাখির বাসা’ শিরোনাম অধ্যায়ে আছে পাখির বাসা, ঘুঘুর বাসা, বকের বাসা, প্যাঁচার বাসা, গাঙ শালিকের বাসা, বাবুই পাখির বাসা, চড়ুই পাখির বাসা ইত্যাদি ছড়া-কবিতা।
‘মজার ব্যাপার’ অনুচ্ছেদে আছে- মজার ব্যাপার, মজার কোরাস, মেলায় যাওয়ার ফ্যাঁকড়া, নরম গরম আলাপ, দূরের কীর্তি, দাদুর কিসসা ছড়া-কবিতা। ফররুখ আহমদ শিশুদের ঝিমিয়ে পড়া মনকে জাগিয়ে তোলার জন্য জিজ্ঞেস করছেন কোথায় তিনি মজা পাবেন। ‘মজার ব্যাপার’ কবিতার শুরুতেই বলছেন- “মজার ব্যাপার! মজার ব্যাপার! /কোথায় পাব মজার ব্যাপার? /চলছে-সব-ই সোজাসুজি /তাইতো মিছে খোঁজাখুঁজি /ভেবে ভেবে হদ্দ সবাই, /মজার ব্যাপার পাই কোথায় ভাই?” ‘মেলায় যাওয়ার ফ্যাঁকরা’ ছড়ায় লিখলেন মেলার পরিবেশ। শিশুদের অবস্থা- “বাপ্রে সে কী ধুম ধাড়াক্কা /দিচ্ছে ধাক্কা, খাচ্ছে ধাক্কা, গুঁতোর চোটে হয় প্রাণান্ত /হাঁপিয়ে ওঠে ক্যাবলা কাণ্ড! /লাগলো যখন বিষম তেষ্টা /ক্যাবলা করে ডাবের চেষ্টা। /তাকিয়ে দেখে পকেট সাফ, /ভিড়ের ভিতর দেয় সে লাফ।”
এমনভাবে ‘পাখ-পাখালি’ কবিতায়- পাখ পাখালি, টুনটুনি, কাঠঠোকড়া কুটুম পাখি, টিয়ে পাখি, ফিঙে পাখি, মাছ রাঙা, শীতের পাখি, ‘পাঁচ-মিশালী’ কবিতায় ঝড়ের গান, বৃষ্টির গান, বর্ষা শেষের গান, শরতের গান, শীতের গান, ফাল্গুনের গান, চৈত্রের গান ইত্যাদি নামের ছড়া আছে। অন্য তিনটি অংশেও মজার মজার ছড়া কবিতা আছে।
‘হরফের ছড়া’ ফররুখ আহমদের দারুণ একটি শিশুতোষ বই। প্রায় প্রতিটি বর্ণের বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন, ছন্দে ছন্দে। এগুলো এতোই সুন্দর ও আকর্ষণীয় যে শিশুরা এসব ছড়া পড়ে সহজেই বাংলা বর্ণমালা শিখতে পারে। যেমন: 'ই'-তে ইলিশ। এটির স্বাদ অতুলনীয় এবং আমাদের জাতীয় মাছ। শিশুরাও খুব পছন্দ করে ইলিশ।
ফররুখ লিখলেন এভাবে-
(১) ‘ই’ কয়: ইলশেগুড়ি/ ইলিশ মাছে ভরবে ঝুড়ি, /ইস্টিশানে মিষ্টি পান /ইলিশ কিনে গায় সে গান।’
(২) ‘ক’ আর ‘খ’ অক্ষর দিয়ে কবি শিশুমনে ঢুকে গেলেন। হারিয়ে গেলেন বন-বাদাড়ে, পাখি আর কলমিতে যা গ্রামবাংলার শিশুমনের চমৎকার উপাদান। তুলে ধরলেন শিশুদের কাছে- ‘ক’-এর কাছে কলমিলতা /কলমিলতা কয় না কথা /কোকিল ফিঙে দূর থেকে /কলমি ফুলের রঙ দেখে।’ ‘খ’-কে নিয়ে খেঁকশিয়ালী / যায় পালিয়ে কুমারখালী /পাখ-পাখালি খবর পেয়ে /খরগোসকে দেয় জানিয়ে।’
ঘোড়া শিশুদের প্রিয় প্রাণী। আর ব্যাঙ! কল্পনাতেও দেখে শিশুরা ঘোড়া। দাদি-নানির কাছে রূপকথাতে শিশুরা শোনে ঘোড়ার নাম। রাজকুমার চড়ে এতে। আর ব্যাঙের ডাক মাতাল করে শিশুদের। ‘ঘ’ আর ‘ঙ’ নিয়ে লিখলেন কবি দারুণ ছড়া-
(৩) ‘ঘ’-এ ঘোড়া এল যেই /খোঁড়া হল সকলেই, /কালো ধলো দুই ঘোড়া /দুয়ে মিলে এক জোড়া।’
‘ঙ’ জানে রঙ ঢঙ, /রঙ নিয়ে খেলা সঙ, /লিকলিকে সরু-ঠ্যাং /লাফ দেয় কোলা ব্যাঙ।’
ইঁদুর, কাঠ ঠোকরা, বিড়াল, দোয়েল বাদ যাবে কেন? ডুগডুগি বাজাতে কে না ভালোবাসে! এগুলো তো শিশুমনেই থাকে সবসময়। এগুলো নিয়ে মনে মনে গবেষণা করে শিশুমন। সেগুলোও ফুটিয়ে তুললেন কবি ‘ঞ’, ‘ঠ’, ‘ড’ ইত্যাদি বর্ণ দিয়ে।
(৪) ‘ঞ’-র পাশে মিঞ /বলছে ইঁদুর দিয়ো, /বলছে বিড়াল মিঞাউ, মিঞাউ /কাঁদলে কোলে নিয়ো।’
(৫) ‘ঠ’-এর মেজাজ খাট্টা কেন? /তোমরা কর ঠাট্টা কেন? /কাঠে কেন ঠোকর দিয়ে /কাঠ-ঠোকরা যায় পালিয়ে।’
(৬) ‘ড’-এর কাছে ডুগডুগি /বানর এসে দেয় উঁকি, /ডুগডুগিটা বাজাবে /বানরটা ফের নাচবে।’
‘পউষের কথা’ কবিতায় কবি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করলেন পৌষের চারদিকের অবস্থা আর অনুভূতির কথা। ‘উত্তরী বায় এলোমেলো /পউষ এল! পউষ এল! /হিমেল হাওয়ায় শিরশিরিয়ে /এল অচিন সড়ক দিয়ে, /মাঠ, ঘাট, বন ঝিমিয়ে গেলো; /পউষ এল! পউষ এল! /মাঠের ফসল আসলো ঘরে, /ধান দেখে ভাই পরাণ ভরে /কিষাণ-চাষীর মন ভরে যায় /গল্পে গানে; মিঠাই, পিঠায়, /গুড় পাটালির সোয়াদ পেলো; /পউষ এল! পউষ এল!’
বিভিন্ন রকমের পাখি, ঋতুর বৈশিষ্ট্য, শিশুদের নাড়া দেয় এমন উপাদান নিয়ে ফররুখ আহমদ লিখেছেন ছড়া ও কিশোর কবিতা। বর্ণমালার প্রায় সব বর্ণ নিয়ে লিখলেন নান্দনিক ও মাতাল করা সব ছড়া। মেঘবৃষ্টির ছড়া, বৃষ্টির ছড়া, পয়লা আষাঢ়, বর্ষার গান, ইলশে গুঁড়ি, শ্রাবণের বৃষ্টি, শরতের সকাল, হৈমন্তী সুর, পউষের কথা। প্রতিটি ছড়ায় বাংলা ঋতুর বিচিত্র বর্ণনা রয়েছে যা শিশুমনকে দোলা দেয়। এসব রূপালি ছড়া শিশুমনকে নাড়া না দিয়ে পারে না- ‘কাদা খোঁচা পাখি ভাই খায় কাদা খুঁচে /দিন শেষে পাখনার কাদা যায় মুছে...’।
শরত নিয়ে লিখলেন- ‘ঝিলমিল, ঝিলমিল, নীল /পরীদের ওই মনজিল।’ শরত শেষে হেমন্ত – ‘হিম শির শির হেমন্ত মাঠ /কাঠুরিয়া যায় কেটে কাঠ /রাত্রিশেষে ঝলমলে দিন /বেড়ায় মাঠে সোনার হরিণ।’ হেমন্তের শেষে এলোমেলো পউষ এলো। ‘পউষ এল /হিমেল হাওয়ায় শির শিরিয়ে, এল অচিন সড়ক দিয়ে...।’ মাঘের শীতে, মাঘ আসে, ‘আবছায়া কুয়াশার পাখা /ঢেকে ফেলে আসমান কালি ঝুলি মাখা...।’ আসে ফাল্গুন- ‘ফাল্গুনে শুরু হয় গুন গুনানি /ভোমরাটা গায় গান ঘুম ভাঙ্গানি...।’ শেষে আসে চৈত্রের কবিতা, ‘চৈত্র এল ফাগুন শেষে /ভয়ের সাড়া পড়ল দেশে /রঙিন পালক ধুলোয় ছুড়ে /দূরের পাখি পালায় উড়ে...।’
কবি ফররুখ আহমদ তার সাহিত্যচর্চার জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও পদক পান। ১৯৬৬ সালে শিশুতোষ বই ‘পাখির বাসা’ লিখে ইউনেস্কো পুরস্কার এবং একই বছর ‘হাতেম তায়ী’ বইয়ের জন্য পান আদমজী পুরস্কার। তার আগে ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট পদক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ পুরস্কার পান। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তাকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকায় কবি মারা যান।
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected]। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |