উড়ুক্কু সাপ ও পিরামিড রহস্য: শেষ কিস্তি

মুকুলের মাথা থেকে অদ্ভুত প্রাণীটা যাচ্ছে না। কেবল চোখের সামনে ভাসছে। এতই উত্তেজিত লাগছে যে আজ রাতে হয়ত ঘুমই আসবে না তার। নাহ্‌, মাথা থেকে জন্তুটাকে সরাতেই হবে।

অনুপম মুখোপাধ্যায়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Jan 2021, 04:49 AM
Updated : 18 Jan 2021, 04:49 AM

চমৎকার গরম গরম ডিম-টোস্ট নিয়ে এল ঝগড়ু। আর চা।

বড়মামা এমনভাবে টোস্টে কামড় দিলেন যেন তিনি সারাদিন না খেয়ে আছেন, যেন কিছুক্ষণ আগেই তিনি একটা অদ্ভুত প্রাণীকে মোটেই দেখেননি চোখের সামনে। ছোটমামাও বেশ ক্ষুধার্তভাবে খেতে শুরু করলেন। চোখের সামনে তাঁদের এমন নিশ্চিন্ত দেখে মুকুলও মন থেকে ঘটনাটা মুছে ফেলল, এবং খাবারে মন দিল।

চায়ে একটা জমিয়ে চুমুক দিয়ে বড়মামা বললেন, “এবার পিরামিডের ব্যাপারটা বল বুবাই। আমাকেও তো বলিসনি। সেই কবে থেকে বলবি বলবি করছিস।”

ছোটমামা হাসলেন, “খুব বেশি সময় লাগবে না, ঘটনাটা বলতে। কিন্তু রহস্যটা সত্যিই অদ্ভুত। অবিশ্যি আমি নিজে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।”

“আগে ঘটনাটা বল। মুকুল, মন দিয়ে শোন তো, তুই রহস্য সমাধান করতে পারিস কিনা।”

ছোটমামা বললেন, “আমরা মিশরের বিখ্যাত পিরামিডগুলোর কথা জানি, সেগুলোর ছবি দেখি, বিভিন্ন চ্যানেলের তথ্যচিত্রে সেগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখায়। কিন্তু তার বাইরেও অনেক পিরামিড আছে। ভ্যালি অব দ্য কিংস, যেখানে খ্রিস্টপূর্ব ষোলশ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব এগারশ অবধি তৈরি হওয়া সব বিরাট পিরামিড, সেখানকার বাইরেও পিরামিড আছে। সেগুলো নিয়ে খুব একটা মাতামাতি নেই। যদিও মিশরের ইতিহাস বুঝতে সেগুলো খুবই কাজে লাগে। তাদের তলাতেও আছে গোপন সমাধি।

যদিও সবচেয়ে সমস্যাটা হল হাজার হাজার বছরের মধ্যে সেসব গোপন কবর খুঁজে বের করে, ভেঙে, তছনছ করে দিয়েছে কবর লুণ্ঠনকারীরা। তাদের আটকানোর জন্য পিরামিড যারা বানাত তারা অনেক ফিকির করত, মূল সমাধিতে ঢোকার পথ জটিল করে বানানো হত, অভিশাপের ভয় দেখানো হত, মূল প্রবেশপথ সিল করে দেওয়া হত, কিন্তু কিছুতেই কিছু ফল হত না। মানুষের লোভের সামনে কোনোকিছুই কাজ করে না।”

মুকুল বলল, “তুতেনখামেনের সমাধিতে কিন্তু সবই পাওয়া গিয়েছিল।”

“হ্যাঁ। চোখ ধাঁধানো ঐশ্বর্য। আর সে কারণেই অভিশাপের গল্পটা অত ফলাও করে রটানো গিয়েছিল। অন্য ফারাওদের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।”

“মমির অভিশাপের গল্প কিন্তু আরো আছে। শোনা যায় টাইটানিক জাহাজ ডুবে যাওয়ার কারণও ছিল এক অভিশপ্ত মমি। ওই জাহাজে সেটা লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।”

বড়মামা বললেন, “বাহ্‌! কত খবর রাখিস রে মুকুল! কী রে বুবাই?”

“হ্যাঁ।” ছোটমামা হাসলেন, “ও এসব ব্যাপার অনেকটাই জানে দেখছি তো। আসলে ও ডিসকভারি চ্যানেলটা বেশ মন দিয়ে দেখেছে। সেখানে প্রায়ই আনেখসোনামুন, নেফ্রাতিতি, রামেশিস এসব নাম শোনা যায়। এগুলো এখন জনপ্রিয় কালচারের অন্তর্গত হয়ে গেছে। হাজার হাজার বছর আগেকার মৃত সব ফারাওরা এখন আমেরিকান চ্যানেলগুলোর দৌলতে সেলিব্রিটি, একেকজন পপস্টারের মতো তারা এখন সারা পৃথিবীতে।”

“যাই হোক, একটা কথা বোঝা যাচ্ছে, একদিন আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে এই ছেলে।”

মুকুল লজ্জা পেল, বলল, “গল্পটা বলো ছোটমামা।”

“গল্প কিছুই নয়। খুবই ছোট ঘটনা আগেই তো বললাম। কেবল রহস্যটা খুব অদ্ভুত।” ছোটমামা চা শেষ করলেন, এবং ধীরেসুস্থে বলতে শুরু করলেন, “একটা সাদামাটা পিরামিডের মূল্যও অপরিসীম হয় যদি তা অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। অর্থাৎ চোরেরা ঢুকতে পারেনি এমন একটা পিরামিড যদি পাওয়া যায়। সেখানে ঐশ্বর্য হয়ত খুব বেশি পাওয়া যাবে না, যেমন তুতেনখামেনের ক্ষেত্রে পাওয়া গিয়েছিল, তেমন কিছু মেলা মুশকিল। কিন্তু গবেষণার অনেক সুযোগ থাকবে। তো, এমনই একটা অখ্যাত ছোট পিরামিড পাওয়া গেল। সেটা নামেই পিরামিড বলা যায়, আসলে একটা সমাধির চেয়ে বেশি কিছু নয়।

কিন্তু সেটাতে ঢোকার মুখ এমনই একটা বিরাট পাথর দিয়ে আটকানো যে তা সরিয়ে চোরেরা ঢুকতে পারেনি হাজার হাজার বছরেও এটা স্পষ্ট বোঝা গেল। সবাই তো খুব উত্তেজিত। পাথর সরানো হল। ভিতরে নেমে দেখা গেল একটা অনাড়ম্বর সমাধির মধ্যে মমিটি রয়েছে, সম্ভবত সেটা কোনো রাজকন্যার মমি। তিনি যে কে, তা লিপির পাঠোদ্ধার করে বোঝা যাবে। কিন্তু, সবচেয়ে আজব ব্যাপার হল, কেবল মমিটিই আছে, আর কোনোকিছুই নেই, কয়েকটা মাটির পাত্র, তাও ভাঙা, পড়ে আছে কেবল।”

বড়মামা বললেন, “তার মানে চোর ঢুকেছিল।”

“হ্যাঁ। কিন্তু কোন পথে?”

“ওই পাথর দিয়ে আটকানো পথ ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নিশ্চয়ই আছে!”

ছোটমামা মাথা নাড়লেন, “কিছু নেই। ওই একটাই পথ। এবং সে পথে কেউ ঢোকেনি।”

বড়মামা একটু ভেবে বললেন, “তাহলে নিশ্চয়ই ওই রাজকন্যাকে কেবল সমাধিই দেওয়া হয়েছিল, গয়নাগাঁটি বা বাসনকোসন কিছু রাখা হয়নি।”

ছোটমামা হাসলেন, “কেন? রাজকন্যা গরীব ছিল?”

“না। রাজকন্যারা গরীব হয় না। কিন্তু, হয়ত সবাই এত শোকাহত হয়েছিল যে, জিনিসপত্র ভুলে গিয়েছিল। পাথর দিয়ে রাস্তা আটকে দেওয়ার পর সবার খেয়াল হয়। তখন আর পাথর সরানো হয়নি ওসব রাখতে।”

“সেটা অসম্ভব। সমাধি তো পরিবারের লোকেরা দিত না। সেটা দিত পেশাদার লোকেরা। পুরোহিতরা নির্দেশ দিত সবকিছু কীভাবে হবে। শোক যতই গভীর হোক, তাদের রীতি আর আচার থেকে মিশরীয়রা সরে আসবে কেন? তাছাড়া ভুলে যাচ্ছ, রাজকন্যার শবদেহকে মমি বানানো হয়েছিল, এবং সেটা বেশ দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া। সেটার পরে সমাধিতে অমন অস্বাভাবিকতা ভাবা যায় কি?”

“তা ভাবা যায় না। তোর কী মনে হয় মুকুল?”

মুকুল চিন্তা করছিল। একটু পরে বলল, “আমার মনে হয় দামি যেসব জিনিসপত্র গয়নাগাঁটি সেসব অবশ্যই সমাধিতে ছিল।”

“তাহলে সেগুলো গেল কোথায়?”

“ওই পাথর দিয়ে রাস্তা আটকানোর আগেই সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ, চুরি করা হয়েছিল।”

“অর্থাৎ চুরিই করা হয়েছিল, এবং সেটা কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়, তাই তো?” ছোটমামার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি সবেগে ঘাড় নেড়ে বললেন, “বেশ! বেশ! এটা যে তুই ভাবতে পেরেছিস, এটাই দারুণ ব্যাপার। কিন্তু চুরিটা করবে কে? সমাধি যতই সাধারণ পিরামিডে হোক, ওই রাজকন্যা নিশ্চয়ই খুব শক্তিশালী পরিবারের মেয়ে। তার সমাধি থেকে চুরি করলে তো গর্দান যেত, তাই না? তাছাড়া কেউ জানতে পারল না, রাস্তাটা পাথর দিয়ে আটকানোর আগে?”

মুকুল বলল, “যারা জানতে পারত, তারাই যদি চুরিটা করে?”

“সাবাশ!” লাফিয়ে উঠলেন ছোটমামা, “অর্থাৎ তুই বলছিস সর্ষের মধ্যেই ভূতটা ছিল। দেখেছ দাদা, একদম আমি যেটা ভেবে বের করেছি, সেটাই বলেছে।”

বড়মামা হতচকিত মুখে বললেন, “সে বুঝতে পারছি। কিন্তু বুবাই, মুকুল আমাকে অবাক করে দিচ্ছে। কী বুদ্ধি রে এইটুকু ছেলের! তবে, বুবাই, ওই চুরি কারা করেছিল, আমি এখনও বুঝতে পারছি না! রাজকন্যার পরিবারের লোকেরাই কি ওসব সরিয়ে ফেলেছিল?”

“তা কেন?”

“হয়ত তারা কৃপণ ছিল। কিংবা অর্থাভাব হয়েছিল। সবসময় তো অবস্থা সমান যায় না।”

ছোটমামা এটা শুনে হেসে ফেললেন, তারপর মুকুলের দিকে ফিরলেন, “তুইই বল মুকুল। দেখি কী বলিস।”

মুকুল চিন্তিত মুখে বলল, “আমার মনে হয় ছোটমামা, যারা সরিয়েছিল তারা পরিবারের লোকেদের সমাধিতে আসতে দেয়নি। তারাই দায়িত্বে ছিল অন্ত্যেষ্টির পুরো কাজটা করার।”

“তারা কারা?”

“পুরোহিতরা।”

“সাবাশ! জিও বেটা!”

বড়মামা কপালে হাত দিলেন, “মাই গড! তখনকার দিনেও মানুষ এত অসৎ ছিল!”

ছোটমামা হাসলেন, “মানুষ চিরকাল মানুষই ছিল দাদা, আর মানুষ হয়েই থাকবে। আজ যা আছে তা হাজার হাজার বছর আগেও ছিল, হাজার বছর পরেও থাকবে।”

“তাই তো দেখছি! কিন্তু মুকুলের বুদ্ধিটা একবার ভাব! এ ছেলে তো ডিটেকটিভের কান কেটে দেবে রে!”

মুকুলের হাসি পেয়ে গেল বড়মামার উচ্ছ্বাসে।

জানলা দিয়ে টিলাটা দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে আরো গাঢ় অন্ধকার জমিয়ে সেটা দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় প্রচুর ঝিঁঝিপোকা ডাকে। বাইরে অনেক জোনাকি উড়ে বেড়াচ্ছে। দু-একটা জানালা দিয়ে ঢুকেও পড়েছে, ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন সেই সাপটা কী করছে? হয়ত যেখানে তারা সেটাকে বিকালে দেখেছিল, সেখান থেকে সাপটা অনেক অনেক দূরে চলে গেছে এখন। হয়ত কিছুটা বুকে হেঁটেছে, কিছুটা হয়ত উড়েও গেছে, হয়ত সাপটা ভালই উড়তে পারে।

বড়মামা ঠিকই বলেছেন। বাইরে লোকজন ডেকে এনে সাপটাকে বন্দি করার চেষ্টার কোনো মানেই হয় না। হয়ত পৃথিবীতে তাহলে আর কোনোদিন উড়ে বেড়ানো সাপের গল্পও শোনা যাবে না। সাপ যে উড়ে বেড়ায়, সেই কল্পনাটা নষ্ট হয়ে যাবে।

মুকুল বুঝতে পারছিল তার বুকের মধ্যে থেকে ভয়-টয় সব দূর হয়ে গেছে। এখন যদি সে কলকাতায় ফিরেও যায়, ভয়টা আর তার নাগাল পাবে না। রহস্যের আড়ালে যে ঘটনাটা থাকে, তা হয়ত খুবই সাধারণ, একবার তার নাগাল পেলে বোঝা যায় ধোঁয়ার তলায় একচিলতে আগুনের চেয়ে বেশি কিছুই সেই রহস্যটা ছিল না। মুকুল এখন বুঝতে পারছে, ভয়ের তলাটা একেবারেই ফাঁকা, ভয়ের নিচে কিছু আজগুবি ধারণা ছাড়া প্রায়ই কিছু থাকে না, ভয়কে একটা ধাক্কা দিতে পারলেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এটা সে বিকালে ওই প্রাণীটাকে দেখতে না পেলে বুঝতে পারত না, আর বাকি সাহায্য করল ছোটমামার পিরামিড রহস্য।

কত অনায়াসে ভয়টাকে ওই জানলার বাইরে ফেলে দিল মুকুল, আর সেটা মিলিয়ে গেল অন্ধকারে! এখন তো তার মনজুড়ে ফুর্তি!

এই ফুর্তিটাই যেন হারিয়ে গিয়েছিল। তার মামারা তাকে খুঁজে দিয়েছেন।

একটু পরে ঝগড়ু এসে জানিয়ে গেল একটু আগেই একজন সাঁওতাল দেশি মুর্গি দিয়ে গেছেন। আজ রাতে জমজমাট মুর্গির ঝোল আর ভাতের ব্যবস্থা হচ্ছে।

মুকুল মজা করে জিভে জল টানল- ‘ইল্লুস!!!!”

আগের কিস্তি

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!