উড়ুক্কু সাপ ও পিরামিড রহস্য: তৃতীয় কিস্তি

মুকুল বলল, “ছোটমামা, সেই পিরামিডের ব্যাপারটা এখনই বলো না!”

অনুপম মুখোপাধ্যায়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Jan 2021, 03:01 PM
Updated : 2 Jan 2021, 03:01 PM

“উঁহু। এখন নয়। সবকিছুর একটা সময় থাকে। পরিবেশ থাকে।”

মুকুল জানে উনি ঠিক বলেছেন। দূরে টিলাটা এখন দেখা যাচ্ছে, গাছপালার ফাঁক দিয়ে। টিলাটার গায়ে এখন সন্ধ্যা গড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে আরেকটু হাঁটলেই টিলার তলায় যেন পৌঁছে যাওয়া যাবে। কিন্তু তা নয়। টিলার কাছে পৌঁছতে হলে অন্তত এক ঘণ্টা পা চালাতে হবে।

পাহাড়ের নিয়ম হল তাকে দূর থেকে কাছের দেখায়। কাছে গেলে বোঝাই যায় না তার তলায় পৌঁছে যাওয়া গেছে। প্রথম যেবার মামাবাড়ি এসেছিল, তখন সে একেবারেই ছোট, তখনই অবিশ্যি এটা জেনে গিয়েছিল মুকুল।

এটা নাকি বড় মাপের মানুষদের ক্ষেত্রেও সত্যি, বড়মামা বলেছিলেন সেবার, এখনও মনে আছে। যাঁরা মনীষী, মানুষ তাঁদের দূর থেকেই কাছের করে পায়। দূর থেকেই তাঁদের প্রণাম জানানো ভাল, আর কাছ থেকে ভাল করে বুঝে নেওয়া দরকার তাঁদের কাজের পরিধি।

এসব ভাবতে শুরু করলে মুকুলের আর মন খারাপ থাকে না। মামাবাড়িতে এসে সত্যিই কাজ হয়েছে। আর তার ভয় করে না। ভয়টা যেন কলকাতাতেই রেখে এসেছে মুকুল। ফিরে গিয়েও আর সেটাকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে না সে। খুঁজতেও চায় না মুকুল।

আর ঠিক তখনই বড়মামার গুনগুনিয়ে করা রবীন্দ্রসঙ্গীত থেমে গেল।

তিনজনেই দাঁড়িয়ে পড়লেন কাঠ হয়ে।

তাঁদের সামনে একটি অদ্ভুত প্রাণী উপস্থিত হয়েছে।

এক মস্ত সাপ। সামনের রাস্তাটি পার হচ্ছে। ময়াল সাপের মতো বড়। হয়ত ময়াল সাপই। এই অঞ্চলে বেশ কিছু ময়াল আছে। কিন্তু সাপটার রং ঝলমলে সোনালী। ডুবতে বসা সূর্যের আলোয় তার গায়ের আঁশগুলো ঝলমল করছে। এমন রঙের ময়াল হয় না।

সাপটার দুটো মাথা। দুটো মাথা তুলেই সাপটা তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। মুকুলের মনে হচ্ছিল যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে দুটো মাথা।

আর, সবচেয়ে আশ্চর্য, সাপটার মাথা থেকে একটু পরে, শিরদাঁড়ার দুদিকে দুটো বেশ বড় মাপের ডানা, প্রায় রাজহাঁসের ডানার মতো বড়, এবং সেগুলোর রং আরো উজ্জ্বল সোনালী।

সাপের ডানা হয়! দুটো মাথা হয়!

সাপটা যেন সোনালী রাজহাঁস আর সোনালী ময়াল সাপের মিলিত একটা রূপ নিয়ে তাদের সামনে এসেছে।

একটু পরেই বিশাল শরীরটা নিয়ে সাপটা রাস্তা পার হয়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল।

তাঁর তিনজন তখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে।

মুকুলই প্রথম কথা বলল, “ওটা কী?”

তার গলা শুকিয়ে গিয়েছে।

বড়মামা চুপ করে থাকলেন। ছোটমামা বললেন, “জানি না। এমন কোনো প্রাণীর কথা তো জীবনেও শুনিনি! এ অঞ্চলের লোকেরাও তো এ নিয়ে কিছু বলে না! তাই না দাদা?”

বড়মামা মাথা নাড়লেন। বললেন, “এমন কোনো প্রাণীর বাস এ এলাকায় থাকলে অনেক কিংবদন্তির জন্ম হত। আমার মনে হয় আমাদের আগে কেউ একে দেখেনি। কিংবা, কেউ কেউ দেখলেও সে কথা জানায়নি।”

মুকুল জিগ্যেস করল, “কোনো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী?”

“হতে পারে। বনের মধ্যে কোথায় কী আছে, আজও তো কেউ জানে না। কতটুকু আর মানুষ আজও দেখতে পেয়েছে। এই জঙ্গল লক্ষ বছর আগেও তো ছিল!”

ছোটমামা বললেন, “অনিমেষকে কি জানানো উচিত?”

“তোর সেই প্রাণীতত্ববিদ বন্ধু?”

“হ্যাঁ। ও এখন শিকাগো থেকে ফিরেছে। মুম্বাইতে আছে।”

“জানাতে পারিস। একটা ফোন করার তো মামলা। কিন্তু আমার মনে হয় না জানানোটাই ভাল। হয়ত একপাল লোকজন এসে হাজির হবে, এই প্রাণীটাকে আর খুঁজেই পাবে না, কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীদের শান্তি নষ্ট করে দিয়ে যাবে। গাদাগুচ্ছের নিউজ চ্যানেল হাজির হবে। আমাদেরও জিনা হারাম হয়ে যাবে।”

“কিন্তু এমন একটা অদ্ভুত জীব...”

“তুই এটা কেন ভাবতে পারছিস না যে হয়ত আমাদের কপালে ছিল বলেই আমরা দেখা পেয়েছি, অন্যদের সেই অভিজ্ঞতার ভাগ না দিতেও পারি আমরা! একটু আগে বললাম কিংবদন্তির কথা। দ্যাখ, বুবাই, এমনও তো হতে পারে আমরা ছাড়াও অনেকে দেখেছে, এই বনের বাসিন্দারাই দেখেছে, কিন্তু কেউ আজও বলেনি। কারণ তারা ভিতর থেকে জানে জীবনের সব দেখা আর সব শোনা ফাঁস করতে নেই।”

“হয়ত ঠিকই বলছ দাদা।”

“এবং এখানে আর না দাঁড়িয়ে চল বাড়ি ফিরে যাই। এই প্রাণীকে দেখার ফল, আমার ধারণা মঙ্গলজনক হবে।”

বাড়ি ফেরার রাস্তায় আর সেভাবে কোনো কথা হল না।

মুকুলের চোখের সামনে প্রাণীটা ভাসছিল। কোনো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী? গ্রহান্তরের জীব? কাউকে কিছু না জানানোটা কি ঠিক হবে? তারা তো বনবাসী নয়, তারা সভ্য মানুষ। এই প্রাণীর খবর পেলে হয়ত বিজ্ঞানের একটা দিগন্ত খুলে যাবে। হয়ত এই অঞ্চলে একটা বিপুল পরিবর্তনও আসতে পারে। যেমন লকনেস মনস্টার স্কটল্যান্ডে বা বিগ ফুট উত্তর আমেরিকায়।

মুকুল সেটা বলার পরে বড়মামা বললেন, “তোর ইয়েতির কথা মাথায় এল না?”

“হ্যাঁ। ইয়েতিও। হয়ত এই অঞ্চলটা বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যেত।”

“তাতে কী হত? এই নির্জন অঞ্চলটা যে আদৌ বিশ্ববিখ্যাত হতে চায়, এই অঞ্চল কি তোকে এমন কোনো আভাস দিয়েছে? সে হয়ত এমন নির্জন থাকলেই ভাল থাকবে! ইয়েতির খোঁজ করার নামে কত জালিয়াতি হয়েছে তুই জানিস না? আজ তো সত্যি আর মিথ্যে আলাদা করাই যায় না! একই ব্যাপার হয়েছে লকনেস মনস্টার আর বিগ ফুটের ক্ষেত্রেও। কী দরকার এই যে অঞ্চলটা হাজার হাজার বছর নিরুপদ্রবে আছে, সেখানে বিজ্ঞানের নামে উৎপাত বাড়িয়ে?”

ছোটমামা বললেন, “মুকুল হয়ত ভাবছে এসব বলার মানে পিছিয়ে পড়া।”

“না। তেমন কেন ভাববে? আমাদের ভাগ্নে ও। শোন মুকুল, এ পিছিয়ে যাওয়া নয়। বলতে পারিস পিছনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এই ঘটনাটা আমাদের তিনজনের মধ্যেই থাক। তুই কিন্তু তোর বাবা-মাকেও কিছু বলবি না।”

মুকুল বুঝতে পারছিল না তার মামারা কেন ব্যাপারটা চাপা দিতে চাইছেন। এঁরা কি ঝামেলা এড়াতে চাইছেন?   

ছোটমামা বললেন, “তুই খুশি নোস জানি। আচ্ছা বাড়ি ফিরে আমি তোকে পিরামিডের ব্যাপারটা বলছি, যেটা বলব বলেছিলাম তখন। সেটা থেকেই বুঝবি কেন আমাদের এই ব্যাপারে চুপচাপ থাকাই ভাল।”

মুকুল মনে মনে ভাবল হয়ত ছোটমামা পিরামিডের কোনো অভিশাপের কাহিনিই বলবেন। পিরামিডের মধ্যে মমি, সেই মমি আসলে হাজার হাজার বছর আগেকার সম্রাট, সম্রাজ্ঞী, রাজপুত্র, রাজকন্যাদের ওষুধ দিয়ে সংরক্ষিত করা মৃতদেহ, আর সেই মৃতদেহ ঘিরে আছে রোমহর্ষক সব অভিশাপের ব্যাপার। এসব মুকুল অনেক পড়েছে। ডিসকভারি আর ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল থেকে এসব নিয়ে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি আছে, সেগুলো এখন ইউটিউবেও পাওয়া যায়।

ফারাও তুতেনখামেনের মমিকে ঘিরে যে অভিশাপের গল্প সে তো অনেকেই জানে।

তিন হাজার বছর আগে এই তুতেনখামেন নামক কিশোর ফারাওটির মৃত্যু কী করে হয়েছিল, আজও কেউ জানে না। হত্যা করা হয়েছিল, যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন, অসুখে মারা গিয়েছিলেন, এই তিনটের মধ্যে যে কোনো একটা হতে পারে। লর্ড কার্নারভন নামে যে সাহেব ১৯২২-এ তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পিছনে টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তিনি কয়েকদিনের মধ্যেই নিজে হঠাৎ মারা যান, এবং যে সময় কার্নারভন মারা যান, ঠিক সেই একই সময়ে লন্ডনে তাঁর কুকুরটি মারা যায়।

মমিটি আবিষ্কার করেছিলেন হাওয়ার্ড কার্টার। তিনি বিখ্যাত ডাকসাইটে প্রত্নতত্ববিদ ছিলেন। কার্টারই ইন্ডিয়ানা জোনসের চরিত্রের পিছনে আসল লোক বলতে হয়। কার্টার সাহেবকে টিনটিনের কাহিনিতেও দেখা গেছে। কার্টার অবিশ্যি দিব্যি বেঁচেছিলেন। কিন্তু এমন একটা গুজব রটিয়ে দেওয়া হয় যেন যে দলটি তুতেনখামেনের সমাধি খুঁজে বের করেছিল, তাদের সকলেই নাকি রহস্যময়ভাবে মারা গেছে। অথচ প্রথম দশ বছরে মাত্র দুজনের মৃত্যু হয়েছিল ওই দলের, এবং সেটাও খুব স্বাভাবিক মৃত্যু।

মমি ঘিরে অভিশাপের ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, তখনকার মিডিয়ার খবরের কাগজ বিক্রি করার ফিকির। যেমন এখনকার নিউজ চ্যানেলগুলো করে থাকে।

আজ বিকালে তারা যে বিচিত্র প্রাণীটি দেখল, একবার গন্ধ পেলেই সবগুলো নিউজ চ্যানেল ঝাঁপিয়ে পড়বে। যদি মুকুলের মামারা এমন নির্লোভ না হতেন, সেই ফাঁকে তাঁরাও বেশ বিখ্যাত হয়ে যেতে পারতেন।

বসার ঘরে এসে সবাই আরাম করে বসলেন। এই ঘরে একটা ফায়ারপ্লেস অবধি আছে। এটা বড়মামার খেয়াল। এই মুহূর্তে গরম। এখন বোঝাই যাবে না শীতকালে এখানে কেমন হাড় কাঁপানো ঠান্ডা পড়ে। তখন ওখানে আগুন জ্বালানো হয়। অবিশ্যি এই ফায়ারপ্লেসের চিমনির ব্যবস্থা করতে গিয়ে দোতলার ছাদের প্রায় বারোটা বাজতে বসেছিল। পুরনো ছাদ, সে ধকল নিতে পারেনি। কোনোমতে রক্ষা করা গেছে। এখন অবিশ্যি ছোটোমামাও ফায়ারপ্লেসটা নিয়ে বেশ খুশি। মুকুলের দুই মামাই খুব কল্পনাপ্রবণ। অবিশ্যি এঁদের বোন, অর্থাৎ মুকুলের মা, খুবই বাস্তববাদী। এজন্যই তিনি কর্পোরেট চাকুরে। আর এঁরা শুয়ে বসে অলস জীবন কাটাচ্ছেন।

কে বেশি ভাল আছে, এই প্রশ্ন মুকুলের মনে জাগে। হয়ত তার দুই মামা একরকম ভাল আছেন, আর তার মা আরেকরকম ভাল। যে যার জগতে খুশি থাকলেই হল। 

চলবে…

আগের কিস্তি

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!