উড়ুক্কু সাপ ও পিরামিড রহস্য: প্রথম কিস্তি

বড়মামা বলেন দূরের সমুদ্র থেকে যে হাওয়া আসে, সে হাওয়া যত দূর দেশ অবধিই যাক, তাতে তারামাছ আর প্রোটোজোয়ার গন্ধ লেগে থাকে। আর ওই টিলাটা থেকে যে গরম হাওয়া গ্রীষ্মের দুপুরে পর্দা ঠেলে জানলার কাচ ঝনঝনিয়ে ঢুকতে চায় মাঝে মধ্যে সেটার মধ্যে স্পষ্ট ভাল্লুকের গন্ধ পেয়েছে মুকুল।

অনুপম মুখোপাধ্যায়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2020, 06:23 AM
Updated : 15 Dec 2020, 06:23 AM

যেন হাওয়াটাই জমাট বেঁধেছে একটা ভাল্লুকের আদলে, তার চোখ, তার থাবার নখ, তার কর্কশ লোম, সব নিয়ে দুহাত তুলে এগিয়ে আসছে একটা হাওয়া, একা থাকার সময় ঘরে গরম হাওয়া ঢুকলে এমনই মনে হয়েছে মুকুলের কয়েকবার। ঝাড়খণ্ডের এই মালভূমি অঞ্চলে সে যে এই প্রায় এক সপ্তাহ আছে, মামাবাড়িতে, এর মধ্যে তার চিন্তাভাবনাই অনেক বদলে গেছে। দেখার চোখ বদলে গেছে। কলকাতায় থাকার সময়কার চোখ আর মন মুকুলের আর নেই।

মুকুল ক্লাস নাইনে পড়ে। কলকাতায় থাকতে মুকুলের খুব শরীর খারাপ হয়েছিল। সেরে উঠেছিল তাড়াতাড়িই। কিন্তু মনের মধ্যে ভয় রয়ে গেছে। আজকাল কেবলই মুকুলের মনে হয় তার যদি আবার শরীর খারাপ করে! কেবলই মনে হয় শরীরটা যেন ঠিক নেই, কোথায় যেন কী যখন তখন বিগড়ে যেতে পারে। একজন সাইক্রিয়াটিস্টকে দেখানো হয়েছিল, তিনি কোনো ওষুধ দেননি, মুকুলকে কিছু কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন আর তার বাবা-মাকে বলেছেন মুকুলকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে।

বাবা আর মা দুজনেরই কোনো সময় নেই, সবসময় ব্যস্ত তাঁরা। সেজন্যই স্কুল থেকে ছুটি করিয়ে বাবা-মা তাকে ঝাড়খণ্ডের এই পাহাড়ি জায়গাটায় পাঠিয়ে দিলেন, তার মামাবাড়ির দেশ যেটা। দাদু আর দিদিমা বেশ কিছুদিন মারা গেছেন। ঝগড়ু নামে একজন স্থানীয় লোক বাড়িটার দেখাশোনা করে।

এই মুহূর্তে তার দুই মামাই বাড়িতে আছেন, এটা সুবিধা।

বড়মামা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, জমানো টাকাতেই তাঁর চলে যায়। ছোটমামা মুর্শিদাবাদের একটা কলেজে ইতিহাস পড়ান, মুকুল আসবে শুনে লম্বা ছুটি নিয়ে চলে এসেছেন। দুজনই বিয়ে করেননি। বাড়িতে এখন মুকুল আর তার দুই মামা। এখানে আসার পর থেকে মুকুলের ভয়টা অনেক কমে গেছে। তবু মাঝে মধ্যে কামড়ায় ভয়টা। তখন তার মুখ শুকিয়ে যায়, কেমন যেন দম আটকে আসে। তবে দুই মামা মিলে সেটাকে আর চেপে বসতে দেন না। দুজনে খুব ভাল নজর রাখেন তার উপর। যখনই বোঝেন তার মনটা একটু খারাপ হয়ে আসছে, হইচই জুড়ে দেন, বা একটা গল্প বলতে শুরু করেন।

বড়মামা বললেন, “আমাদের এক দূর সম্পর্কের পিসিমা ছিলেন। তাঁর ছিল খুব অসুখের ভয়। তোর মা তোকে তাঁর গল্প বলেছে মুকুল?”

মুকুল জানলা থেকে দৃষ্টি ফেরাল। তার এখন বাইরে তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করছিল। টিলাটা এই খাঁ খাঁ রোদের মধ্যে কেমন যেন জেদি আর রাগী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর গায়ে যত ঝোপজঙ্গল গাছপালা আর অজস্র পাথর, সব মিলিয়ে কেমন যেন মনে হচ্ছে একটা শেকলে বাঁধা দৈত্য ওটা। চাইছে লোকালয়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে, সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিতে, কিন্তু পারছে না।

বাবা একবার বলেছিল পুরাণে না কি আছে একসময় পৃথিবীর সব পাহাড় পর্বতের ডানা ছিল। তারা যেখানে সেখানে উড়ে যেত, আর চেপে বসে লোকালয় ধ্বংস করে দিত। তাই ইন্দ্র বজ্র দিয়ে তাদের ডানা কেটে দিয়েছিলেন। এই টিলাটারও কি একসময় ডানা ছিল? ডানা কেটে যাওয়ার কষ্ট আর দুঃখ কি ভুলতে পেরেছে টিলাটা? পাহাড় পর্বতদের তুলনায় কত ছোট এই টিলা, এর ডানা হয়ত বেশ কচি ছিল, বজ্রের ছোঁয়া লাগতেই কেটে পড়ে গিয়েছিল। খুব একটা ব্যথা হয়ত লাগেনি।

বড়মামা বললেন, “আমাদের সেই পিসিমা, মানে তোর সম্পর্কে তো দিদিমাই হবেন তিনি, থাকতেন লক্ষ্ণৌ শহরে। তাঁর প্রচুর টাকাপয়সা ছিল। বিধবা ছিলেন। লক্ষ্ণৌ তো দুর্দান্ত শহর। তোর ছোটমামা আরো ভাল বলতে পারবে। আমি জানি গোমতী নদীর তীরে শহরটা গড়ে উঠেছে। শোনা যায় সেই রামায়ণের লক্ষ্মণের আমল থেকে। তখন নাম ছিল লক্ষ্মণাবতী। পরে মুসলমান আর ব্রিটিশ যুগে অন্য চেহারা নিয়েছে লক্ষ্ণৌ। সঙ্গীত আর আদবকায়দার শেষ কথা বলতে পারিস ওখানেই বলা হত এক-দেড়শ বছর আগেও। আর স্থাপত্য যদি দেখতে হয় তো ও শহরে যেতে হবে। আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার তো। আমি বলছি বড়া ইমামবড়া, ছোটা ইমামবাড়া, দিলখুশা কুঠি, রেসিডেন্সি, ভুলভুলাইয়া এসব দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে।”

মুকুল হাসতে হাসতে বলল, “ইমামবড়া দেখে ছানাবড়া?”

“হে হে... ঠিকই বলেছিস। ভাবলেই কেমন  খিদে পেয়ে যায়, না? তা আমাদের পিসেমশাই লক্ষ্ণৌয়ে রেস্তোঁরার ব্যবসা করতেন। অনেক টাকাপয়সা করার পর ফুড পয়জনিং-এ মারা যান।”

কথাটা শুনেই মুকুলের আরো হাসি পেয়ে গেল, “নিজের রেস্তোঁরার খাবার খেয়েই না কি?”

বড়মামা এটা শুনে একটু চিন্তা করলেন, তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “সম্ভবত না। যতদূর মনে হয় পিসেমশাই নিরামিষ খেতেন। ওঁদের কৃষ্ণভক্ত পরিবার। অবিশ্যি বিদেশে গিয়ে পারিবারিক আচারবিচার কতটা মানতেন বলা যায় না। যাই হোক। তবে ওঁর সম্পর্কে ভাল কথা ভাবাটাই আমাদের ভাল। কথা তো হচ্ছিল পিসিমাকে নিয়ে।”

“তাঁর খুব অসুখের ভয় ছিল।”

“হ্যাঁ। সে যে কী ভয় তুই চিন্তাই করতে পারবি না। পিসীমা সারাদিন একটা অন্ধকার ঘরে বিছানাতে শুয়ে থাকতেন। জানালার পর্দা দিয়ে একটু দিনের আলো ঢুকত ঘরে, সারা ঘর কেমন আবছায়া হয়ে থাকত। একজন পরিচারিকা ছিল, তার কাজ কেবল তাঁর দেখাশোনা। উনি সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে চিন্তা করতেন আগের দিনটার চেয়ে ভাল বোধ করছেন, না কি খারাপ। সেটা বুঝে নিয়ে বাকি দিনটা চলতেন। পিসীমার কাছে বাইরের লোকেরা খুব একটা আসত না। যখনই কেউ আসত, উনি তাকে নিজের শরীরের কথা বলতেন। সে বেচারা বুঝে উঠতে পারত না কী বলবে। এমনিতে পিসীমাকে দেখে মনেই হত না ওঁর কোনো অসুখ আছে, অন্তত অমন দিনের পর দিন বিছানায় শুয়ে থাকার মতো অসুখ তো থাকার কথাই নয়, ওঁর স্বাস্থ্য এতই চমৎকার ছিল। কেউ যদি বলত উনি বিছানায় শুয়ে থেকেই ঠিক করছেন, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভগবানের নাম করাই ওঁর ভাল, কারণ বলা যায় না কখন কী হয়ে যায়, সে ওঁর কাছে অপ্রিয় হয়ে যেত, তার ওঁর বাড়িতে ঢোকাই যেত বন্ধ হয়ে। আবার কেউ যদি বলত ওঁর কিছুই হয়নি, বরং দুপুরবেলা মাংসের ঝোল ভাত খেয়ে বিকালে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে আসতে পারলেই উনি ভাল হয়ে যাবে, উনি তার উপরেও চটে যেতেন, তারও আর ওঁর বাড়িতে আসার উপায় থাকত না।”

“কী মুশকিল রে বাবা!”

বড়মামা গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “খুবই মুশকিল। ওঁর সামনে বসে কথা বলাই ছিল মুশকিল। কোন কথার কোন মানে বের করবেন, সেটা ভেবে কাঁটা হয়ে থাকতে হত।”

“তুমি যেতে ওঁর কাছে?”

“নাহ্। আমাকে তেমন পছন্দ করতেন না। ওঁর বিছানার পাশে একটা বয়ামে লজেন্স রাখা থাকত। ওঁর নিজের জন্যই। একবার আমি উনি যখন ঘুমোচ্ছেন, একমুঠো তুলে নিয়েছিলাম। সেই থেকে আমাকে আর দু চক্ষে দেখতে পারত না বুড়ি। লজেন্সটা কথা নয়। কেউ ওই বয়ামে হাত দেবে সেটাই ওঁর বরদাস্ত হবে না। তবে তোর ছোটমামাকে খুব পছন্দ করতেন। ছোটমামা শান্তশিষ্ট থাকত। বই ছাড়া কিছু তো বোঝেইনি জীবনে! পিসীমা ওকে বই পড়ে শোনাতে বলতেন মাঝেমধ্যে।”

“এভাবেই থাকলেন পিসীমা।”

“এভাবেই চলত। কিন্তু একটা ঘটনা হল। একদিন ঘুমের মধ্যে খাট থেকে পড়ে গেলেন। আর তারপরেই ওঁর শরীর একদম ঠিক হয়ে গেল।”

“কী করে?”

কখন যে ছোটমামা এসে ঘরে ঢুকেছেন মুকুল আর বড়মামা খেয়ালই করেননি।

উত্তরটা ছোটমামাই দিলেন, “সেদিন পিসীমার কোমরে খুব লাগল। আর উনি বুঝতে পারলেন আসল যন্ত্রণা কাকে বলে। এতদিন যেগুলোকে উনি শরীরের ব্যথা আর যন্ত্রণা ভাবছিলেন, সেগুলো ছিল নকল, সেগুলো সবই ছিল ওঁর কল্পনা করা যন্ত্রণা। উনি ভাবতেন সেগুলো হচ্ছে, কিন্তু আসলে হত না। কোমরের চোটটা ওঁকে বুঝিয়ে দিল যন্ত্রণা হলে কেমন লাগে। উনি ঠিক হয়ে গেলেন। কোমরের ব্যথাটা কয়েকদিন ছিল, সেটা রসুনের তেল মালিশ করেই কেটে গেল। উনি সত্যিই একদিন দুপুরে মাংসভাত খেয়ে বিকালে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে এলেন। বাকি জীবনটা ফুরফুরিয়ে কাটালেন।”

চলবে...

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!