উড়ুক্কু সাপ ও পিরামিড রহস্য, দ্বিতীয় কিস্তি
অনুপম মুখোপাধ্যায়, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 25 Dec 2020 12:32 PM BdST Updated: 25 Dec 2020 12:35 PM BdST
-
কোলাজে ব্যবহৃত অলঙ্করণ: সানজিদা নাহার, চতুর্থ শ্রেণি, বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
দুই মামা হেসে উঠলেন। মুকুল একটু চিন্তিতভাবে বলল, “মানুষ তাহলে মনে মনে যেটা ভাবে সেটাই বাস্তব কি ঘটে যায়?”
ছোটমামা বললেন, “অবশ্যই ঘটে যায়। মানুষ আজ অবধি যা কিছু কল্পনা করেছে, সব কোথাও না কোথাও ঠিকই ঘটে গেছে। বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে তো কোনো সীমারেখাই নেই রে ভাগ্নে! কে তাদের আলাদা করবে?”
মুকুল বলল, “তাহলে যে মানুষ ড্রাগন কল্পনা করেছে, ইউনিকর্ন কল্পনা করেছে, সেসবের কী হবে?”
ছোটমামা উদাসভাবে বললেন, “সবই আছে রে মুকুল! কোথাও না কোথাও ঠিকই আছে। কিংবা, আজ হয়ত নেই, কিন্তু কোনো একসময় ওসব ছিল। আর সেসব প্রাণীর কথা মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে, এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের স্মৃতিতে রয়ে গেছে। মানুষের সঞ্চিত স্মৃতি পরের প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যায়, জানিস তো!”
“অর্থাৎ...” মুকুল অবাক হয়ে বলল, “তুমি বলছ পৃথিবীতে একসময় ড্রাগন ছিল? এমন প্রাণী যে আকাশে উড়ত আর তার মুখ থেকে আগুন বেরোত?”
“অতটা হয়ত নয়। কিন্তু তুই যদি নিজের চোখে জোনাকি না দেখতিস, তোর কি বিশ্বাস হত যে এমন একটা পোকা আছে যেটা শরীরে আলো নিয়ে উড়ে বেড়ায়? একটা প্রাণীর মুখ থেকে আগুন বেরোবে সেটার পেছনে কোনো বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিও নিশ্চয়ই আছে। আর সেই কোন সুদূর অতীতে যে প্রাণীটা ছিল, তাকে মানুষ কল্পনায় অনেকটা বাড়িয়ে নিয়েছে পরে। ধর, আজ যে খবরের কাগজগুলো বেরোয়, তারা দেখবি একই ঘটনার একেক বিবরণ দেয়। হয়ত কোথাও ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, একটা খবরের কাগজ বলবে সেটা হয়েছে তার এগারটা চল্লিশে আর মারা গেছে সতেরজন, আরেকটা কাগজ বলবে সেটা হয়েছে রাত বারোটা পাঁচে আর মারা গেছে বাইশজন। তবেই বোঝ! এই সময়েরই একটা ঘটনা খবরের কাগজ থেকে ঠিকঠাক জানা যায় না, একজন এক কথা বলে তো আরেকজন আরেক কথা। তাহলে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে পৃথিবীতে যেসব অদ্ভুত জানোয়ার ছিল, তাদের কথা আজ জানা কি সম্ভব?”
বড়মামা বললেন, “তাছাড়া ধর আজ এই যে আমরা সেলফোন ব্যবহার করছি, এই যে তুই আমাদের এই গ্রাম থেকে কলকাতায় তোর মায়ের সঙ্গে গত রাতে ভিডিও কল করলি, একজন আরেকজনের যেন সামনে গিয়েই বসলি, তোর মন কত ভাল হয়ে গেল, এটা কি আজ থেকে দশ বছর আগেও ভাবা যেত? যদি ২০১০ সালে কেউ কাউকে বলত এমন একটা ভিডিও চ্যাট করা যাবে, সে বলত গাঁজাখুরি গল্প বলা হচ্ছে। অর্থাৎ, অতীতে যা ঘটে গেছে তা যেমন আমরা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারি না, ভবিষ্যতকেও বিশ্বাস করতে পারি না। জুল ভের্ন তাঁর উপন্যাসগুলোয় যে সব ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছিলেন, সেসব তো ঘটে গেছে, ঘটেনি?”
“হ্যাঁ। তা তো ঘটেছে। সাবমেরিন আবিষ্কার হয়েছে পরে...”
ছোটমামা বললেন, “অথচ আজও আমাদের মানতে অসুবিধা হয় যে ভিন্নগ্রহের মানুষরা আমাদের গ্রহে আসতেন, আর আমাদের স্মৃতিতে তাঁরা দেবতা হয়ে আছেন। আমাদের সভ্যতাকে তাঁরা বারবার এই পৃথিবীতে এসে অনেক এগিয়ে দিয়ে গেছেন। আবার কখনও কখনও আমাদের নিয়ে খেলাও করেছেন। আমাদের উপরে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন...”
মুকুল হাঁ হয়ে বলল, “তুমি অন্য গ্রহের মানুষরা পৃথিবীতে আসে, এটা বিশ্বাস করো?”
ছোটমামা জোরের সঙ্গে বললেন, “অবশ্যই করি। কারণ আমি একজন বুদ্ধিমান মানুষ। বোকারা যত সহজে কোনোকিছুকে অবিশ্বাস করে, একজন বুদ্ধিমান মানুষের সেই উপায় থাকে কি?”
মুকুল বলল, “আমি তো জানতাম বোকারাই সবকিছুকে সহজে বিশ্বাস করে।”
“ভুল জানতিস,” ছোটমামা শক্ত গলায় বললেন, “বিশ্বাস বা অবিশ্বাস, কোনোকিছুকে এই দুটোর কোনো একটা যদি করতেই হয়, তবে যুক্তি অনুসারে করা ভাল।”
“মানে তুমি বলছ, কেউ যদি ভূতে অবিশ্বাস করে, তাকেও সেটা যুক্তি দেখিয়েই করতে হবে?”
“অবশ্যই। এবং সেটার জন্য লেখাপড়া করতে হবে। পোড়ো ভূতুড়ে বাড়িতে গিয়ে বসতে হবে। তারপর নিজের শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বলতে হবে সে ভূতে বিশ্বাস করে না। অবিশ্বাস করার জন্য বিশ্বাস করার চেয়ে বেশি মেহনত লাগে মুকুল! অত সহজ নয়।”
“আমি তো জানতাম ভিন্নগ্রহের প্রাণী-টানি এসব রূপকথার মতো ব্যাপার!”
বড়মামা হাসতে হাসতে বললেন, “তোর ছোটমামা এসব নিয়ে বিস্তর লেখাপড়া করেছে। সেই রবার্ট ভন দানিকেনের বই থেকে শুরু করে আজকের সব লেখালেখি ঘেঁটেছে। ইউটিউবে এ নিয়ে অনেক ডকুমেন্টারি আছে, সেসব ও দেখেছে। তারপর নিজের সিদ্ধান্তে এসেছে। ও যা নিয়ে একবার মেতে ওঠে, সেটার শেষ দেখে তবে ছাড়ে। মনের একটা আশ্চর্য প্রসারতা ওর ছেলেবেলা থেকেই আছে। কোনোকিছুকে যাচাই না করে ও সেটা বিশ্বাসও করে না, অবিশ্বাসও করে না। এটা খুব বড় গুণ ওর। একজন বৈজ্ঞানিকের গুণ।”
“কিন্তু ছোটমামার সাবজেক্ট তো ইতিহাস!”
ছোটমামা হেসে উঠে বললেন, “তুই কি জানিস ইতিহাস বইয়ের মধ্যে যত রহস্য আছে, তা শার্লক হোমস বা ফাদার ব্রাউনের রহস্যকাহিনিতে নেই? একেকটা যুদ্ধে একেকজন রাজার জয় বা পরাজয় নিয়েই আজ অবধি তর্কের সীমা নেই। আজও কত তর্ক হয় জানিস কি, সিরাজ আর মীরজাফরের মধ্যে আসলে কী ঘটেছিল পলাশীর যুদ্ধে সেই নিয়ে? আজ অবধি তর্ক হয় মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি কেন হয়েছিল সেই নিয়ে, বা কলকাতার কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যায় সিরাজের ভূমিকা ছিল কিনা... যেমন ধর সম্রাট আলেকজান্ডারের মৃত্যু ঠিক কী কারণে হয়েছিল, সেই নিয়েই তো একটা রহস্য উপন্যাস হয়ে যায়, একটা কেন, একাধিক হয়ে যায় একাধিক ব্যাখ্যা দিয়ে! কেউ বলে ওঁকে বিষ দেওয়া হয়েছিল, কেউ বলে অসুখ...”
বড়মামা বললেন, “যেমন তোর সেই পিরামিডের রহস্য! সেদিন বলবি বলছিলি। আজ সেটা বল না মুকুলকে!”
ছোটমামা বললেন, “হ্যাঁ। সেটা বলাই যায়। এখন নয়। আজ বিকালে টিলার দিকে যাওয়া যাক দাদা। ফিরে এসে সন্ধ্যায় ওকে ব্যাপারটা বলব। শুনে তোর তাক লেগে যাবে মুকুল।”
মুকুলের মন এখন খুশিতে ভরে গেছে। টিলার দিকে যাওয়ার রাস্তায় দুদিকেই জঙ্গল। ওই রাস্তা তার খুব ভাল লাগে।
বিকাল একটু গড়াতে ঝগড়ু চা আনল। চা খেয়ে বেরনো হল। আজ দিনটা বেশ গরম। কিন্তু বনের মধ্য থেকে পাঁচমিশেলি একটা অদ্ভুত গন্ধ আসে এমন গরমের দিনেই। তার মধ্যেই হলদে, নীল, গেরুয়া, সবুজ নানা ঘনত্বের ছোপ নিয়ে লাল কাঁকুড়ে মাটি। শান্তিনিকেতনের খোয়াইয়ের মতো। সাঁওতাল পরিবারগুলোর অন্তঃপুর দেখা যায়। পথের ছবির সঙ্গে তাদের কেমন যেন এক মনে হয়, যেন কোনো পার্থক্যই নেই প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে। আকাশ ফুঁড়ে উঠেছে একেকটা প্রাচীন শালগাছ। কেউ যদি ছবি আঁকতে চায় তার সামনে বিষয়ের শেষ থাকবে না। খুব দ্রুত একটা ছবি শেষ করেই আরেকটায় চলে যাওয়া যাবে। ছবিতে রং লাগাবার পরে হাতে যদি একচিলতে রং লেগে থাকে, সেটাও এই সুন্দর প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে যাবে।
তিনজন চুপচাপ হাঁটছিলেন।
বড়মামা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “রিমা ছেলেবেলায় এই রাস্তায় এলে কেমন দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিত মনে আছে তোর বুবাই?”
বুবাই ছোটমামার ডাকনাম। রিমা মুকুলের মা, এঁদের ছোটবোন।
ছোটমামা বললেন, “হ্যাঁ। রিমা তো বনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে একবার হারিয়েই গিয়েছিল, মনে নেই? সেই তুলনায় মুকুল অনেক শান্ত।”
বড়মামা বললেন, “এই তুই এত শান্ত কেন রে? এই বয়সে যদি ছুটোছুটি না করিস, তাহলে কখন করবি? আমাদের মতো বুড়ো হলে?”
মুকুল হেসে বলল, “তোমরা মোটেই বুড়ো নও। এখনও তোমরা যা খাওয়াদাওয়া করো, দেখলেই সেটা বোঝা যায়।”
“আরে এসব এলাকায় সবাই খুব খাওয়া-দাওয়া করে। জলটাই এমন। তুই টের পাচ্ছিস না, কিছু খাওয়ার পর এক গ্লাস জল খেয়ে নিলেই কেমন সব হজম হয়ে যাচ্ছে?”
“তা যাচ্ছে। আমার তো এখনই কেমন খিদে খিদে পাচ্ছে।”
“এই নে, বিস্কুট খা।”
বড়মামার সঙ্গে সবসময় এক-দু প্যাকেট বিস্কুট থাকে। যখন যেখানে থাকেন, ওঁর মনে হয় খিদে পেয়ে গেলে খুব বিপদ হবে। নিজের না হলেও সঙ্গের লোকের খিদের কথাটাও ভাবেন। যেমন এখন মুকুলের খিদে পেয়েছে। সঙ্গে বিস্কুট থাকায় সুবিধাই হল। ছোটমামা এজন্য মজা করে বলেন সৈনিক যেমন রাইফেলে বুলেট লোড করে রাখে, তাঁর দাদা পকেটে বিস্কুট লোড করে রাখেন। এর উত্তরে বড়মামা বলেছিলেন বন্দুক আর বুলেট ছাড়া যুদ্ধ তবু জেতা যেতেও পারে, কিন্তু খাদ্য ছাড়া জেতা যায় না। এই কথাটা মুকুলের খুব ভাল লেগেছিল। সারা জীবন মনে রাখার মতো একটা কথা ছিল ওটা।
এখন বেশ হাওয়া দিচ্ছে। বনের মধ্য থেকে সেই পাঁচমিশেলি হাওয়াটা আসছে, সঙ্গে কখনও একটু গরম, কখনও একটু ঠান্ডা। এই সময়টায় মনে আর কোনো দুঃখ থাকতে পারে না। একদম ফুরফুরে হয়ে যায় মন।
বড়মামা গুনগুন করে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন। সম্ভবত ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’। বড়মামা একসময় নিয়মিত গানের চর্চা করতেন, মায়ের কাছে শুনেছে মুকুল। মুকুলের মাও খুব ভাল গান করেন। একসময় পিয়ানো বাজানো শিখতে শুরু করেছিলেন মুকুলের মা, পরে সময়ের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। মায়ের সবচেয়ে সমস্যা সময় নিয়েই। এত ব্যস্ত থাকেন যে, নিজের দিকে তাকানোরও সময় পান না।
আগের কিস্তি
উড়ুক্কু সাপ ও পিরামিড রহস্য: প্রথম কিস্তি
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না! |