অনূদিত গল্প
ছোটবেলায় প্রচুর পড়তেন মরিসন। আফ্রিকান-আমেরিকান ঐতিহ্য থেকে নেওয়া তার বাবার গল্প, পরে তার নিজের লেখার একটি উপাদান হয়ে ওঠে।
Published : 03 Oct 2024, 03:22 PM
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন ঔপন্যাসিক টনি মরিসন। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর লরেনে একটি শ্রমজীবী পরিবারে ১৯৩১ সালে জন্ম নেন তিনি। ছোটবেলায় প্রচুর পড়তেন মরিসন। আফ্রিকান-আমেরিকান ঐতিহ্য থেকে নেওয়া তার বাবার গল্প, পরে তার নিজের লেখার একটি উপাদান হয়ে ওঠে।
মরিসন ওয়াশিংটন ডি.সিতে হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং পড়িয়েছেন। ১৯৬৪ সালে একটি প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭০ সালে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে তিনি প্রিন্সটনসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন।
টনি মরিসনের কাজ আফ্রিকান-আমেরিকানদের জীবন ঘিরে, তাদের ইতিহাস ও নিজেদের সময়ে উভয়ই। তার লেখা প্রায়শই কঠিন পরিস্থিতি এবং মানবতার অন্ধকার দিককে চিত্রিত করে, কিন্তু সততা ও মুক্তির কথা বলে। তার ব্যক্তিগত জীবনের গল্পেও চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি, বোঝাপড়া এবং সহানুভূতি প্রকাশ পায়। পাওয়া যায় তার অনন্য বর্ণনার কৌশল।
শিশু-কিশোরদের জন্য লেখার পাশাপাশি মরিসনের উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই', ‘সং অফ সলোমন’ এবং ‘বিলাভড’। তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৩ সালে। এছাড়া পেয়েছেন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম এবং পুলিৎজার পুরস্কার। ২০১৯ সালে নিউ ইয়র্কে মারা যান এই লেখক।
মরিসনের লেখা ৮টি গল্পের বই নিয়ে ‘অ্যা টনি মরিসন ট্রেজারি’ নামে ২০২৩ সালে একটি সংকলন প্রকাশ করে মার্কিন প্রকাশনী সংস্থা ‘সাইমন অ্যান্ড শুস্টার’। গল্পগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পাবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে।
বাক্সের দুনিয়া
এক দেশে ছিল প্যাটি, মিকি এবং লিজা নামে তিন শিশু। তারা একটা বিশাল আকারের বাদামি রঙের বাক্সে বসবাস করে। তাদের বাক্সের মধ্যে কার্পেট, পর্দা এবং নরম চেয়ার সবই আছে।
জায়গাটা বেশ বড়সড়। একটা বড় জানালা আছে, সবসময়ই পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে, যাতে সূর্যের আলো কোনভাবেই ভেতরে আসতে না পারে। সেখানে তাদের জন্য আছে খেলনা। আর আছে বিছানা। সেই বাক্সের একটামাত্র দরজা, যেটা শুধু বাইরে থেকে খোলা যায়।
শিশুদের বাবা-মা প্রতি বুধবার রাতে তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে অনেক খেলনা। আর আনে পিজা, লেগো ও বাবলগাম। বাক্সের মধ্যে তাদের জন্য একটা টেলিভিশনও আছে। বড়দিনের সময় তারা অনেক উপহার পায়। একবার তারা পেয়েছিল আকাশের একটা বাঁধানো ছবি। আর একবার পেয়েছিল কাচের ফ্রেমে বাঁধানো প্রজাপতি। একবার পেয়েছিল প্লাস্টিকের মাছওয়ালা একটা অ্যাকুরিয়াম। আজ আমরা তাদের গল্পই শুনবো। কারণ তারা শুরু থেকেই এই বাক্সের মধ্যে ছিল না।
প্যাটি থাকে আমাদের বাড়ির পাশে। তাদের একটা ছোট্ট সাদা বাড়ি আছে। বাড়ির একটা দরজা আছে, যেটা দুইদিক থেকেই খোলা যায়। প্যাটি স্কুলে সারাদিন অনেক মজা করে। আর তার আনন্দ দেখে বড়রা দুশ্চিন্তা করে। সে লাইব্রেরিতেও কথা বলে, ক্লাসে গান গায়। এমনকি দিনে চারবার টয়লেটে যায়। প্যাটি সারাক্ষণ দৌড়ঝাঁপ করে। আর সে পুতুল নিয়ে খেলতো না। পতাকাকে সম্মান দেখানোর সময় সে হেসে ওঠে।
তাই একদিন শিক্ষকরা সভা ডাকলেন, কীভাবে প্যাটিকে ঠিক করা যায় সেটা বের করতে। তারা অনেক কথা বললেন এবং ভাবলেন। অবশেষে একটা সমাধান খুঁজে পেলেন। বললেন, তুমি অনেক মিষ্টি একটা মেয়ে, তোমার অনেক সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তোমাকে জানতে হবে, তুমি কতদূর যেতে পারো, যাতে করে বড়রা তোমার উপর নজর রাখতে পারে। তাই নিয়মের একটা তালিকা দেয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া হলো, যাতে বারবার বলতে না হয়। আমরা এবং তোমার বাবা-মা সবাই একমত হয়েছি যে, তুমি তোমার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারো না।
প্যাটি তাদের কথা শুনে মাথা নিচু করে বসে থাকলো। তারপর বললো, আমি আমার মোজা ভাঁজ করতে পারি, একাই নাস্তা খেতে পারি। প্রতি শনিবার সকালে বিছানার চাদর বদলাই। নিজেই জুতোর ফিতা বাঁধি। নিজের হাতমুখ নিজেই ধুই।
তারপর প্যাটি বললো, চড়ুই পাখি তো কিচিরমিচির করে, খরগোশতো লাফায়, বিভার গাছ কাটে। এগুলো করতে তো তাদেরকে কেউ নিষেধ করে না। আমি বেয়াদবি করতে চাই না। কিন্তু বলতে চাই, আমি আমার স্বাধীনতা উপভোগ করতে চাই। আমি জানি, তোমরা অনেক বুদ্ধিমান এবং তোমরা আমার জন্য সেটাই করতে চাও যেটা সবচেয়ে ভালো, বলল প্যাটি। কিন্তু যে স্বাধীনতা তোমাদের মতামতের মুখাপেক্ষী সেটা মোটেও আমার স্বাধীনতা নয়। তাই তারা সবাই ছোট্ট প্যাটির সঙ্গে কোলাকুলি করে তাকে বাদামি বাক্সের মধ্যে পাঠিয়ে দিল।
মিকি বাস করে একটা ভবনের আঠারো তলায়। সেখানে দুটো লিফটের সাহায্যে তারা ওঠানামা করে। সে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় খেলে বেড়ায়। তাই বড়দের অনেক উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। সে বাসার ডাকবাক্সের ঢাকনার উপর নিজের নাম লিখেছিল। সে কখনওবা ভবন সুপারের মোটরসাইকেলের উপর চড়ে বসতো।
মিকি সবকিছুর মধ্যে হুড়োহুড়ি করে। যেখানে সে হ্যান্ডবল খেলতো সেখানে তাকে নিষিদ্ধ করা হলো। ভাড়াটিয়ারা যারা তাকে ভালোবাসে, সবাই মিলে একটা সভা ডাকলেন। তারা অনেক ভাবলেন এবং আলাপ করলেন। বললেন, তুমি খুবই চমৎকার একটা বাচ্চা, তোমার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে। কিন্তু তোমাকে জানতে হবে তুমি কতদূর যেতে পারো, যাতে করে বড়রা তোমাকে সাহায্য করতে পারে। তোমার জন্য নিয়মের একটা তালিকা লিফটের দরজায় টাঙিয়ে দেওয়া হলো, যাতে করে বারবার আর বলতে না হয়। আমরা সবাই একমত হয়েছি যে, তুমি তোমার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারো না।
মিকি চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো। বললো, আমি আমার নিজের চুল নিজে আঁচড়াই। আমার কোন বদঅভ্যাস নেই। প্রতিদিন ভ্যাকিউম দিয়ে মেঝেও পরিষ্কার রাখি। প্রতিদিন ইঁদুরগুলোকে খাবার দিই আর গাছেও পানি দিই। পেঁচারা যদি ডাকতে পারে, খরগোশ যদি লাফালাফি করতে পারে, তবে আমি কেন আমার মতো চলতে পারবো না! সবাইকে উদ্দেশ্য করে সে প্রশ্ন ছুড়ে দিল। প্রশ্ন শুনে তার বাবা-মা মুচকি হাসলো আর তাকে বাদামি বাক্সের মধ্যে পাঠিয়ে দিল।
অপরদিকে লিজা বাস করে একটা খামারে। সে সারাদিন মাঠে মাঠে খেলে বেড়ায়। তার কর্মকাণ্ড দেখে বড়দের দুশ্চিন্তা হয়। মুরগিরা যাতে ডিম নিজের কাছেই রেখে দিতে পারে তাতে সাহায্য করে লিজা। সে কাঠবিড়ালিকে বাগানের ফল চুরি করে খেতে দিত। সে ঘোড়ার মুখ থেকে খাবার নিয়ে খেতো। আর মৌমাছিদের মধু খেতে দিত।
লিজার এসব কর্মকাণ্ড দেখে প্রতিবেশীরা মিলে একটা সভা ডাকলেন। অনেক কথা ভাবলেন। বললেন, তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে। আমরা তোমাকে কাজ থেকে বের করে দিতে চাই না। কিন্তু তোমাকে জানতে হবে বড়দের অনুমতি ছাড়া তুমি কতদূর যেতে পারো। নিয়মগুলো সবারই জানা, তাই সেগুলো বারবার বলতে চাই না। তোমার মা-বাবাসহ আমরা সবাই একমত হয়েছি যে তুমি তোমার স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারো না।
লিজা মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো। তারপর বললো, আমি আমার দাঁত নিজেই ব্রাশ করতে পারি। নিজে নিজেই চিনাবাদাম ভেঙে খেতে পারি। ছোট ভেড়াগুলোকে বোতলে করে দুধও খাওয়াতে পারি। কাক যদি কা কা করতে পারে, খরগোশ যদি লাফাতে পারে, বিভার যদি কাঠ কাটতে পারে, তবে আমি কেন স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবো না, সে বললো।
আমি স্বাধীন বলেই তোমরা আমার মুখ বন্ধ করতে পারো না। আমি জানি, তোমরা বুদ্ধিমান এবং আমার ভালোটাই চাও। কিন্তু আমি তোমাদের মতো করে স্বাধীনতা উপভোগ করতে চাই না। তারা তখন লিজার গালে আলতো আদর করে তাকে বাদামি বাক্সের মধ্যে পাঠিয়ে দিল।
ডলফিন যদি চিৎকার করতে পারে, খরগোশ যদি লাফাতে পারে, বিভার যদি প্রয়োজনে গাছ কাটতে পারে, তাহলে প্যাটি, মিকি আর লিজা কেন তাদের মনের মতো করে চলতে পারবে না! তাই একদিন সব প্রাণী এক হয়ে তাদেরকে বাদামি বাক্স থেকে বের করে আনলো। বিভার বাক্সের গায়ে ফুটো করে দিল। খরগোশ দেয়ালগুলো ধরে লাফালাফি করে সেগুলো ফেলে দিল। কাক কা কা করে সবাইকে জড়ো করলো। চড়ুই, গাঙচিল আর ডলফিন চিৎকার করে সবাইকে উৎসাহ দিয়ে গেল।