রহস্য গল্প
টাং করে একটা শব্দ হলো! সুমন এবার পাগলের মতো দুহাতে মাটি সরাতে থাকলো। এক পরত মাটি সরিয়ে ফেলতেই মুখ বের করলো কালোমতো কী একটা।
Published : 15 Jul 2024, 04:08 PM
৩.
সুমনের সঙ্গে হাঁটছি। কলমাজানি যাচ্ছি আমরা। নদীর পাড় ধরে বালিমাখা পথ। পথের ধারে গলাগলি করে আছে ঢোলকলমির বন। মাঝে মাঝেই শণ, কড়চার ঝোপ। হাঁটতে হাঁটতে ওসব নাড়াচাড়া দিয়ে দেখছি। অন্য সময় হলে মিষ্টি কড়চা তুলে কাড়াকাড়ি করতাম। কড়চা চিবিয়ে রস খেতাম। তারপর মুখ ছুঁলে টানা দুইদিন ভাত খাওয়া বন্ধ হতো! আজ আর ওসবে মন নেই আমাদের।
হাঁটতে হাঁটতে সুমন বললো, ‘হোন বেবাক! চোক কান খোলা রাখিস কইলাম! মেশিন নিয়া এই রাস্তা ধইরা গেলে মাটিতে দাগ থাকবো। দাগ ধইরা ধইরা ঠিক মেশিনের নাগাল পাইয়া যামু তহন।’
‘তোরও যেমন কতা! চোরের দল কি মরবার লাইগা টানা হ্যাঁচড়া কইরা মেশিন নিয়া যাইবো? ধরা পড়ার ভয় নাই অগো?’ পল্টু হড়বড় করে বলে উঠলো কথাটা।
দাঁত খিঁচিয়ে সুমন কিছু বলতে যাচ্ছিল ওকে। কিন্তু থেমে গেল। ভেবে দেখলো, পল্টুর কথাই ঠিক। চোরের দল এমন ঝুঁকি মোটেও নেবে না। তবে সুমনের আঁতে ঘা লেগেছে বেশ। কারো বুঝতে বাকি নেই তা। দলের সবাই ওকে লিডার মানে। এই পল্টুও মানে। লিডার সে হয়েছে শুধু করিতকর্মা বলে নয়। বুদ্ধিরও ধার আছে তার। সেই পড়লো পল্টুর প্রশ্নের মুখে। দুর্দান্ত কিছু করে দেখাতে পারলে বাঁচে এখন। নাহলে আর মনে শান্তি পাবে না।
কলমাজানি পৌঁছতে বড়জোর আধঘণ্টা লাগলো। কিন্তু না! কাজের কাজ কিছুই হলো না। ওদিকে মাঠের দক্ষিণ থেকে মাসুদরাও ফিরে এসেছে। মেশিনের ময়লাও চোখে পড়েনি ওদের। হাঁটতে হাঁটতে ওরা আমাদের সঙ্গে এসেই মিশলো। ভজা কোমরে হাত রেখে মাথা দুলিয়ে বললো, ‘এইডা কোনো কতা, ক! আতিপাতি কইরা খুঁইজাও মেশিনডা পাইলাম না। ধুর! চাচারে আর মুখ দেহান যাইবো না।’
ভজা আরও কী যেন বলে যাচ্ছিলো। কিন্তু আমরা সেসব শুনতে পাচ্ছিলাম না। সবাই তখন উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছি সুমনের দিকে। ইঁদুর যেমন খাবার খুঁজতে নাক ছোঁক ছোঁক করে, সুমনও কী দেখে যেন সরু চোখে তাকিয়ে ছিলো একদিকে! আমরাও নতুন রহস্যের গন্ধ পেয়ে গেছি ততক্ষণে। দম বন্ধ করে তাকিয়ে আছি ওর মুখের দিকে।
হঠাৎ সুমন চোখ না নাড়িয়ে কেবল মাথা দুলিয়ে ইশারা দিলো। তারপর যেদিকে তাকিয়ে ছিলো, হুড়হুড় করে হাঁটা দিলো সেই দিকেই। আমরাও বিড়ালের ছানার মতো সুমনের পিছু ধরলাম।
থামলাম নদীর কোলঘেঁষে ছোটখাটো একটা চটানে। পানি নদীর তলানিতে নেমে গেছে সেই কবেই। বালিয়ারি চর জুড়ে দূর্বা ঘাসের আস্তরণ সবুজ কাঁথার মতো বিছিয়ে আছে। কোন কোন জায়গায় ঘাস বেশ পাতলা। সেই সুযোগে সেখানে জন্ম নিয়েছে থোকা থোকা দন্তকলস গাছ। গাঢ় সবুজ গাছগুলোর মোটা পুরুষ্টু পাতা। এতো রোদেও দাঁড়িয়ে আছে টান টান হয়ে!
সুমন সেই চটানের এক জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কী যেন দেখতে লাগলো। ব্যাপারটা প্রথমে আমাদের নজরে আসেনি। একটু পর ঠিকই চোখে পড়লো। আশ্চর্য ব্যাপার তো! আশপাশের দন্তকলস গাছ বেশ সতেজ সবুজ! কিন্তু গোলমতো একটা জায়গার দন্তকলসগুলো কেমন নেতিয়ে আছে। যেন পানি পায়নি ওরা। সুমন বললো, ‘ব্যাপারডা ধরতে পারছস?’ আমরা বোবার মতো মাথা নাড়লাম। আদতে কিছুই ধরতে পারিনি। তাহলে কেন মাথা নাড়লাম? কে জানে!
সুমন পল্টুর দিকে এক নজর তাকালো। তারপর ঢোলকলমির কয়েকটা শক্ত ডাল এনে সেই জায়গাটার বালুমাটি আলগা করতে শুরু করলো। সঙ্গে হাত লাগালাম আমরা। যেটুকু জায়গার দন্তকলসগুলো নেতানো, তার পুরোটাই আলগা করে ফেললাম।
ততক্ষণে শফিক দৌড়ে বাড়ি থেকে লোহার গাইতি নিয়ে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসেই গাইতিটা দিয়ে চাঁড় দিলো ও। আর ব্যস! টাং করে একটা শব্দ হলো! সুমন এবার পাগলের মতো দুহাতে মাটি সরাতে থাকলো। এক পরত মাটি সরিয়ে ফেলতেই মুখ বের করলো কালোমতো কী একটা। যেন গোবদা মেটে আলুর কোনা বেরিয়ে এলো।
এবার দশহাত লাগিয়ে মাটি সরাতে লাগলাম আমরা। চাচাও আমাদের চেঁচামেচি শুনে হাজির ততক্ষণে। তিনিও মাটি সরাতে লাগলেন মুখ থুবড়ে পড়ে। সবার উপুড় হওয়া মাথায় এক সময় ঢেকে গেল আমাদের সদ্য খোঁড়া বালির খাঁদ। আমরা যারা ভিড়ের বাইরে ছিটকে পড়লাম, উৎসুক চোখে চেয়ে রইলাম কী হয় তাই দেখতে।
একটু পরই কানে ভেসে এলো চাচার চিৎকার। ‘পাইছি রে বাবা! পাইছি! আমার মেশিন পাইছি! ওরে বাবা সুমন। তুই ঠিকই কইছোস। আমার মেশিন ওরা মাটিতেই দাবায়া রাখছিলো!’ আঁতকা খুশিতে আমরা কে যে কী করবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। কেউ কেউ তিড়িং বিড়িং লাফাতে শুরু করে দিলাম। এ ওর গায়ে বালি ছুড়ে ছুড়ে মাখামাখি আনন্দে মেতে উঠলাম। চাচা সুমনকে জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কাঁদতে বসলেন।
৪.
বিকেলে বেশ বড় ভোজ বসালেন চাচা। মাংস, খিচুড়ি, গুড়ের ক্ষীর। জমিয়ে খেতে থাকলাম আমরা। শুধু তাই না, চাচা মেশিন ফিরে পাবার খুশিতে বাজারে চলে গিয়েছেন কোন ফাঁকে। আমাদের জন্য গাট বোঝাই নতুন গামছা কিনে ফিরে এসেছেন। সবাই একটা করে গামছা পেলাম। ফুর্তি আর কাকে বলে!
সুমন গামছার সঙ্গে নতুন একটা লুঙ্গিও পেলো। চাচা নিজ হাতে সবার মাথায় বেঁধে দিলেন গামছাগুলো। এলাকার লোকজনও ততক্ষণে কাণ্ড দেখতে ভিড় করেছে। তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে চাচা আমাদের পিঠে আর মাথায় হাত বুলিয়ে খাওয়াচ্ছেন।
খেতে খেতে দেখলাম, পল্টু খুব বিনয় নিয়ে সুমনের গা ঘেঁষে বসেছে। ব্যাপারটা ধরতে সময় লাগল না আমাদের। সুমন যদি কথার খোঁচা দিয়ে বসে! তাই আগেভাগেই বাড়তি ভাব জমানোর তালে আছে ও। বুদ্ধিটা বোধহয় কাজেও লেগেছে। এখনো সুমন পল্টুকে উনিশ-বিশ কিছু বলেনি। তবে একেবারেই যে কিছু বলবে না, এও কী সুমনের ধাতে আছে!
হলোও তাই। কিছুক্ষণ যেতেই পল্টুর থালার দিকে তাকিয়ে সুমন বললো, ‘ক তো পল্টু! কোন জিনিসের গোশত দিয়া খিচুড়ি খাইতাছস?’
পল্টু মাংসের একটা টুকরো নেড়েচেড়ে বললো, ‘এইডা জানমু না! এ হইলো মুরগির গোশ!’ সুমন হাতে তুড়ি বাজিয়ে বললো, ‘এই তো হাইরা গেলি ব্যাডা! আরে চোক মেইলা দ্যাখ, এইডা হইতাছে তেজি মোরগের গোশ!’
পল্টু অসহায় মুখে বললো, ‘কী কস! ক্যামনে বুঝলি তুই?’ সুমন সেই নদীর পাড়ের পুরনো রাগটা ঝেড়ে দিয়ে বললো, ‘তা বুঝবা কেমুন কইরা! খালি করো বিটলেমি! জ্বলজ্যান্ত মোরগের ঝুঁটিটা যে তোমার পাতে হাঁতার কাটে, চোকে পড়ে না নাহি!’
পল্টু হঠাৎ হাঁ করে তাকালো ওর প্লেটের দিকে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল সুমনের দিকে। মাথা চুলকে খানিক শুকনো হাসি হাসতে চাইলো। আমরা আর দেরি করলাম না। বেচারার বগলতলায় চারপাশ থেকে দিলাম বেদম কাতুকুতু। আর তাতেই শুকনো হাসি ভেজা হাসির ফোয়ারা হয়ে ছড়িয়ে পড়লো উঠানময়!
আগের পর্ব: শ্যালো মেশিন, প্রথম পর্ব