রহস্য গল্প
মাঠ ছাড়িয়ে সামনেই যে গ্রামটা, ওর নাম কলমাজানি। মেশিন নিয়ে চোরদের ওদিকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
Published : 11 Jun 2024, 03:39 AM
১.
‘কিরে, বেবাকে আইছোস?’ গটমট করে এসেই মাতব্বরি চালে বলল সুমন। নিজেই সবার শেষে এসেছে! তবু ফাঁপর দিতে ছাড়ছে না! রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠল আমাদের শরীর। অবশ্য রাগ দেখালাম না। কিছু বললেই বেচারা বেদম খেপে যায়। উল্টাপাল্টা মাত করে! তাই মনে মনে শান্তিচুক্তি করলাম। গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, ‘হ আইছি! খালি বিলু আহে নাই!’
‘হাহ!’ অদ্ভুত এক শব্দ বেরিয়ে এলো সুমনের মুখ থেকে। খেঁকিয়ে উঠলো ও, ‘কী কইলি! বিলু আহে নাই? আজকের খেলাডা যদি ওর লাইগা মাটি অয়, ব্যাডার গলায় তক্তা ঝুলামু কইলাম!’
‘আরে ভাই! একটু আস্তে ক! পয়লা তো হোন কাহিনিডা, ক্যান আইলো না। হুনলাম রাইতে নাহি ওগো শ্যালো মেশিন চুরি অইছে! ধানের খ্যাতে পানিটানি দিয়া ওর বাপে কই গেছিল। হারা রাইত আর ফিরে নাই। তহনই চোরেরা মেশিন নিয়া ভাগছে।’ মাসুদ খানিক ঝাঁঝ মিশিয়ে বললো কথাগুলো। আর বলবেই না কেন! বিলুর জিগরি দোস্ত ও। বিলুকে নিয়ে কেউ ঝাড়া কথা বলবে, আর সে ছেড়ে দেবে? কাভি নেহি! মুখখানা তো আর ব্যাংকে জমা রেখে আসেনি!
মাসুদের কথা শুনে সুমন এবার চুপসে গেল। মেশিন খোয়া গেছে বলে নয়, বিলুর গলায় তক্তা ঝোলাবে বলেও নয়। ওসব সুমনের ডালভাত কথা! দুঃখ জাগলো অন্য এক কারণে। আজ ফুটবল খেলা। পাশের গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে। যদিও বিলু ছাড়া সবাই আছে। কিন্তু বিলু যে দুর্দান্ত গোলকিপার! ওকে ছাড়া টিমটা নড়বড়ে খুঁটির মতোই। তা ছাড়াও ফাঁড়া আছে! বিলু বিপদে পড়ল বলেই না আসতে পারেনি। তাই বলে ওকে ছাড়াই খেলতে যাবে? রেগে বুম হবে ও। দেখা যাবে, সামনের খেলায় ফেটে গেছে সেই বুম! সবাইকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। সপাটে জানাবে, ‘আমি আর নেই তোদের দলে!’
এমন সব সাতপাঁচ ভাবনা ক্যাচ কোচ করে চলছিল সুমনে মাথায়। শেষে এক ঝাড়া মেরে সে উড়িয়ে দিলো ভাবনা ভঙ্গি। গাল খানিক চুলকে বললো, ‘তো ক, কী করমু এহন?’
‘নাহয় দুইডা দিন পরেই খেলাডা খেলি। বিলুরে রাইখা খেলবার গেছি জানলে, ও খুব কষ্ট পাইবো রে!’ মাসুদের মুখটা কাঁচুমাচু। বোঝা গেল, এই কথাটুকু বলার জন্যই এতোক্ষণ মনে মনে ফর্দ মিলাচ্ছিল ।
‘আচ্ছা, তাই অইবো! পরেই খেলমুনি। কী কস তোরা?’ সম্মতি পেতে সুমন তাকাল সবার দিকে।
‘হ,হ পরেই খেলি।’ সম্মতি পাওয়া গেল তরিতে।
‘খেলবার যহন যামু না, বেহুদা বইসা থাকমু ক্যান রে? ল, বিলুগো শ্যালো মেশিনডা খুঁইজা দেই বেবাকে মিলা!’ চট করে বলে উঠলো সুমন। আর তাতেই হলো বাজিমাত! সুমন হচ্ছে বুদ্ধির আস্ত এক মেশিন! ও ঠিকই পারবে চোর ধরতে। মাঝখানে আমরা সুমনের সঙ্গে থেকে এলাকায় বেশ নামধাম কামাতে পারবো! বেশ একটা মাইডিয়ার মাইডিয়ার ব্যাপার হবে! সবাই তাই দুই পা আর এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম! হইহই রইরই করতে করতে চললাম বিলুদের বাড়িতে।
২.
যা ভেবেছিলাম তাই! গিয়ে দেখি সবারই মন খারাপ। বিলু বসে আছে উঠোনের কোণে। মলিন মুখটা হাতের ঠেকায় ঝুলছে। বোঝাই যাচ্ছে, খাওয়া দাওয়া হয়নি কারও। বিলুর বাবা মাথা চেপে বসেছেন ঘরের দাওয়ায়। আমাদের দেখে লম্বা দম ছাড়লেন একটা। মুখটা বেজার করেই বললেন, ‘আসো বাবারা, বসো।’
ততক্ষণে মাসুদ এগিয়ে গেছে বিলুর দিকে। সুমন গিয়ে বসেছে বিলুর বাবার কাছে, ‘চাচা, এইভাবে বইসা থাকলে কি হইবো। চলেন, মেশিনডার খোঁজ করি সবাই মিলা।’
‘খুঁজলাম রে বাবা কত জায়গায়! কামের কাম কিচ্ছু অইল না। আর দাবি নাই!’ কথার ভাবে বোঝা গেল, চাচা মিয়া বেশ আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
তবে সুমন কি অতো সহজে ছাড়ার পাত্র! সে চাচার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ‘হুনেন চাচা, আশপাশের মানুষরাই আপনের মেশিনডা নিছে। এতো ভারি মেশিন। এক রাতের মধ্যে সরাইয়া নিতে পারবো? এইডা সম্ভব নাকি, কন একবার? ভাইবা দ্যাখেন! আশপাশে কোনো জায়গায় ঠিকই লুকাইয়া রাখছে ওরা!’
এবার টনক নড়ল চাচার। আরে তাইতো, এভাবে তো ভেবে দেখেননি তিনি! সত্যিই শ্যালো মেশিনটা একরাতে সরানো সম্ভব নয়। সুমনের বুদ্ধির তারিফ না করে পারলেন না চাচা। সুমনের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘কথাডা তো হাচা! চলো তাইলে, সবাই মিলা আরেকবার খুঁইজাই দেহি!’
ব্যস, শুরু হলো অভিযান। সুমন ভাগ করে দিলো আমাদের। মাসুদ, কমল, সঞ্জয় আর হাসিম মিলে এক দল। ওরা খুঁজতে খুঁজতে যাবে মাঠের দক্ষিণে। ছোট খাল পার হয়ে পাশের গ্রামেরও ঢুকবে। খুঁজবে ঝোপঝাড় ভেঙে। দুই-একটা পুড়োবাড়ি আছে। ওখানেও মেশিন লুকিয়ে রাখা জুতসই। কাজেই ভালো করে খুঁজতে হবে বাড়িগুলোতে। সব বুঝে নিয়ে বেরিয়ে গেল মাসুদের দল।
বাকি রইলাম আমি, সুমন, বিলু, পল্টু আর ভজা। মাঠ ছাড়িয়ে সামনেই যে গ্রামটা, ওর নাম কলমাজানি। মেশিন নিয়ে চোরদের ওদিকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ ওই গ্রামে যেতে জল, ঘাট ভাঙতে হয় না। বিরান মাঠের ওপর দিয়ে পথ। লোকজনের আসা যাওয়াও নেই তেমন। নদীর পাড় ধরে সাফ সাফ রাস্তা। আমরা ওই পথটাই ধরলাম।
চলবে...