অনূদিত গল্প
সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৩৪ সালে নোবেল পুরস্কার পান পিরানদেল্লো। তার এই গল্পটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা।
Published : 07 Sep 2024, 08:17 PM
ইতালির নাট্যকার-ঔপন্যাসিক-ছোটগল্পকার ও কবি লুইজি পিরানদেল্লো (১৮৬৭-১৯৩৬)। আধুনিক নাট্যসাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ ভাবা হয় তাকে। সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৩৪ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তার এই ‘যুদ্ধ’ গল্পটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা। গল্পটি তার ওয়েবসাইটে থাকা ইংরেজি সংস্করণ থেকে অনূদিত।
রাতের এক্সপ্রেস ট্রেন রোম ছেড়ে এসেছে। যাত্রীরা সকাল পর্যন্ত ফাব্রিয়ানোর ছোট স্টেশনে অপেক্ষা করছে, পুরনো ধাঁচের একটা লোকাল ট্রেনে চড়ে তারা সুলমোনার পথে যাত্রা করবে।
ভোরবেলা, দ্বিতীয় শ্রেণির এই কামরাটা ভ্যাপসা ও ধোঁয়াটে। ইতোমধ্যে এখানে পাঁচজন সারারাত কাটিয়েছে। গভীর শোকে ঢাকা একজন স্থূলকায় নারী উঠলেন, তার পুরো শরীরটাই যেন আকৃতিহীন গাঁটরি। তার পেছনে হাঁপাতে হাঁপাতে গোঙাতে গোঙাতে তার স্বামী এলেন। ছোটখাটো পুরুষ, পাতলা দুবলা শরীর, মুখটা সাদা। চোখ দুইটা ছোট কিন্তু উজ্জ্বল; লজ্জা ও অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
অবশেষে তারা বসার সিট পেলেন। অন্যান্য যাত্রীরা তাদের জন্য জায়গা করে দিয়েছেন। স্বামী-স্ত্রী তাদের বিনীতভাবে ধন্যবাদ দিলেন। তারপর লোকটা তার স্ত্রীর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার কোটের কলার নামানোর চেষ্টা করে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি ঠিক আছো?
স্ত্রী কোন উত্তর না দিয়ে আবার তার কোটের কলার টেনে চোখ পর্যন্ত তুলে দিলেন, যেন তার মুখ লুকানোর চেষ্টা করছেন। ‘দুনিয়াটাই খারাপ’, লোকটা একটি দুঃখমাখা হাসি দিয়ে বিড়বিড় করে বললেন। তার মনে হলো, সহযাত্রীদের এই নারীর করুণার দৃষ্টির কারণ জানানো উচিত। তাদের একমাত্র ছেলে যুদ্ধে যাচ্ছে। ছেলেটির বয়স মাত্র কুড়ি, যার জন্য তারা দুজনেই তাদের পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন। এমনকি সুলমোনায় তাদের বাড়ি ফেলে ফেলেছেন ছেলেটির সঙ্গে রোমে আসবেন বলে।
সেখানে সে যাচ্ছে একজন শিক্ষানবিস হিসেবে। তারপর তাকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুদ্ধে যেতে হবে, তবে এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে অন্তত ছয় মাসের মধ্যে তাকে ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হবে না। কিন্তু হঠাৎ করে তারা একটি তারবার্তা পেলেন যে, তিনদিনের মধ্যে ছেলেটিকে ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হবে এবং তাকে বিদায় জানানোর জন্য পিতা-মাতাকে যেতে হবে।
কিন্তু তার স্বামীর এমন বিবরণ শুনে নারীটি চোখ কটমট করে তাকাচ্ছিলেন আর রাগে গজগজ করছিলেন। তার মনে হচ্ছে, এ ধরনের দুঃখের কথা এই লোকদের মধ্যে কোনরকম সহানুভূতি জাগাবে না, যারা সম্ভবত তাদের মতো একই দুরবস্থায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন, যিনি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, বললেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিন, আপনার ছেলে কেবল এখন ফ্রন্টে যাচ্ছে। আমার ছেলেকে তো যুদ্ধের প্রথম দিনেই সেখানে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে সে দু’বার আহত হয়ে ফিরে এসেছে এবং আবার ফ্রন্টে পাঠানো হয়েছে।
আর আমি? আমার দুই ছেলে এবং তিনজন ভাতিজা ফ্রন্টে আছে, আরেকজন যাত্রী বললেন। হয়তো, কিন্তু সে যে আমাদের একমাত্র ছেলে!, সাহস করে স্বামীটি বললেন। যাত্রী উত্তর দিলেন, তাতে কী হয়েছে? আপনি হয়তো আপনার একমাত্র ছেলেকে অতি আদরে নষ্ট করেছেন, কিন্তু আপনি তাকে অন্য সন্তানদের চেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারবেন না, যদি আপনার আরও সন্তান থাকত। পিতামাতার ভালোবাসা তো আর রুটি নয় যে তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে সব সন্তানের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেবেন! একজন বাবা তার প্রতিটি সন্তানকে সমানভাবে ভালোবাসা দেয়, তা সে একজন হোক বা দশজন। আমি এখন আমার দুই ছেলের জন্যই কষ্ট পাচ্ছি। অর্ধেক কষ্ট পাচ্ছি না, বরং দ্বিগুণ কষ্ট পাচ্ছি।
ঠিক... ঠিক..., লজ্জা পেয়ে স্বামী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কিন্তু ধরুন (আশা করি এমনটা আপনার ক্ষেত্রে কখনোই হবে না) যদি কোনো বাবার দুই ছেলে ফ্রন্টে থাকে এবং তিনি তাদের একজনকে হারান, তখনও তো একজন বেঁচে থাকবে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য, তাই না!
হ্যাঁ, উত্তর দিলেন অন্যজন, কিছুটা রেগে গিয়ে বললেন, একজন ছেলে থাকবে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য, কিন্তু আরও একজন থাকবে, যার জন্য তাকে বেঁচে থাকতে হবে। আর একমাত্র সন্তানের বাবার ক্ষেত্রে যদি ছেলেটি মারা যায়, তবে বাবা নিজেও মারা যেতে পারেন এবং তার কষ্ট শেষ হতে পারে। এই দুই অবস্থার মধ্যে কোনটি বেশি খারাপ? আপনি কি মনে হচ্ছে না, আমার মনের অবস্থা আপনার চেয়ে খারাপ?
আহাম্মকের মতো কথাবার্তা, বাধা দিলেন আরেক যাত্রী। পেটমোটা লোকটা লাল মুখ আর ফ্যাকাশে ধূসর রক্তজমাট চোখ নিয়ে হাঁপাচ্ছে। তার বিস্ফোরক চোখের ভেতর থেকে যেন একটা অশান্তি ছিটকে বেরোচ্ছে, যা তার দুর্বল শরীর ধরে রাখতে পারছে না। আহাম্মকের মতো কথাবার্তা, তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন, মুখ ঢাকতে হাত বাড়ালেন যেন সামনের দুটি ফোকলা দাঁত লুকাতে পারেন। আহাম্মকের মতো কথাবার্তা। আমরা কি নিজের লাভের জন্য সন্তানদের জীবন দিই?
বাকি যাত্রীরা উদ্বেগ নিয়ে তার দিকে তাকালেন। যিনি প্রথম দিন থেকে তার ছেলেকে ফ্রন্টে পাঠিয়েছেন, তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, আপনি ঠিক বলছেন। আমাদের সন্তান আমাদের নয়, তারা দেশের সম্পদ…।
ভুল কথা, মোটা লোকটি পাল্টা জবাব দিলেন। আমরা কি দেশের কথা ভাবি, যখন আমরা আমাদের সন্তানদের জন্ম দিই? আমাদের ছেলেরা জন্ম নেয়, কারণ... ঠিক আছে, কারণ তাদের জন্মাতেই হয় এবং যখন তারা পৃথিবীতে আসে, তারা আমাদের নিজের জীবনও তাদের সঙ্গে নিয়ে আসে। এটাই সত্য। আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তারা কখনোই আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যখন তারা কুড়ি বছরে পৌঁছায়, তারা ঠিক তেমনই যেমনটা আমরাও আমাদের বয়সে ছিলাম। আমাদেরও বাবা-মা ছিল, কিন্তু আরও অনেক কিছু ছিল...নারী, সিগারেট, কল্পনা, নতুন টাই... আর অবশ্যই দেশ, যার ডাক আমরা তখন শুনতাম, যখন আমরা কুড়ি বছরে ছিলাম, যদিও বাবা-মা মানা করতেন। এখন, আমাদের বয়সে এসে, দেশের প্রতি আমাদের ভালোবাসা এখনও বড়, তবে এর চেয়েও বেশি বড় হলো আমাদের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা। এখানে কি এমন কেউ আছেন, যিনি তার ছেলের জায়গায় ফ্রন্টে যেতে চাইতেন না, যদি পারতেন?
সবদিকে নীরবতা নেমে এলো, সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। তাহলে কেন? মোটা লোকটি কথা চালিয়ে গেলেন, আমরা আমাদের সন্তানের অনুভূতির কথা বিবেচনা করবো যখন তারা কুড়ি বছর বয়সী? এটা কি স্বাভাবিক নয় যে তাদের বয়সে দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা (আমি শালীন ছেলেদের কথা বলছি, অবশ্যই) আমাদের প্রতি ভালোবাসার চেয়েও বড় হবে? এটা কি স্বাভাবিক নয় যে এমনটি হওয়া উচিত, কারণ শেষ পর্যন্ত তারা আমাদেরকে এমন বয়স্ক ছেলেদের মতো দেখতে চায়, যারা আর নড়াচড়া করতে পারে না এবং বাড়িতে বসে থাকতে বাধ্য? যদি দেশ রুটির মতোই প্রয়োজনীয় হয়, যার প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু খেতে হবে যাতে ক্ষুধায় না মরে, তাহলে কেউ না কেউ দেশকে রক্ষা করতে যাবে। আর আমাদের ছেলেরা যায়, যখন তারা কুড়ি বছর বয়সী, এবং তারা কান্না চায় না, কারণ যদি তারা মারা যায়, তারা আগুনে জ্বলে এবং আনন্দে মারা যায় (আমি শালীন ছেলেদের কথা বলছি, অবশ্যই)।
লোকটা বলতে থাকলো, এখন যদি কোন তরুণ নিজ আনন্দে মারা যায়, জীবনের বিশ্রী ব্যাপারগুলো না ভাবে, তার ক্ষোভ, তার ক্ষুদ্রতা, তার হতাশার তিক্ততা... তাহলে তার জন্য আমরা আর কী চাইতে পারি? সবাইকে কান্না থামানো উচিত; সবাইকে হাসা উচিত, যেমন আমি হাসি... বা অন্তত ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানো উচিত, যেমন আমি জানাই। কারণ আমার ছেলে মারা যাওয়ার আগে, আমাকে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল যে, সে খুশি। কারণ তার জীবন সে এমনভাবেই শেষ করতে চেয়েছিল। এ কারণেই, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, আমি শোকের পোশাকও পরি না…।
তিনি তার হালকা বাদামি কোটটি ঝাঁকিয়ে দেখানোর চেষ্টা করলেন; তার ফোকলা দাঁতের ওপর নীলচে ঠোঁট কাঁপছে, তার স্থির চোখ জলে ভরে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি একটি কর্কশ শব্দে হাসলেন, যা সহজেই কান্নার মতো শোনাতে পারত।
ঠিক তাই... ঠিক তাই..., অন্যরা সম্মতি জানালো। সেই নারী, যিনি তার কোটের নিচে এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছেন আর সবকিছু শুনছেন, গত তিন মাস ধরে তার স্বামীর এবং তার বন্ধুদের কথায় কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন, কিছু এমন যা তাকে দেখাতে পারে কীভাবে একজন মা তার ছেলেকে কেবল মৃত্যুর দিকে নয়, বরং সম্ভাব্য জীবনের ঝুঁকির দিকে পাঠানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবেন।
কিন্তু বলা কথাগুলোর মধ্যে একটি শব্দও তিনি খুঁজে পাননি যা তাকে সান্ত্বনা দিতে পারে। তার দুঃখ আরও বেড়ে গেলো যখন তিনি দেখেছেন যে কেউ তার ধারণা অনুযায়ী তার অনুভূতিগুলি ভাগ করতে পারছে না। কিন্তু এখন সেই যাত্রীর কথা তাকে স্তম্ভিত এবং প্রায় বিমূঢ় করে দিলো। তিনি হঠাৎ বুঝতে পারলেন যে, অন্যরা ভুল ছিল না এবং তাকে বুঝতে পারেনি, বরং তিনিই এমন ছিলেন যিনি সেই বাবা-মায়ের মতো উচ্চতায় উঠতে পারেননি, যারা নিজেদের সন্তানদের বিদায় শুধু দিচ্ছেন না, বরং তাদের মৃত্যুকেও চোখের জল ছাড়াই মেনে নিচ্ছেন।
তিনি তার মাথা উঁচু করলেন, কোণ থেকে সামনের দিকে ঝুঁকলেন। মোটা লোকটি তার সহযাত্রীদের কাছে তখনও বলে যাচ্ছেন, তার ছেলে কীভাবে রাজা এবং দেশের জন্য একজন বীরের মতো লড়াই করে মারা গিয়েছিল। আনন্দে, কোন অনুশোচনা ছাড়াই। তাকে মনে হলো যেন তিনি এমন এক জগতে পা দিয়েছেন যার স্বপ্ন তিনি কখনো দেখেননি, একটি জগৎ যা তার জন্য এতদিন অপরিচিত ছিল। তিনি আনন্দিত হলেন সবাইকে সেই সাহসী বাবাকে অভিনন্দন জানাতে শুনে, যিনি তার সন্তানের মৃত্যুর বিষয়ে এতটাই উদাসীন হয়ে কথাগুলো বলছিলেন।
তারপর হঠাৎ, যেন তিনি কিছুই শোনেননি এবং প্রায় যেন একটি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলেন, তিনি বৃদ্ধ লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে... আপনার ছেলে সত্যিই মারা গেছে?
সবাই তার দিকে তাকালো। বৃদ্ধ লোকটিও তার দিকে ঘুরে তাকালেন, তারা ফোলা ফোলা জলভরা ফ্যাকাশে ধূসর চোখ দিয়ে গভীরভাবে তার মুখের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ ধরে তিনি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। তিনি তাকিয়ে রইলেন, তাকিয়ে রইলেন তার দিকে, যেন সেই বোকা, বেমানান প্রশ্নে হঠাৎ করে তিনি শেষমেশ বুঝতে পারলেন যে তার ছেলে সত্যিই মারা গেছে, চিরতরে চলে গেছে, চিরতরে।
তার মুখ সংকুচিত হয়ে গেলো, ভয়াবহভাবে বিকৃত হয়ে গেলো, তারপর তিনি তাড়াহুড়ো করে পকেট থেকে একটি রুমাল বের করলেন এবং সবাইকে বিস্মিত করে নুয়ে পড়লেন- বেদনাহত হৃদয়ভাঙা অঝর কান্নায়।