ক্যাম্পের শিশু আইসক্রিমওয়ালাদের স্বপ্নগুলো ছোট। তবে লাল, নীল, গোলাপি আইসক্রিমের মতোই ভীষণ রঙিন।
Published : 01 Jan 2024, 02:34 PM
ভোরের আলো ফুটেছে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে। তবে তা অন্য স্বাভাবিক দিনের চেয়ে একটু বেলা করে। পাখির কিচিরমিচির কুঞ্জনে তা স্পষ্ট টের পাওয়া গেল।
পাহাড়ি এলাকা বলে ক্যাম্পে কুয়াশার রেশ তখনো কাটেনি। বাতাসের স্নিগ্ধতা হৃৎপিণ্ড নাড়িয়ে দিচ্ছিল। শীতের সকাল বলে কথা। সারা রাত নীরব হয়ে থাকা মানুষগুলো শুরু করবে দিনের ক্লান্তিহীন যাত্রা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শীতের সকালটা ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শুরু হয় না। শুরু হয় কোন রেশন কখন দেবে, কোন অফিস কখন খুলবে তার সময়সূচি দিয়ে।
তবে এসব কিছুর মাঝেও ছোট্ট ছোট্ট কতগুলো মানুষের দিনটা শুরু হয় একটু ভিন্নভাবে। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইসক্রিমওয়ালা বা বরকওয়ালা নামে পরিচিত। রোহিঙ্গা শিশুরা সচরাচর আইসক্রিমকে ‘বরক’ বলে চেনে। ছোট ছোট আইসক্রিমওয়ালাদের ছোট ছোট হাতের কোমল ছোঁয়া পেয়ে রাতের বেলা অলস হয়ে ঝুপড়ির এক কোণায় পড়ে থাকা আইসক্রিমের বাক্সগুলোর প্রাণ ফিরে আসে। পুরোনো রিকশার বেল আর নাটবল্টু দিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি ঘণ্টিগুলোও টিং টিং করে বেজে ওঠে।
সময় তখন আটটা পেরিয়ে নয়টার কাছাকাছি। টিং টিং করে ঘণ্টি বাজিয়ে মাথায় একটা বাক্স নিয়ে এগিয়ে আসছে তেমনই এক ছোট্ট আইসক্রিমওয়ালা। হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। নাম মো. রিদুয়ান। বয়স বারো কি তেরো হবে। ‘ক্যাম্প বিশ’-এর এক ঝুপড়ি ঘরে মা-বাবার সঙ্গে বসবাস করে সে। নয় ভাই-বোনের মধ্যে রিদুয়ান চতুর্থ। বাবা মারা গেছে বছর দুয়েক আগে, তাই সংসারের দায়িত্বের ভার কিছুটা এসে পড়েছে তার কাঁধে।
চলতে চলতে কথা হয় রিদুয়ানের সঙ্গে। প্রতিদিন দুইশ বিশ-ত্রিশ টাকার মতো আইসক্রিম বিক্রি করে সে। দিন শেষে বিক্রির সব টাকা তুলে দিতে হয় আইসক্রিমের মালিকের হাতে। মালিক হিসাব করে লাভ থেকে গড়ে সত্তর-আশি টাকা দেয় তাকে। রিদুয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পড়ননা গরস কিনা?’ (পড়াশোনা কর কিনা?) আইসক্রিমের বাক্সটা বাম কাঁধ থেকে ডান কাঁধে নিয়ে হাসিমুখে রিদুয়ান জানালো, ‘আই স্কুলঅ ন যাই।’ (আমি স্কুলে যাই না)। বললাম, সুযোগ পেলে পড়াশোনা করবে কিনা! মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিল রিদুয়ান।
দিনের শুরু বলে রিদুয়ানের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। তাছাড়া আইসক্রিম বিক্রির তাড়াও আছে তার। অগত্যা তাকে বিদায় জানাতে হলো। কুয়াশার রেশ কাটতে শুরু করেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো চিরচেনা ব্যস্ততায় ফিরছে। চলতি পথে আরও এক ছোট্ট আইসক্রিমওয়ালার সঙ্গে দেখা হলো। মাথায় ককশিটের তৈরি আইসক্রিমের বাক্স। কাঁধে ঝোলানো একটা থলে। কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তর নাম কী’ (তোমার নাম কী?) কিঞ্চিৎ আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘মো. আনাস।’ পাঁচ ভাই আর চার বোনের মধ্যে আনাস সবার ছোট। বয়সটা ঠিক কত সেটা জানে না আনাস। মা-বাবার সঙ্গে ‘ক্যাম্প বারো’তে থাকে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার কিলাই ঢং-এ আনাসের বাড়ি। বাবা-মায়ের সঙ্গে সাগর পাড়ি দিয়ে বছর ছয়েক আগে সে বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে।
আনাস রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালিত একটি শিশু লার্নিং সেন্টারে বিকেলের শিফটে পড়ে। একটু অবাক হয়ে আনাসের কাছে বিকেলের শিফটে পড়ার কারণ জানতে চাইলাম। আনাস জানালো, সে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে আইসক্রিম বিক্রি করে পরিবারকে সাহায্য করে। তাই নিজের পড়াশোনার সুবিধার্তে লার্নিং সেন্টারে বিকেলের শিফটে ভর্তি হয়েছে সে।
পড়াশোনার প্রতি আানাসের এমন আগ্রহ দেখে একটু মুগ্ধ হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজিয়া হয় টিয়ার আসক্রিম বেচা অইয়ে?’ (আজ কত টাকার আইসক্রিম বিক্রি হয়েছে?) আনাস ঝটপট উত্তর দিল, ‘সত্তর পাঁচ টিয়া’ (পঁচাত্তর টাকা)। সেইসঙ্গে দুই কেজির মতো চালও পেয়েছে সে। অনেক সময় দেখা যায় ক্যাম্পে মা-বাবার হাতে নগদ টাকা থাকে না। তখন তারা তাদের ছোট ছোট সন্তানদের চালের বিনিময়ে আইসক্রিম কিনে দেন। আনাসের মুখ থেকে ক্যাম্পের এমন বিনিময় প্রথার কথা শুনে অবাক হতে হলো আমাকে। পথ চলতে চলতে আনাসকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড় অইয়ের তুই কী অইতে ছস?’ (বড় হয়ে কী হতে চাও?) আনাস মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘আই অহনো ন জানি।’ (আমি এখনও জানি না)।
আনাস আমাকে বিদায় জানিয়ে নিজ গন্তব্যে পা বাড়াল। সকাল গড়িয়ে দুপুর ছুঁই ছুঁই। ভোরের কুয়াশামাখা সূর্য নিজস্ব রূপ ধারণ করে চকচক করতে শুরু করেছে। সূর্যের তাপে শীতের কাপড়টা গা থেকে ছাড়িয়ে নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে শিশুদের একটা জটলার দিকে এগিয়ে গেলাম। জটলার মধ্যমণি আরেক খুদে আইসক্রিমওয়ালা। আইসক্রিম বিক্রির অবসরে কথা হয় তার সঙ্গে। কাকতালীয়ভাবে তার নামও মো. আনাস। বয়স তেরো-এর কাছাকাছি। মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের বুচিডং শহরের ইয়াংসং গ্রামে তার বাড়ি। বাংলাদেশে আসার পর এখন ‘ক্যাম্প উনিশে’ পরিবারের সঙ্গে তার বসবাস।
আনাসও ক্যাম্পের একটি লার্নিং সেন্টারে দুপুরের শিফটে পড়ে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে আনাস বাবা-মায়ের মেজ সন্তান। আনাসের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজিয়া হয় টিয়ার আসক্রিম বেছা অইয়ে?’ (আজ কত টাকার আইসক্রিম বিক্রি হয়েছে?) আনাস একটু মাথা চুলকিয়ে উত্তর দিলো, ‘একশ চার কুড়ি টিয়ার হাছাহাছি’ (একশ আশি টাকার কাছাকাছি)।
সাধারণত আনাসরা দিনে সর্বোচ্চ দেড়শো-দুইশো টাকার মতো আইসক্রিম বিক্রি করতে পারে। সকাল আটটায় আইসক্রিমের বাক্স মাথায় তাদের যাত্রা শুরু হয়। এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্প পেরিয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সে যাত্রা শেষ হয় দুপুর বারোটা কিংবা তারও একটু পরে। বেচা-বিক্রি শেষে টাকাসমেত বাক্স আর ঘণ্টি মালিককে ফেরত দিয়ে দিতে হয়। টাকা পয়সার হিসাব শেষে পরদিন সকালে আবার গিয়ে মালিকের কাছ থেকে আইসক্রিমের বাক্স আর ঘণ্টি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। বাক্সে থাকে নারকেল আর দুধের তৈরি আইসক্রিম, তেঁতুলের আইসক্রিম, লাল, নীল এবং গোলাপিসহ বিভিন্ন রঙের আইসক্রিম।
আনাস জানালো, ছোটরা বেশি পছন্দ করে নারকেল আর দুধের তৈরি আইসক্রিম। কথার ফাঁকে জানতে চাইলাম তার ভবিষ্যত স্বপ্নের কথা। আনাস হাসিমুখে উত্তর দিল, সে বড় হয়ে লার্নিং সেন্টারের মাস্টার হতে চায়। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্টের প্রতি তার চোখেমুখে অনেক সম্মান আর শ্রদ্ধা ফুটে ওঠলো। আনাসের কাছে জানলাম, সাধারণত মিয়ানমারে ‘পড়াশোনা জানা শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিরা’ সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরেন। তাই আনাসও স্বপ্ন বুনছে লার্নিং সেন্টারের মাস্টার হয়ে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরার।
দেখতে দেখতে খালি হয়ে গেল আনাসের আইসক্রিমের বাক্স। সেইসঙ্গে ঘনিয়ে এলো তার লার্নিং সেন্টারে যাওয়ার সময়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ছোট ছোট আইসক্রিমওয়ালাদের স্বপ্নগুলোও ছোট। তবে লাল, নীল, গোলাপি আইসক্রিমের মতো ভীষণ রঙিন। বছর ছয়েক আগে এমন রঙিন স্বপ্ন দেখা তাদের কাছে ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু এখন তারা কল্পনাকে পাশ কাটিয়ে বাস্তব রঙিন জীবনে পা বাড়িয়েছে।
রাত পেরিয়ে ভোর হলে সূর্য আবারও জেগে উঠবে নীল আকাশে। কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে ক্যাম্প। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ছোট ছোট আইসক্রিমওয়ালারা সেই ভোরে ঘণ্টি বাজিয়ে, হরেক রকমের আইসক্রিমভর্তি বাক্স মাথায় নিয়ে হয়তো আবারও যাত্রা করবে রঙিন সেই স্বপ্নের খোঁজে।