গল্প
অন্যদিন সূর্যের আলোয় রূপার ঘুম ভাঙে, আজ ঘুম ভাঙার পর সে দেখে সূর্য চুরি হয়ে গেছে।
Published : 07 Jun 2024, 10:08 AM
অন্যদিন সূর্যের আলোয় রূপার ঘুম ভাঙে, আজ ঘুম ভাঙার পর সে দেখে সূর্য চুরি হয়ে গেছে।
নয়তো কি! জানালায় বসে এত খুঁজেও সূর্যের দেখা পেলো না। আকাশের কোলজুড়ে আজ শুধু মেঘ আর মেঘ। কে চুরি করে নিয়ে গেল সূর্যটা? এত মেঘই বা দিল কে?
ভাবতে ভাবতে রূপা শুনতে পেলো পেছন থেকে অর্ক বলছে, ‘আমি!’
‘তুই!’
‘হ্যাঁ! আমি একটা ছবি এঁকেছি। সূর্যের।’
‘সত্যিই তুই সূর্যের ছবি এঁকেছিস! নাকি সত্যি সূর্যটাকে তোর আঁকার খাতায় নামিয়ে রেখেছিস!’
‘সে কী! সূর্যটাকে কেমন করে নামিয়ে আনবো! আমার হাত কি আর লম্বা নাকি, ছোটদি?’
‘সূর্যকে ছুঁতে হাত লম্বা হতে হয় না, ভাই। বড় মন লাগে। তোর তো এত বড় মন। চাইলে তুই সূর্যকে ঠিক তোর কোলে নামিয়ে আনতেই পারিস। এরকম একটা কাণ্ড কখন করেছিস বল দেখি!’
‘একটু আগে। তুমি তখন ঘুমাচ্ছিলে। সূর্যকে দেখতে না পেয়ে মনে মনে বললাম, হে মহান সূর্য! আজ বাবার জন্মদিন। জন্মদিনে বাবাকে সূর্য উপহার দিতে চাই। একবার এসো প্লিজ!’
‘সূর্য কী বলল?
‘বলল, বাবার জন্মদিন বলেই আজ আকাশে উঠিনি। তোমার আঁকার খাতায় উঠেছি। খাতায় রং-পেনসিল ঘুরালেই আমাকে দেখতে পাবে।’
‘আর অমনি বুঝি রং পেনসিল ঘুরাতে শুরু করলি?’
‘হ্যাঁ, ছোটদি! আমি যতই রং পেনসিল ঘুরাচ্ছিলাম, একটু একটু করে সূর্য উঁকি দিচ্ছিল। শেষে দেখি সূর্যটা বাবার মুখ হয়ে গেছে।’
‘মজার ব্যাপার তো! কই আমাকে দেখা দেখি!’
অর্ক আঁকার খাতাটা রূপার সামনে ধরল। সূর্যের আদলে বানানো একটা মুখ। মুখটা ঠিক বাবার মতো। দেখে রূপা বলল, ‘বাবার মুখে তো গোঁফ নেই। তুই দেখি ছবিতে একটা গোঁফও লাগিয়েছিস! গোঁফটা আবার লাল!’
এই বলে দুই ভাইবোন খুব হাসছে। শুনতে পেয়ে পাশের ঘর থেকে লোপা বলল, ‘এই তোরা আমাকে ছাড়া এত হাসছিস কেন?’
কেন হাসছিল সেটা বলতেই ওরা লোপার ঘরে এলো। এসে দেখে একটা খাতা হাতে লোপা বসে আছে। নিজের আঁকা বাবার ছবিটা দেখিয়ে অর্ক বলল, ‘আমাদের গোঁফওয়ালা বাবাকে কত সুন্দর লাগছে! তাইনা, বড়দি!’
ছবি দেখে লোপা বলল, ‘বাবার গোঁফে মেহেদি মাখিয়েছিস বুঝি?’
রূপা বলল, ‘হ্যাঁ দিদি! শুধু কি গোঁফে মেহেদি, চোখে একটুখানি কাজলও মেখে দিয়েছে ভাই! দেখো!’
তারপর তিন ভাইবোন বেশ হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে রূপা দেখল লোপার খাতার উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘প্রিয় বাবাকে।’ তার ঠিক নিচে লোপার পুরো নাম। দেখে রূপা বলল, ‘তোমার হাতে ওটা কীসের খাতা, দিদি?’
লোপা বলল, ‘বই। আমি লিখেছি। বাবার জন্মদিনে উপহার দেবো।’
পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে ছোট ছোট কয়েকটা গল্প দেখাল লোপা। সবগুলো গল্প বাবাকে নিয়ে লোপার নিজের হাতে লেখা।
গল্পগুলো বাবার সঙ্গে বেড়ানোর, আনন্দ-অভিমান-খুনসুটির। একটা গল্প লোপা সুর করে করে পড়ে শোনাল ওদের। বাবাকে নিয়ে লেখা লোপার গল্প শুনে অবাক হলো রূপা! লোপা এত ভালো গল্প লিখতে পারে জানতই না!
ভাইয়ের আঁকা ছবিটার মতো বোনের লেখা গল্পের বইটাও ভালো লাগল রূপার। তবুও মনটা ভার হয়ে আছে। হবে না-ই বা কেন! ভাই ছবি আঁকল, বোন গল্প লিখল; রূপাতো কিছুই করতে পারলো না এখন অবধি। কী উপহার দেবে ও বাবার জন্মদিনে!
ভাবলো স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ান হয়ে ও যে মেডেলটা পেয়েছিল সেটা উপহার দেবে, আবার ভাবলো মেডেল নয়, হারমোনিয়াম বাজিয়ে নতুন যে গানটা তুলেছে, ওটাই বাবার জন্মদিনের উপহার হিসেবে গেয়ে শোনাবে। নাহ! কোনোটাই মনে ধরছে না রূপার। তাহলে কী উপহার দেবে!
মাকে নিয়ে এক জোড়া পাখি কিনে আনলে কেমন হয়! নরম তুলতুলে দুটো পাখি পেলে বাবা নিশ্চয় অনেক খুশি হবে! ভাবতে ভাবতে শুনতে পেলো বারান্দায় খাঁচায় আটকানো ওর পোষা পাখি দুটো কিচিরমিচির করে ডাকছে। রূপা ঘরের বারান্দায় এসে বসলো। বড় বড় চোখে দেখছে খাঁচায় বন্দী ছোট্ট পাখি দুটোকে। পেছনে দূর আকাশ। কোলে মেঘ নিয়ে আকাশ মন খারাপ করে আছে, আর মন খারাপ করে রূপা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
বারান্দার চারপাশে লাগানো রূপার মায়ের হাতের ফুলের গাছ। ফুলে ফুলে ভরে আছে গাছগুলো। তাই দেখে রূপা ভাবল, জন্মদিনে বাবাকে এক গুচ্ছ ফুল উপহার দেবে। ফের মনে হলো- ফুল তো আর ও নিজে বানায়নি। নিজস্ব নিয়মে ফুটেছে। ওর চাই নিজের তৈরি কিছু, যা দিয়ে বাবার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাবে। অমনি ধপাস করে বৃষ্টি নামলো। ঝুম বৃষ্টি।
রূপা বৃষ্টিতে হাত দুটো বাড়িয়ে ধরে। ছোপ ছোপ ভিজছে হাত আর আনন্দে হঠাৎ কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর শরীর। তখনই মাথায় একটা ভাবনা এলো, জন্মদিনে বাবাকে উপহার দেওয়ার ভাবনা। যেই ভাবা সেই কাজ। ও ছুটল বাবার ঘরে। গিয়ে দেখে ওদের তিন ভাইবোনের সবার ছোট অর্ক আর বড় লোপা নিজেদের তৈরি উপহার হাতে বাবাকে ঘিরে বসে আছে। রূপাকে দেখে বাবা বলল, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিল আমার মেজো মা! আয়! বুকে আয়।’
রূপা বাবাকে নিজের বুকে টেনে তুলল। তারপর টেনে নিয়ে গেলো বারান্দায়। বাবা আর রূপাকে দেখে বৃষ্টি খুশি হয়ে ভারি বৃষ্টিতে রূপ নিলো। এমন খুশি খুশি বৃষ্টি দেখে কে বসে থাকে ঘরে! ভাবতে ভাবতে রূপা পাখিসুদ্ধ খাঁচা হাতে বাবাকে নিয়ে নেমে পড়লো আঙিনায়।
বৃষ্টিতে তুমুল ভিজছে বাপ-বেটি। ভিজছে পাখিরাও। পাখিদের আদর করে রূপা বলল, ‘বাবা, পাখি দুটোরও জন্মদিন আজ। জন্মদিনে ওদের মুক্ত করে দাও।’
নিজের হাতে খাঁচার দরজা খুলে দিতে দিতে বাবা বলল, ‘শুভ জন্মদিন জোড়া পাখি।’ জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তা গায়ে মেখে নিমিষে ওড়ে গেলো পাখি দুটো। ওদের মুক্তি বৃষ্টিভেজা বাবার মুহূর্তটা রঙিন আর আনন্দময় করে তুললো।
এমন আনন্দময় মুহূর্তে নিজেও শুনতে পেলো রূপা বলছে, শুভ জন্মদিন, বাবা। জন্মদিনে এই মুহূর্তটা তোমাকে আমার উপহার।