রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নের উত্তরে খালাসী বললো, ‘বাবু এরকম স্থান জগতে আর নাই। মক্কা-মদিনার পরই আমরা চট্টগ্রামকে গণ্য করি।’
Published : 02 Nov 2023, 10:59 PM
‘কি হুনিলাম আজব কথা/ দরজ্যার তলে চলের গাড়ি/ ভুডুর করি দুই মিনিটে পৌঁছি যাইওম বাপের বাড়ি।’ কবি ওমর কায়সারের এ থিম সং শুনলে স্মরণে আসবে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নিচে দক্ষিণ এশিয়ার নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে সুড়ঙ্গটি ১৫০ ফুট গভীরে অবস্থিত।
এ সুড়ঙ্গপথ কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের দুটি অঞ্চলকে যুক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধু টানেলের মোট দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। ফলে দীর্ঘপথ অতিক্রম করা যায় কয়েক মিনিটের মধ্যে। সাঙ্গু, মাতামুহুরী, হালদা, শঙ্খ, ডলু- নানা নামের নদী প্রবাহিত হলেও এই কর্ণফুলী সবাইকে ছাপিয়ে চট্টগ্রামের পাশে স্থান করে নিয়েছে। যে কোনো কারণেই চট্টগ্রামের কথা বলতে গেলে চলে আসে কর্ণফুলীর কথা। চট্টগ্রামের সঙ্গে কর্ণফুলী নামটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। একে চট্টগ্রামের ‘লাইফ লাইন’ মনে করা হয়।
বলা হয়ে থাকে, ১০ হাজার বছর আগে এই কর্ণফুলী নদীর জন্ম ভারতের মিজোরাম প্রদেশের মমিত জেলার শৈতা গ্রাম বা লুসাই পাহাড়ে। তারপর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কাছে এসে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
কর্ণফুলী নদীর মোহনায় হাজার বছরের প্রাচীন চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর অবস্থিত। পর্তুগিজরা এটাকে বলত ‘পোর্টে গ্র্যান্ডে’, অর্থাৎ বড় বন্দর। কর্ণফুলী নদীর দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ১৬১ কিলোমিটার। রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার থেগা নদীর মোহনা বা ঠেগামুখ থেকে বড় হরিণার মুখ পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার ভারত-বাংলাদেশের বিভক্তিরেখা হিসেবে কাজ করছে এ নদী।
১০ হাজার বছরের প্রাচীন কর্ণফুলী নদীকে মধ্যযুগীয় পুঁথি-সাহিত্যে কবি-সাহিত্যিকরা ‘কাঁইচা খাল’ নামে উল্লেখ করেছেন। মারমা আদিবাসীরা একে ‘কান্সা খিওং’ নামে ডাকে। আবার জন্মস্থান মিজোরামে এর নাম ‘খাওৎলাং তুইপুই’। কারো কারো কাছে এ নদীর নাম ‘কাইজ্যা’। যে যেখানে যে নামেই ডাকুক না কেন, আমাদের কাছে সে এখন কর্ণফুলী। বাংলাদেশের সবচেয়ে শান্ত নদীটিও সে।
কিন্তু হাজার বছরের প্রাচীন এ নদীর নাম কে ‘কর্ণফুলী’ রাখল, তার কোনো সর্বজনস্বীকৃত সূত্র জানা নেই। তিনটি কিংবদন্তির কথা বই-পুস্তকে উল্লেখ পাওয়া যায়। বহুল প্রচলিত কিংবদন্তি হলো- এক আরাকান রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক পাহাড়ি রাজপুত্রের প্রেমে পড়ে। কোন এক জ্যোৎস্না রাতে তারা দুজন এ নদীতে নৌভ্রমণে বের হয়। নদীর পানিতে জোছনার জলকেলি দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা রাজপুত্রের দেওয়া ভালোবাসার ফুলটি পানিতে পড়ে যায়।
প্রিয় ফুল হারিয়ে কাতর রাজকন্যা তা উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রবল স্রোতে রাজকন্যাকে ভেসে যেতে দেখে রাজপুত্রও রাজকন্যাকে বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেয়। দুজনেই নদীতে তলিয়ে যায়। তখন থেকেই নাকি নদীটির নাম হয় ‘কর্ণফুলী’।
আরেকটি কিংবদন্তি হলো, একদিন এক পাহাড়ি রাজকন্যা সহচরীদের সঙ্গে এ নদীতে গোসলে গিয়েছিল। গোসল শেষে তীরে এসে দেখে রাজকন্যার কানের ফুল নদীর পানিতে হারিয়ে গেছে। কর্ণফুল হারানোর শোকে কাতর পাহাড়ি রাজকন্যা অসুস্থ হয়ে পড়লে কোনো বৈদ্য-কবিরাজ তাকে সারিয়ে তুলতে পারে না। অবশেষে একদিন রাজকন্যা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তারপর থেকে এ নদীর নামকরণ হয় ‘কর্ণফুলী’।
প্রথমোক্ত কিংবদন্তির উল্লেখ টমাস হারবার্ট লেউইনের ‘অ্যা ফ্লাই অন দ্য হুইল’ বইয়ে উল্লেখ করা আছে। এখানে কর্ণফুলীর পূর্বনাম বলা আছে ‘কাইঞ্চা খাল’। তৃতীয় কিংবদন্তি হলো, অষ্টম ও নবম শতাব্দিতে আরব বণিকরা কামরূপ ও সিলেটের পাহাড়ি জনপদ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে লবঙ্গ ইউরোপে রপ্তানির উদ্দেশ্যে নিয়ে যেত। একবার কোনো এক আরব বণিকের লবঙ্গভর্তি নৌযান এ নদীপথে যাওয়ার সময় ডুবে যায়।
আরবি ভাষায় লবঙ্গকে বলে ‘করনফোল’। পণ্ডিতদের মতে, সেই ‘করনফোল’ চট্টগ্রামবাসীর কাছে বিকৃত হয়ে এ নদীর নাম হয়েছে ‘কর্ণফুলী’। ষষ্ঠ শতকের আরবি ভাষার উল্লেখযোগ্য কবি ইমরুল কায়েস। পুরো নাম ইমরুল কায়েস বিন হুযর আল কিন্দি। তার কবিতায় প্রাচ্যের লবঙ্গের উল্লেখ পাই। তিনি লিখেছেন, ‘...তারাও সঠিক ছিলো, কস্তরীর গন্ধ বিলিয়ে/ হেঁটে যাচ্ছিলো পথে পথে/ ঠিক যেমন লবঙ্গের গন্ধ পশ্চিম থেকে/ বয়ে আসে পলকা বাতাসের রথে।...’(এনামূল হক পলাশ অনুদিত)।
কর্ণফুলীকে আধুনিককালে অনেক বেশি পরিচিত করেছেন মলয় ঘোষ দস্তিদারের লেখা গান গেয়ে শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষ, ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত/ লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে/ যার গই কর্ণফুলী।/ এক কূলদি শহর বন্দর নগর হত আছে/ আর এক কূলত সবুজ রুয়ার মাতাত সোনালী ধান হাসে,/ হালদা ফাডা গান হুনাইয়ারে সাম্পান যারে গৈ পাল তুলি/ লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে যার গৈ কর্ণফুলী।’
কর্ণফুলী নদীর সাম্পানের মাঝিকে নিয়ে এম. এ আখতারের লেখা ও সত্য সাহার সুরে শিল্পী শেফালী ঘোষের আরেক গান- ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা।’ এটি শাবানা-আলমগীর অভিনীত ‘মনিহার’ সিনেমার একটি জনপ্রিয় গান। আরও একটি জনপ্রিয় গান আছে সঞ্জিত আচার্য্যের লেখা ও সুরে শেফালী ঘোষের গাওয়া, ‘ওরে কর্ণফুলীরে, সাক্ষী রাখিলাম তোরে।’
সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৬২ সালে ‘কর্ণফুলী’ নামে উপন্যাস লিখে ইউনেস্কো পুরস্কার পেয়েছেন। তারও আগে ১৯৪৬ সালে কবি ওহীদুল আলম ‘কর্ণফুলীর মাঝি’ নামে কাহিনিকাব্য লিখে পরিচিতি পান। সে প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা। কর্ণফুলী ছিল কবির ভ্রমণের প্রিয় একটি স্থান। তিনি স্থানীয় যুবকদের নিয়ে কর্ণফুলীতে নৌ-বিহার করতেন। কবি গান লিখেছেন, ‘ওগো ও কর্ণফুলী/ উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি।’ কর্ণফুলীর সাম্পানওয়ালাকে নিয়ে একটি গান, ‘আমার সাম্পান যাত্রী না লয়।’ আরও একটি গান, ‘ও গো গহীন জলের নদী।’
আবার ‘চক্রবাক’ কবিতাবইয়ে ‘কর্ণফুলী’ নামের কবিতায় নজরুল লিখেছেন, ‘ও গো ও কর্ণফুলী/ তোমার সলিলে পড়েছিলো কবে কার কানফুল খুলি?/ তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে/ সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে?/ আনমনা তার খুলে গেল খোঁপা, কান ফুল গেল খুলি/ সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী?’ কবি কর্ণফুলীকে প্রিয়ার আসনে বসিয়ে কখনও কবিতা কখনও লিখেছেন গান।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৭ সালের ১৭ জুন চট্টগ্রাম আসেন। পরদিন ১৮ জুন যান কর্ণফুলী নদী দেখতে। কবি এক খালাসীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার চট্টগ্রাম কেমন দেশ?’ উত্তরে খালাসী বললো, ‘বাবু এরকম স্থান জগতে আর নাই। মক্কা-মদিনার পরই আমরা চট্টগ্রামকে গণ্য করি।’ জন্মভূমির প্রতি এমন প্রেমে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন। সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ও কর্ণফুলীর রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই হয়ত লিখেছিলেন, ‘যতবার চোখ মেলে তাকাই ততবার বিধাতাকে ধন্যবাদ জানাই।’ প্রায় ৩০০ বছর পুরনো লোককাহিনি ‘আমিনা সুন্দরীর’ নায়ক নছর মালুম নাকি সমুদ্রযাত্রা করেছিল এ নদীপথ ধরেই।
আমাদের শিল্পীদের গাইতে শুনেছি, ‘নদীও নারীর মতো কথা কয়’। কিন্তু সে কথা আমরা কি শুনছি? সাহিত্য আর সাহিত্যিকের কলমে ‘কর্ণফুলী’ বিশ্বমানুষের ভালোবাসা পেলেও মানবকূলের লালসার কারণে লাঞ্ছিতও হয়েছে। সে লাঞ্ছনার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ১৯৬২ সালে তৈরি কাপ্তাই বাঁধ। নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ছিল প্রকৃতিকে বশ করার একটি নগ্ন প্রকাশ। কর্ণফুলী সে লাঞ্ছনার জবাব দিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক আদিবাসীকে উদ্বাস্তুকরণের মধ্য দিয়ে। রাঙ্গামাটি রাজবাড়ি বিলীন হয়ে যায় নদীগর্ভে। ১৮৮৩ সালে কর্ণফুলীর মোহনায় সৃষ্টি হয় প্রথম চর, যার নাম ‘লুকিয়া চর’।
১৯৩০ সালে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের পর নদীর মাঝপথে সৃষ্টি হয় বিশাল আরেকটি চর, যা ‘কুলাগাঁও চর’ নামে পরিচিত। হালদা নদীর সঙ্গে কর্ণফুলীর সংযোগস্থলে সৃষ্টি হয়েছে আরেক বিশাল চর, যা ‘হালদা চর’ হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে চর ও দূষণের পাশাপাশি কর্ণফুলীকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে দখলদারি মানসিকতা। হারিয়ে যাচ্ছে তার সেই স্রোতস্বিনী রূপ। এসময় আমরা ভুলে যাই এই কর্ণফুলী বাংলাদেশের অর্থনীতির জীবনরেখা। এর পানি দিয়ে চাষাবাদ হয় প্রায় দশ লাখ একর জমি।
তথ্যসূত্র
১. নিতাই সেন: চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও অন্নদাশঙ্কর
২. আহমদ শরীফ: চট্টগ্রামের ইতিহাস
৩. চৌধূরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি: চট্টগ্রামের ইতিহাস
৪. আবদুল হক চৌধুরী: চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা।