রাজমিস্ত্রি বাবা কৃষিকাজও করতেন। লাল মিয়াও স্কুলের ফাঁকে বাবাকে যোগালির কাজে সাহায্য করতেন। তো এই রাজমিস্ত্রির কাজ করতে করতেই লাল মিয়ার ছবি আঁকার প্রতি ভীষণ আগ্রহ তৈরি হয়।
Published : 21 Aug 2022, 12:01 AM
আবারও ফিরে এলাম চিত্রকলার কাছে। তবে সেসব কোনো যেনতেন ছবি নয়! লেখার শিরোনামেই দেখতে পাচ্ছ, সেগুলো আকারে রীতিমতো বিশাল ও প্রকারে পেশীবহুল।
তোমাদের মনে নিশ্চয়ই এরই মধ্যে কৌতূহল জেগেছে ছবি আবার পেশীবহুল, মানে মাসলওয়ালা হয় কীভাবে! সে প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই দেব; তবে তার আগে চলো সেগুলোর যিনি স্রষ্টা, সেই লাল মিয়ার গল্পটা শুনে আসি।
জানি তোমরা আবারও ভাবতে বসেছ, ‘লাল মিয়া’ আবার কোনো শিল্পীর নাম হয় নাকি, আমরা তো বাংলাদেশে এমন কোনো শিল্পীর নাম শুনিনি। তা শোনোনি বটে, তবে সত্যিই তার ডাকনাম ছিল লাল মিয়া। বাবা-মা আদর করে এ-নামেই ডাকতেন তাকে এবং তিনি নিজেও তার এই নামটিকে এতটাই পছন্দ করতেন যে, সেটাকে বাদ দেওয়ার কথা কখনও ভাবতে পারতেন না।
বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা নড়াইলের এক গরিবঘরের ছেলে ছিলেন তিনি। রাজমিস্ত্রি বাবা কৃষিকাজও করতেন। লাল মিয়াও স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে বাবাকে যোগালির কাজে সাহায্য করতেন। তো এই রাজমিস্ত্রির কাজ করতে করতেই লাল মিয়ার ছবি আঁকার প্রতি ভীষণ আগ্রহ তৈরি হয় এবং তিনি দারুণ দারুণ ছবি এঁকে সবাইকে চমকে দিতে লাগলেন।
তার এই প্রতিভা দেখে গ্রামের জমিদার তাকে ছবি আঁকা শেখার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হলো পাকিস্তানের একসময়কার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির ভাই, বিখ্যাত শিল্পসমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে। তিনি তাকে তার বাড়িতে আশ্রয় দিলেন এবং কলকাতা আর্ট করেজে ভর্তি পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই পরীক্ষায় তিনি সবাইকে ডিঙিয়ে প্রথম হলেও, বয়স কম হওয়ার কারণে তাকে কলেজে ভর্তি করা হচ্ছিল না।
তখন আবারও শাহেদ সোহরাওয়ার্দি কলেজের অধ্যক্ষ মুকুল দে-কে বলে তাকে সেখানে ভর্তি করিয়ে দেন। আর তখনই তিনি কলেজের খাতায় তার ডাকনাম ‘লাল মিয়া’ বদলে আসল নাম ‘শেখ মোহাম্মদ সুলতান’ দিয়ে দিলেন। সেদিনের সেই শেখ মোহাম্মদ সুলতানই কালক্রমে এস এম সুলতান নামে বাংলাদেশে তো বটেই সারা পৃথিবীতেই শিল্পী হিসাবে প্রভূত খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেন। এবার সেই গল্পটি বলি।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) চলছিল। ভারতে প্রচুর বিদেশি তথা ব্রিটিশ ও আমেরিকান সৈন্যদের আনাগোনা। তিনি তাদের মুখের ছবি এঁকে সেই পয়সা দিয়ে চলতেন।
স্কুল-পালানো, ঘর-পালানো ছেলে সুলতান ছিলেন বাউন্ডুলে স্বভাবের, কিন্তু মনেপ্রাণে শিল্পীপ্রকৃতির। বদ্ধ দালানকোঠা, ধরাবাঁধা নিয়মকানুন কিছুই ভালো লাগতো না তার। তাই আবারও পালালেন তিনি আর্ট কলেজের লেখাপড়া শেষ না করেই। সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন তিনি, সঙ্গে ছবি আঁকা তো ছিলই। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) চলছিল। ভারতে প্রচুর বিদেশি তথা ব্রিটিশ ও আমেরিকান সৈন্যদের আনাগোনা। তিনি তাদের মুখের ছবি এঁকে সেই পয়সা দিয়ে চলতেন, পাশাপাশি নিজের পছন্দের ছবি, বিশেষ করে ভারতের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রময় প্রকৃতির ছবি আঁকতেন। তার সেসব ছবির একটা প্রদর্শনীও হয়েছিল ভারতের বিখ্যাত পর্যটন শহর সিমলায় ১৯৪৬ সালে।
এরপর তো তোমরা জানো ১৯৪৭ সালে রক্তাক্ত দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারত দুটো স্বাধীন দেশ হয়ে গেল। ঘরের ছেলে সুলতান তখন ঘরে ফিরে এলেন ঠিকই, কিন্তু সেখানেও বেশিদিন মন টিকল না। তিনি আবার ঠাঁইনাড়া হলেন। এবার গেলেন করাচি, সেখানে পরিচয় হল পাকিস্তানের তাবড় শিল্পী আবদুর রহমান চুঘতাই, নাগি, শাকের আলি প্রমুখের সঙ্গে। সেই জাঁদরেল শিল্পীদের সংস্পর্শে এসে একদিকে যেমন তার ছবি আঁকার হাত আরও শাণিত হল, অন্যদিকে তার চেনাজানার পৃথিবীটাও আরও অনেক বিস্তৃত হলো।
দু’দুটো প্রদর্শনী করলেন তিনি লাহোর ও করাচিতে। সেই সূত্রে আমন্ত্রণ পেলেন ১৯৫০ সালে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে একটি আন্তর্জাতিক শিল্পী সম্মেলনে অংশ নেওয়ার। তার কাজ দেখে সেখানে সবাই এতই মুগ্ধ হল যে, আমেরিকার চারটি প্রধান শহর নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডি.সি., শিকাগো, বস্টনে তার একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল একে একে। সেখান থেকে ফেরার পথে ১৯৫৩ সালে তিনি লন্ডনেও একটি দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নেন, যেখানে তার সঙ্গে পৃথিবীর প্রথমশ্রেণির কজন শিল্পীও অংশ নেন, যাদের মধ্যে ছিলেন পাবলো পিকাসো, জর্জ ব্রাক, সালবাদোর দালি, পল ক্লি প্রমুখ। এবারে বুঝলে তো আমাদের সুলতান কতবড় একজন বিশ্বখ্যাত শিল্পী!
এতবড় সব ছবির ক্যানভাসও কিন্তু তিনি নিজেই বানিয়ে নিতেন চটের বস্তা দিয়ে; এমনকি ছবি আঁকার রংও বানাতেন নিজ হাতে- লতাগুল্ম, ফলমূল, ভেষজ ইত্যাদির রস নিংড়ে নিয়ে।
তো, দেশে ফিরে তিনি কিন্তু শহরে থাকলেন না, সোজা চলে গেলেন গ্রামের বাড়ি নড়াইলে। সেখানে তিনি গ্রামের গরিব চাষাভুষো, হাঁসমুরগি, কুকুরবেড়াল আর গাছপালাদের সঙ্গে মিতালি পাকিয়ে, খোলা আকাশের নিচে বসে দিব্যি মনের আনন্দে ছবি আঁকতে লাগলেন, বিশাল বিশাল সব ছবি। একেকটা ছবির দৈর্ঘ্য পনেরো থেকে কুড়ি ফুট আর উচ্চতায় ছ-সাত ফুটের কম নয়। এতবড় সব ছবির ক্যানভাসও কিন্তু তিনি নিজেই বানিয়ে নিতেন চটের বস্তা দিয়ে; এমনকি ছবি আঁকার রংও বানাতেন নিজ হাতে- লতাগুল্ম, ফলমূল, ভেষজ ইত্যাদির রস নিংড়ে নিয়ে। তার ছবির বিষয়বস্তু আর কিছুই নয়, তিনি যে গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছেন সেই চিরন্তন গ্রামবাংলার নদী-মাঠ, খালবিল, ফসলের জমি, কৃষকশ্রমিক, খেটেখাওয়া মানুষ, গ্রামের বউঝি আর ছেলেবুড়োদের নিত্যদিনের হাসিকান্না ও জীবনসংগ্রামের বিশাল ও বর্ণিল চিত্রমালা।
তার ছবিগুলো আকারে যেমন বিশাল তেমনি তার পরতে পরতে মিশে থাকে অসংখ্য মানুষ, পশুপ্রাণী ও প্রকৃতির নানাবিধ উপকরণ। আর তার নিজ হাতে বানানো নানান রঙের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে সেই চিত্রকর্মগুলো হয়ে ওঠে আরও জীবন্ত ও আকর্ষণীয়, তবে সবচেয়ে আলাদা ও অভিনব ছিল তার ছবির মানুষগুলোর আকৃতি, প্রকৃতি। তিনি নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সবাইকে খুবিই বড়সড়, মাংসল, পেশীবহুল ও শক্তিশালী করে আঁকতেন, যা দেখে সবাই বিস্মিত ও অভিভূত হত।
সবারই প্রশ্ন, আমাদের গ্রামের চাষাভুষোরা তো সবাই খুব রোগা-দুবলা, জীর্ণশীর্ণ চেহারার হয়, আপনি কেন তাদেরকে এমন অতিকায় আদলে আঁকেন? তার সোজাসাপটা উত্তর: আমাদের কিষান-কিষানিরা বাইরে থেকে ছোটখাটো, রুগ্ন ও স্বাস্থ্যহীন হতে পারে, কিন্তু তাদের ভেতরে রয়েছে অসম্ভব এক শক্তির উৎস, তিনি যাকে বলতেন ‘দ্য ইনার স্ট্রেংথ’, যে শক্তিতে তারা মাঠেঘাটে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়ে, কাপড় বুনে, মাছ ধরে সারা দেশের মানুষকে খাইয়ে, পরিয়ে রাখে এবং এইভাবে যুগ যুগ ধরে টিকিয়ে রেখেছে গোটা মানবসভ্যতাকেই। তাই তাদের এমন বিশাল ও বলবান করে তুলে ধরি আমার ছবির ক্যানভাসে। তার কয়েকটি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে: প্রথম বৃক্ষরোপণ, চরদখল, হত্যাযজ্ঞ ও বিপ্লব ইত্যাদি।
শিশুদের জন্য দুটো ইশকুলও বানিয়েছিলেন তিনি, ‘নন্দনকানন’ ও ‘শিশুস্বর্গ’ নামে। ‘শিশুস্বর্গ’ স্কুলটি আসলে একটা বিশাল নৌকো, যার মধ্যে গ্রামের সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি চিত্রা নদীতে ভাসতে ভাসতে ছবি আঁকা শেখাতেন, দিতেন জীবনে বড় হবার দীক্ষা ও মন্ত্রণা।
তোমরা জেনে খুশি হবে, তিনি শিশুদের খুব পছন্দ করতেন এবং তাদের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। তাদের জন্য দুটো ইশকুলও বানিয়েছিলেন তিনি, ‘নন্দনকানন’ ও ‘শিশুস্বর্গ’ নামে। ‘শিশুস্বর্গ’ স্কুলটি আসলে একটা বিশাল নৌকো, যার মধ্যে গ্রামের সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি চিত্রা নদীতে ভাসতে ভাসতে ছবি আঁকা শেখাতেন, দিতেন জীবনে বড় হবার দীক্ষা ও মন্ত্রণা।
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর এই মহান মানুষটি শেষ নিশ্বাস ফেলেন। জীবনে অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার তিনি পেয়েছেন মানুষের কাছ থেকে, পেয়েছেন তাদের নিখাঁদ ভালোবাসা ও সম্মান। আজও নড়াইলে প্রতিবছর জন্মদিনে তার স্মরণে বর্ণিল ‘সুলতান মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। আমার বন্ধু প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তাকে নিয়ে ‘আদমসুরত’ নামে একটা চমৎকার প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন, যেটি এখন ইউটিউবেও পাওয়া যায়। তোমরা এই ছবিটিতে সুলতানের ছবি আঁকা, কথা বলা, হাঁটাচলা সবকিছুই দেখতে পাবে, যা নিঃসন্দেহে তোমাদের জন্য হবে অমূল্য এক অভিজ্ঞতা।
এছাড়া এদেশের অত্যন্ত মেধাবী ও প্রবীণতম সাহিত্যিকদের একজন, হাসনাত আবদুল হাইও তাকে নিয়ে ‘সুলতান’ নামেই দারুণ একটি জীবনী-উপন্যাস লিখেছেন, যা পড়লে তোমরা তার বিচিত্র জীবন সম্পর্কে আরও অনেক কিছুই জানতে পারবে।
সবশেষে আরেকটা তথ্য। আগামী বছর ১০ অগাস্ট সুলতানের জন্মের একশ বছর পূর্ণ হবে। আমার আরেক বন্ধু, বিশ্ববিখ্যাত আলোকচিত্রী ও সুলতানের প্রচণ্ড অনুরাগী নাসির আলী মামুন, যার তোলা সুলতানের ছবি নিয়ে একটি অ্যালবামও রয়েছে ‘গুরু’ নামে,তার জন্মশতবর্ষ উদযাপনের জন্য দেশজোড়া বিশাল কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছে। আশা করি তোমরাও তাতে সবাই মিলে অংশগ্রহণ করে আমাদের এই মহান শিল্পীর প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাটুকু নিবেদন করবে।
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!